শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৪৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::

মুমিন পিতা-মাতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ ধার্মিক সন্তান

ড. মুহাম্মদ আব্দুল বারী
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২২ মে, ২০২০

মানবশিশু জন্মগ্রহণ করে সহজাত কিছু সৎ গুণাবলী নিয়ে। ইসলামে এটাকে ফিতরাত (ফিতরাহ) বলা হয়। (সহিহ বুখারী)। ইসলামী আকিদায় বিশ্বাসের আলোকে মানুষ হলো পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। (সূরা আল বাকারা : ৩০)। এবং তাকে কিরামাহ দেয়া হয়েছে, যার অর্থ সম্মান বা মর্যাদায় ভূষিত করা। (সূরা বনী ইসরাইল : ৭০)। প্রত্যেক ঈমানদার পিতা-মাতার দায়িত্ব তাদের সন্তানদের আল্লাহর দাস হিসেবে গড়ে তোলা। তাদের সন্তানদের ভালো মানুষ, বিশ্বাসী, সুনাগরিক ও সবার জন্য ইতিবাচক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা এবং তাদের শিক্ষিত করা পিতা-মাতাদের প্রাথমিক কাজ। শৈশবকালে পুরোপুরি ও যৌবনে প্রবেশের আগ পর্যন্ত সন্তানরা তাদের মা-বাবা এবং তাদের কাছের প্রাপ্ত বয়স্কদের ওপর নির্ভরশীল থাকে। একজন দক্ষ মালি যেভাবে যতনিয়ে তার চারা-গাছগুলোকে ভবিষ্যতের সুন্দর ফুল ও ফল পাওয়ার জন্য দেখভাল করেন, দায়িত্ববান পিতা-মাতাও তাদের আদরের সন্তানের জন্য জন্মের আগে থেকেই তার যত নেয়া শুরু করেন। যাতে তারা দায়িত্বশীল ও মানব কল্যাণে ব্রতী আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। মুমিন পিতা-মাতার ধার্মিক সন্তানরা তাদের জন্য কিয়ামতের দিন পর্যন্ত সদকায়ে জারিয়া হিসেবে গণ্য হবে।

সন্তানদের আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করা : দায়িত্বশীল পিতা-মাতাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু তাদের সন্তানরা। ‘এমন কোনো উপহার কোনো পিতা তার সন্তানকে দিতে পারেন না, যা কিনা ভালো ব্যবহারের চেয়েও পুণ্যবান।’ (সুনানে তিরমিযী)। ছোট শিশুরা তাদের কাছের প্রাপ্তবয়স্কদের ও পিতা-মাতাকে গভীর মনোযোগের সাথে অনুসরণ করে এবং তা থেকে সে শিষ্টাচার ও আদব-কায়দা শিখে নেয়। এভাবেই শিশুরা সুশৃঙ্খলিত পারিবারিক পরিবেশে খুশি মনে আত্মবিশ্বাসের সাথে বেড়ে ওঠে। যেহেতু তারা সামাজিক ও জীবনের দক্ষতা শিখতে শুরু করে, তাদের কৈশোরের যাওয়ার জন্য যতটুকু সম্ভব আত্মসম্মানবোধ, নম্রতা এবং পরিপক্কতা থাকতে হবে। এই বৃহত্তর দুনিয়ার সাথে ধীরে ধীরে পরিচিত হওয়ার আগেই সন্তানের জীবন-যৌবন সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও কুসংস্কার দূর করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের সঠিক সমর্থন দেয়া এবং দিকনির্দেশনা সরবরাহ করা উচিত। পিতা-মাতার সাথে সুসম্পর্ক এবং প্রাত্যহিক জীবন নিয়ে বয়স উপযোগী কথোপকথন একজন বাচ্চাকে নিজের সপ্রতিভ পরিচয়, আত্মনিশ্চয়তা এবং নিজের সম্পর্কে সঠিকভাবে বুঝতে সাহায্য করে। কিছুটা বড় বয়সে মুসলিম কিশোররা, যারা কিনা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে প্রবেশ করবে, তাদের মনে হতে পারে তারা ইসলামফোবিয়ার যুগে আছে। সুতরাং এটা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তারা এ জীবনের জন্য পর্যাপ্তভাবে প্রস্তুত। তারা মিডিয়া ও রাজনৈতিক চক্রে তাদের ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ভুল ব্যাখ্যা পেতে পারে, যা কিনা তাদের ক্ষতি ও হতাশ করতে পারে কিংবা রাগের কারণ হতে পারে। এমন পরিবেশে যেসব বাচ্চা নিজের বাসায় ইতিবাচক অভিভাবক পায়নি, তারা ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের ক্ষতির দিকে ফিরে যেতে পারে; কেউ কেউ আবার প্রকাশ্যে তাদের বিশ্বাসের পরিচয় প্রকাশ করতে ভয় পেতে পারে; কেউ আবার নিজেদের প্রকৃত অনুভূতিগুলো তাদের পিতা-মাতা এবং শিক্ষকের সাথে প্রকাশ করতে নাও পারে। এটি তাদের সামাজিক আচরণ এবং একাডেমিক অগ্রগতি রোধ করতে পারে। এসব চ্যালেঞ্জ এড়াতে নিজের মনে ‘স্বাচ্ছন্দ্যময়’ বিশ্ব তৈরি করা এসব শিশুর পক্ষে একটা বিকল্প হতে পারে। তাই পিতা-মাতার সন্তানের সাথে সময় কাটানো, অধিকতর যোগাযোগ, সহানুভূতি প্রদর্শন করা এবং অন্যান্য সম্পর্কযুক্ত গুণাবলী মজবুত করা অত্যধিক প্রয়োজন।

ইতিবাচক ব্যক্তিত্বের জন্য আত্মপরিচয়ের ওপর আস্থা রাখা অপরিহার্য : শৈশব থেকে যৌবনে রূপান্তর মানে বয়ঃসন্ধিকাল একটা পরীক্ষামূলক সময়, সে সময় তারা আত্মপরিচয়ের সন্ধান লাভ করে। এ সময় তারা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে পরিবর্তিত হয় এবং তারা বিশ্বকে অন্বেষণ করতে চায়। এই পরিবর্তনের প্রকাশ বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে কথা বলায়, আচরণে ও পোশাকে। ইতিবাচক যুব সংস্কৃতির পরিবর্তন সময়টিতে মানসিক শক্তি সরবরাহ করে। যারা এ পর্যায়ে সফল হয়ে যাত্রা করতে পারবে, তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠবে, ইতিবাচকভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে এবং তাদের মা-বাবা এবং সমাজের অন্যদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে। অন্যদিকে আত্মপরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞতা তরুণদের মানসিকভাবে দুর্বল এবং অস্থির করে তোলে। এটি তাদের ভবিষ্যতের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি তাদের মনে অপরাধবোধ সৃষ্টি করতে পারে, যা থেকে তারা অপরাধ; এমনকি হিংস্র চরমপন্থার মধ্যে জড়িয়ে পড়তে পারে। কেউ কেউ আবার নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গ্যাং ফাইটিংয়ের মতো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে পারে। আবার কেউ এই ক্ষোভ নিজেদের মনের মধ্যে রেখে চরম বিষণ্নতার শিকার কিংবা বিকৃত মানসিকতার অধিকারী হতে পারে। একটি সুস্থ ও শিক্ষিত সমাজ তৈরিতে খুব সহজভাবেই বয়ঃসন্ধিকালের কঠিন সময়টি পার করার জন্য একটি ইতিবাচক পারিবারিক    ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি অপসংস্কৃতি পূর্ণ সমাজ এবং বিশৃঙ্খলতাবদ্ধ পারিবারিক পরিবেশ অনেক যুবককে বিষণকরে। একটি শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন ছাড়া কোনো মানুষই উন্নতি করতে পারে না! একটি ফুলের বাগানে যেমন নানা রঙের, গন্ধের ও বৈচিত্র্যের ফুল থাকে, ঠিক তেমনি মানুষ নানা ধরনের হয়ে থাকে। একটি ইতিবাচক সামাজিক পরিবেশে নিজের পছন্দ এবং সম্মিলিত চাহিদার মধ্যে একটি মাঝামাঝি আদর্শ হয়ে উন্মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি করে। এটা জনগণকে সম্প্রীতির সাথে কাজ করার জন্য আত্মবিশ্বাস দেয়। ব্রিটেনের বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করার ক্ষমতা একটি ইতিবাচক দিক, যদিও অনেকেরই আছে। কিছু মিডিয়া নেতিবাচক শিরোনাম প্রকাশ করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, যা কিনা সামাজিক সম্প্রীতির ওপর সত্যিকারের হুমকি।

আত্মবিশ্বাসী মুসলমানরা সমাজ কল্যাণের জন্য একটি শক্তি : একাধিক পরিচয় ধারণ করা  জাতিগত, ভাষাগত বা ধর্মীয়ভাবে মানুষকে তাদের একমাত্রিক অন্ধতা থেকে মুক্তি দেয়। ইসলামে ‘মধ্যমপন্থা’ পদ্ধতি ইতিহাসের সর্বদা ইতিবাচক এবং গঠনমূলক ফল এনেছে। মহামারি লকডাউন চলাকালীন এই রমজানে মধ্যমপন্থা রীতিটিকে লালন করা উচিত। ইসলামী মূল্যবোধ সব যুগে এবং সব স্থানে মুসলিম জীবনে ইতিবাচক    ভূমিকা পালন করে। দর্শন এবং বাস্তবতা পৃথক হতে পারে, তবে ইসলামের শিক্ষাগুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে। যারা শুধু নিজের স্বার্থের দিকে না দেখে সবার স্বার্থের দিকে চিন্তা করেন, তারা সবাই ইসলামের শিক্ষা অনুসরণ করেন। মুসলিমরাÑ তারা যা প্রচার করেন, তা অনুশীলন করেন, ইসলামের গতিশীল এবং সৃজনশীল বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের জীবনকে ইতিবাচক রূপ দেয়, তাদের বিশ্বাসী মুসলমানরাই সকলের পক্ষে সুফল নিয়ে আসে। সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত মুসলমানদের কাছে একটি গোত্র, উপজাতি বা বর্ণের ভিত্তিতে ‘আমাদের এবং তাদের’ ধারণাটি একটি অবাস্তব ধারণা। ইসলামের ভিত্তি হলো একত্ববাদ বা আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় বলে স্বীকার করা এবং মানব জাতির একত্মতা বা সকল মানুষ আদি পিতা আদম ও আদি মাতা হাওয়া (আ.)এর সন্তান এ কথা বিশ্বাস করা। কোনো মুসলিমই একজন মানুষের ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারে না, হোক সে মুসলমান কিংবা অমুসলিম। একমাত্র আল্লাহই জানেন, তাকওয়ার ভিত্তিতে কে শ্রেষ্ঠ। আত্মবিশ্বাসী মুসলমানরা বিশ্বের সব মানুষের অগ্রগতি এবং বিকাশের লক্ষ্যে কাজ করেন। তারা যেখানেই থাকুক না কেন, তারা বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্য এক শক্তি। (অনুবাদ : হাসানাত ফারিহা নূন)।

লেখক : ড. মুহাম্মদ আব্দুল বারী, ব্রিটিশ বাংলাদেশি শিক্ষাবিদ, প্যারেটিং পরামর্শদাতা ও কলামিস্ট।   টুইটার : @MAbdulBari




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com