বাংলাদেশের অন্যতম প্রশাসনিক বিভাগ রাজশাহী। আদিতে মোট ১৬টি জেলা নিয়ে গঠিত হয়েছিল এ বিভাগ। এগুলো হলো নাটোর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড়, রংপুর ও ঠাকুরগাঁও। তবে ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি এ বিভাগের সীমানা অর্ধেক হয়ে যায়। শেষের আটটি জেলা নিয়ে গঠিত হয় রংপুর বিভাগ। অখ- ভারতে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং ও পাবনা জেলার কিছু অংশ ছাড়া বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত ছিল এ জনপদ। মৌর্য, পাল ও সেন শাসনামলে এটি বরেন্দ্রভূমি নামে পরিচিত ছিল। মুসলিম শাসনামলে তা গৌড়ের অন্তর্ভুক্ত হয়।
সংস্কৃত ‘রাজ’ ও ফারসি ‘শাহী’ শব্দের সমন্বয়ে ‘রাজশাহী’ শব্দটি গঠিত। রাজশাহী নামটির উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক আছে। এ শহরের প্রাচীন নাম ছিল মহাকালগড়। পরবর্তী সময়ে এর নাম হয় রামপুর-বোয়ালিয়া। রামপুর ও বোয়ালিয়া নামক দুটি গ্রাম নিয়ে রাজশাহী শহর গড়ে উঠেছিল বলে এমন নামকরণ। সেখান থেকে রাজশাহী নামটির উদ্ভব কীভাবে হলো, তার সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র মতে, রাজশাহী নামটি রানী ভবানীর দেয়া। গ্রান্ট সাহেবের মতে, রানী ভবানীর জমিদারিকেই রাজশাহী বলা হতো। কারো মতে, রাজা গণেশের সময় রাজশাহী নামটির উদ্ভব ঘটে। ঐতিহাসিক হান্টারের মতে, নাটোরের রাজা রামজীবনের জমিদারি রাজশাহী নামে পরিচিত ছিল। নবাবি আমলে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে সমগ্র বাংলাকে মোট ১৩টি চাকলায় বিভক্ত করেছিলেন। যার মধ্যে ‘চাকলা রাজশাহী’ নামে একটি বৃহৎ বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল। প্রথমে সমগ্র চাকলার রাজস্ব আদায় করতেন হিন্দু জমিদার উদয় নারায়ণ। তিনি নবাবের একান্ত প্রীতিভাজন ছিলেন। নবাব তাকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। কারো কারো মতে, প্রথম রাজা উদয় নারায়ণের ওপর প্রীতিবশত এ চাকলার নাম ‘রাজশাহী’ রাখেন নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ।
প্রাচীনকালে সমগ্র বাংলা কয়েকটি ভূখ-ে বিভক্ত ছিল। পু-্রবর্ধন তাদের অন্যতম। বর্তমান রাজশাহী বিভাগসহ সমগ্র উত্তরবঙ্গ পু-্রবর্ধনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বরেন্দ্র অঞ্চল ছিল পু-্রবর্ধনের কেন্দ্রস্থল। পূর্বে করতোয়া নদী, পশ্চিমে মহানন্দা, দক্ষিণে পদ্মা ও উত্তরে হিমালয় এ হলো বরেন্দ্রভূমির সীমানা। বরেন্দ্র অঞ্চলের দক্ষিণ সীমান্তে পদ্মা নদীর তীরবর্তী জনপদটিই বর্তমানের রাজশাহী জেলা। মহামতি যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৪০০ বছর আগে পু-্রবর্ধন মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বগুড়া শহরের কয়েক মাইল উত্তরে অবস্থিত মহাস্থানগড় ছিল মৌর্যদের রাজধানী। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর গুপ্ত সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত গুপ্তদের প্রধান কেন্দ্র ছিল পু-্রবর্ধন। সপ্তম শতাব্দীর প্রথম ভাগে রাজা শশাঙ্ক বাংলার শাসক হন। তারপর হর্ষবর্ধনের আবির্ভাব। হর্ষবর্ধনের শাসনামলে বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং বাংলায় আগমন করেন। তিনি রাজশাহীর দক্ষিণতম সীমান্তে গোদাগাড়ী ও নবাবগঞ্জের মধ্যবর্তী কোনো এক স্থান দিয়ে পু-্রবর্ধনে প্রবেশ করেছিলেন। এ অঞ্চলে ভ্রমণকালে তিনি শতাধিক দেবালয় এবং ২০টি সংঘারামে তিন হাজারেরও বেশি বৌদ্ধ ভিক্ষু দেখতে পান। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত পু-্রবর্ধন পালদের অধীনে ছিল। রাজশাহীর ইতিহাসে পাল শাসনামল এক গৌরবময় যুগ। তারা বরেন্দ্র অঞ্চলেই বাস করতেন। তাদের প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র ছিল এ জনপদ। পাল বংশের প্রথম সফল শাসক ধর্মপাল। তিনি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। বিখ্যাত সোমপুর বিহার তার আমলে নির্মিত হয়। নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলায় অবস্থিত বিহারটি সমগ্র বাংলার অন্যতম প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। পাল আমলে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ‘কৈবর্ত বিদ্রোহ’। একাদশ শতকের শেষ পাদে পাল বংশের দ্বাদশ রাজা দ্বিতীয় মহীপালের সময়ে এ বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। তিনি একজন স্বেচ্ছাচারী ও অযোগ্য রাজা ছিলেন। তার স্বেচ্ছাচারিতা ও অত্যাচার সহ্যসীমা ছাড়িয়ে গেলে বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। দিব্যোক নামক এক কৈবর্ত এ বিদ্রোহের নেতা ছিলেন। তার নেতৃত্বে দ্বিতীয় মহীপালের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে মহীপাল পরাজিত ও নিহত হন। দিব্যোক বরেন্দ্র অঞ্চলের নতুন শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। তারপর তার ভ্রাতুষ্পুত্র ভীম বরেন্দ্রের অধিপতি হন। অবশ্য কৈবর্ত শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মহীপালের ভাই রামপাল কৈবর্তদের থেকে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন। প্রাচীন বাংলার কবি সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিত’ গ্রন্থে এর বিবরণ পাওয়া যায়। পালদের পর সেন বংশের রাজত্ব শুরু হয়। বিজয় সেন এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম রাজা। তার উত্তরসূরিরা গৌড়ে রাজধানী স্থাপন করেন। বিজয় সেনের পর তার পুত্র বল্লাল সেন সিংহাসনে আরোহণ করেন। সেন বংশের শেষ রাজা ছিলেন লক্ষ্মণ সেন। তিনি ছিলেন বল্লাল সেনের পুত্র। তিনি ১১৭৮-১২০৬ সাল পর্যন্ত গৌড় অঞ্চলে রাজত্ব করেন। বরেন্দ্র অঞ্চলে সেনদের রাজত্ব খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলা জয় করেন। এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে সেন রাজত্বের। শুরু হয় মুসলিম শাসন।
বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়কে এ অঞ্চলে মধ্যযুগের সূচনাবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বিজিত রাজ্যে শাসন ব্যবস্থার সুবিধার জন্য তিনি একে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। সমগ্র বরেন্দ্র ভূমি নিয়ে এক ভাগ, যার রাজধানী ছিল দেবীকোট (বর্তমান পশ্চিম দিনাজপুর)। অপর ভাগের রাজধানী ছিল লখনৌতি। বরেন্দ্র ভূমির অংশ হিসেবে রাজশাহী জনপদের অধিকাংশ দেবীকোট শাসনকেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ কিছু অংশ গৌড়ের অধীন ছিল। ১২০৬ সালে বখতিয়ার খিলজি মৃত্যুবরণ করেন। মুহাম্মদ শিরন খিলজি নামে তার এক উচ্চপদস্থ কর্মচারী গৌড়ের শাসক হন। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি নামে তিনি স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করেন। তিনি মাত্র এক বছর গৌড় শাসন করেন। তারপর ক্ষমতায় আসেন আলী মর্দান খিলজি। তিনি ব্যাপক স্বেচ্ছাচারী ছিলেন। তার স্বেচ্ছাচারিতায় বিরক্ত হয়ে তার বিরোধী আমিররা তাকে হত্যা করেন। তারা হুসামউদ্দিন ইউয়াজ খিলজিকে তাদের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তিনি প্রায় ১৪ বছর শাসনক্ষমতায় ছিলেন। এ সময় দেবীকোট থেকে গৌড়ে রাজধানী স্থানান্তর করেন তিনি। ১৩৪২ সালে হাজী ইলিয়াস শাহ স্বাধীন সুলতান হিসেবে গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার বংশ ইলিয়াস শাহী বংশ নামে পরিচিত। তিনি পা-ুয়ায় রাজধানী স্থাপন করেন। এ বংশের সুলতান শামসউদ্দিনকে পরাজিত করে ভাতুরিয়া পরগনার রাজা গণেশ বঙ্গ দখল করেন। গণেশের পরে তার পুত্র যদুনাথ রাজা হন। তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ নাম ধারণ করেন। তিনি পা-ুয়া থেকে আবার গৌড়ে রাজধানী স্থাপন করেন। ইলিয়াস শাহী বংশের পতনের পর শুরু হয় হোসেন শাহী বংশ। আরব থেকে আসা সৈয়দ বংশীয় আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর প্রতিষ্ঠাতা। গৌড়ের ‘ছোট সোনামসজিদ’ তার অবিস্মরণীয় কীর্তি। এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। তার রাজত্বকাল বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পর তার পুত্র নাসিরউদ্দিন নুসরৎ শাহ গৌড়ের অধীশ্বর হন। তিনি রাজশাহী জেলার ‘বাঘা মসজিদ’ নির্মাণ করেন। সুলতানি আমল শেষে মোগলদের অধীনে আসে রাজশাহী অঞ্চল। ১৫৭৪-১৭২৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৯ জন মোগল প্রশাসক বাংলা শাসন করেন। তাদের মধ্যে মানসিংহ, ইসলাম খাঁ, যুবরাজ মুহাম্মদ সুজা, মীর জুমলা, নবাব শায়েস্তা খাঁ ও নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। মুর্শিদকুলী খাঁ অনেকটা স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করেন। তার উত্তরসূরি নবাব আলিবর্দি খাঁ ও নবাব সিরাজউদ্দৌলাও কার্যত স্বাধীন ছিলেন। মোগল আমলের এ ২০০ বছরের প্রশাসনে রাজশাহী অনেকাংশে সমৃদ্ধ হয়। নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর শাসনামল থেকেই মূলত এ অঞ্চলে জমিদারি প্রথার গোড়াপত্তন হয়। এ জমিদাররা রাজা হিসেবে অভিহিত হতেন। রাজশাহী অঞ্চলের রাজবংশগুলোর মধ্যে পুঠিয়া, নাটোর, দিঘাপতিয়া, সাঁতৈল, দুবলহাটীর নাম উল্লেখযোগ্য।
ব্রিটিশ বেনিয়াদের শাসনামলে রাজশাহী বিদ্রোহ ও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৮৫৯-৬০ সালে নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সমগ্র বাংলায় শুরু হয় নীল বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহে রাজশাহী অঞ্চলের প্রজারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা রাজশাহীর গুরুদাসপুর, লালপুর, পুঠিয়া, শিবগঞ্জ, গোমস্তাপুর ও ভোলাহাট থানার প্রায় ২৫টি নীল ও রেশম কুঠিতে আক্রমণ চালায়। এ সময় কয়েকজন ইংরেজ দেওয়ান ও অসংখ্য কর্মচারী নিহত হয়। নীল বিদ্রোহের পরে রাজশাহীতে শুরু হয় প্রজা বিদ্রোহ। নতুন জরিপের নামে খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহ শুরু হয়। দুবলহাটী রাজ্যের বিদ্রোহী নেতা আস্তান মোল্লার নেতৃত্বে প্রায় ৫০ হাজার প্রজা একত্র হয়ে রাজা হরনাথের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা তিনদিন রাজবাড়ি অবরোধ করে রাখে। এ বিদ্রোহ প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলে। অবশেষে রাজা হরনাথ খাজনা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করেন। দুবলহাটীর রাজার এ শোচনীয় পরাজয় দেখে মহাদেবপুর, চৌগ্রাম, কানসাট প্রভৃতি এলাকার জমিদাররাও খাজনা বৃদ্ধির চিন্তা থেকে সরে আসেন। এ বিদ্রোহের প্রভাবেই ১৮৮৫ সালে ‘বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন’ প্রবর্তিত হয়। অসহযোগ আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলনসহ ব্রিটিশবিরোধী প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে রাজশাহীর জনগণ পুরোধা ভূমিকা পালন করে। রাজশাহী অঞ্চলের আরেকটি বিখ্যাত ঘটনা হলো ‘নাচোল বিদ্রোহ’। পাকিস্তান আমলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলায় এ বিদ্রোহের সূত্রপাত। এ বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রজাকুলের বহু দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও অসন্তোষ। মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহীর জনগণ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে রাজশাহীর নিকটবর্তী আরানী রেলস্টেশনের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তারা প্রথম সম্মুখসমরে লিপ্ত হয়। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর নাটোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে শত্রুমুক্ত হয় এ জনপদ। স্বাধীন দেশে শুরু হয় তার নতুন পথচলা। বণিকবার্তা সিল্করোডের সৌজন্যে, রবিউল হোসাইন: লেখক