শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৩ অপরাহ্ন

ঘুম নেই পুতিনের চোখে!

রিচার্ড গ্যালান্ট
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১২ মে, ২০২৩

প্রখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়রের নাটকের একটি দৃশ্য দিয়ে লেখাটা শুরু করতে চাই। নাইটগাউন পরে মঞ্চে আসেন রাজা চতুর্থ হেনরি। হেনরিকে খুবই বিচলিত লাগছে। এর কারণ, তিনি অবাক বিষ্ময়ে ভাবছেন, কেন তার চোখে ঘুম আসছে না! কেন অস্থিরতা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে! এসব অস্থির চিন্তা করতে করতে হেনরি নিজেকে কল্পনা করেন একটি জাহাজের মাস্তুলের ওপর। চারদিকে বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ঢেউয়ের প্রকোপে জাহাজ ডুবে যাওয়ার জোগাড়! এমন একটি অস্থির পরিবেশে কি নরম বিছানায়ও ঘুম আসে কারো?
শেক্সপিয়র নাটকটি শেষ করেছেন এভাবেÍরাজার মাথায় মহামূল্যবান ও ব্যাপক ক্ষমতার প্রতীক ‘মুকুট’ থাকলেও অত্যন্ত দুর্বল মনে হচ্ছে রাজাকে! রাজার মাথায় চেপে বসে আছে নানা ‘অস্থিরতা’! যেন অস্বস্তিকর অবস্থা ঘিরে ধরেছে রাজার সাম্রাজ্যকে! নাটকের এই প্রসঙ্গ টানার কারণ হলো, এই সপ্তাহে বিশ্বরাজনীতির আলোচনায় ঘুরেফিরে এসেছে মুকুটের প্রসঙ্গÍব্রিটেনের নতুন রাজা তৃতীয় চার্লসের মাথায় উঠেছে রাজমুকুট। এ ধরনের দৃশ্য বিশ্ব জুড়ে আনন্দ উৎসবের উদ্রেক ঘটায় বটে, কিন্তু গভীর মনোযোগ সহকারে লক্ষ করলে দেখে যাবে, আজকের বিশ্বে ভালো নেই মুকুট-সম্রাটরা! সাম্প্রতিককালে সময় ‘ভালো’ যাচ্ছে না বিশ্বের কোনো প্রান্তের নেতার! চিন্তামুক্ত নন বিশ্বের দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সম্রাটেরাও!
ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ কিয়েভের পাশাপাশি বেশ অস্থির করে তুলেছে মস্কোকেও। যুদ্ধের কারণে গোটা বিশ্বই যেন ‘অস্থির-অস্থিতিশীল’ হয়ে উঠেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ বিশ্বের প্রায় সব নেতার অবস্থাই নাটকের রাজার মতোÍশান্তি নেই মুকুট পরিহিত সম্রাটের মনে!
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে লক্ষ্য করে ক্রেমলিনে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পক্ষ থেকে ব্যর্থ ড্রোন হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ করেছে রাশিয়া। গত বুধবার ভোর রাতে মস্কোয় দুটি ড্রোন ভূপাতিত করার ঘটনার পর রাশিয়া অভিযোগ করে, এ হামলার পরিকল্পনা করেছে ওয়াশিংটন এবং তা বাস্তবায়ন করেছে ইউক্রেন। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ অভিযোগ করেন, ‘ক্রেমলিনে ড্রোন হামলা চালিয়ে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে হত্যার চেষ্টা করে কিয়েভ। ক্রেমলিনের আকাশে উড়ে আসা ড্রোন দুটি ভূপাতিত করে রাশিয়ার বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী। প্রেসিডেন্ট পুতিন ঐ সময় তার ক্রেমলিনের বাসভবনে ছিলেন না।’ স্বাভাবিকভাবেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে কিয়েভ ও ওয়াশিংটন। যদিও আলোচনা থেমে নেই।
ইউক্রেনের তরফ থেকে পালটা অভিযোগের তীর ছুড়ে বলা হয়েছে, আক্রমণের ঘটনাটি রাশিয়ার সাজানো। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, ‘আমার দেশ এরকম কোনো হামলা চালায়নি।’ জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পডোলিয়াককে বলতে শোনা গেছে, ‘রাশিয়ার বিভিন্ন স্থানে যেসব ড্রোন ওড়ানো হচ্ছে তা স্থানীয় প্রতিরোধ-যোদ্ধাদের গেরিলা কর্মকা-।’ যে আক্রমণকে প্রেসিডেন্ট পুতিনকে হত্যার জন্য চালানো সন্ত্রাসী হামলা বলে দাবি করছে রাশিয়া, তাকে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছে ওয়াশিংটন। যাহোক, ক্রিমলিনে ড্রোন হামলার জের ধরে রুশ কর্মকর্তারা ইতিমধ্যেই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ গ্রহণ করা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। অযাচিত কিছু ঘটলে ছাড় না দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে কিয়েভও। অর্থাৎ, আগামী দিনে ইউক্রেন যুদ্ধের হাত ধরে বড় ধরনের ভয়াবহতা ও বিশ্বব্যাপী তীব্র অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিয়েভ, জাপোরিঝিয়া, ওডেসাসহ ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি শহরের ওপর রুশ বাহিনী হামলা ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এমনকি জাপোরিঝিয়ার পারমাণবিক কেন্দ্রের আশপাশের এলাকা থেকে বাসিন্দাদের সরে যেতে দেখা যাচ্ছে! লড়াই-প্রতিরোধ চলছে বাখমুতেও। সব মিলিয়ে যুদ্ধের ক্ষেত্র আরো বড় হচ্ছে। এর ফলে স্বভাবতই বাড়ছে অস্থিরতা বৃদ্ধির শঙ্কা, যা ইউক্রেনের সঙ্গে সঙ্গে ভোগাবে পুতিনকেও।
ক্রেমলিনে ড্রোন হামলার ঘটনার পর বিভিন্ন মহল থেকে নানমুখী আলোচনা চলছে। কেউ বিষ্ময় প্রকাশ করছেন, কেউবা একে আখ্যায়িত করছেন ‘বোকামি কাজ’ হিসেবে। অনেকেই অবাক হচ্ছেন এই ভেবে যে, খোদ প্রেসিডেন্ট পুতিনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতটা দুর্বল! লন্ডনভিত্তিক রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মাইকেল ক্লার্ক বলেছেন, ‘কিয়েভ যদি এই আক্রমণ চালিয়ে থাকে, তাহলে তা নিঃসন্দেহে মস্ত বড় বোকামি। কারণ, এতে যুদ্ধে তাদের পরাজয়ই ত্বরান্বিত হবে।’ ক্লাক আরো বলেন, ‘রাশিয়ার ভেতরে এ ধরনের আক্রমণ চালালে ইউক্রেন পশ্চিমা সমর্থন হারাতে পারে এবং পশ্চিমা সমর্থন হারালে এ যুদ্ধেও নিশ্চিতভাবে তারা হারবে’। তবে অধ্যাপক ক্লার্ক এমনটাও মনে করেন, অন্যের ওপর দোষ চাপানোর জন্য হয়তো এরকম ‘ফলস ফ্ল্যাগ’ আক্রমণ হতে পারে কিংবা এই হামলা চালিয়ে থাকতে পারে কোনো ‘ফ্রিল্যান্স’ যোদ্ধাও। বিবিসির বিশ্লেষক উইল ভারনন অবশ্য মনে করেন ভিন্ন কথা। মস্কো থেকে তিনি জানান, ‘এই ড্রোন হামলা যদি সত্যিই পুতিনকে লক্ষ্য করে চালানো হয়ে থাকে, তবে তা ক্রেমলিনের জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। এবং বলতে হবে, তাদের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।’
আগামী দিনে পুতিনের জন্য চিন্তার আরো বড় কারণ হলো, নিজের বাহিনীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ কেবল বাড়ছেই। এর ফলে পুতিনের দুর্দশা আরো বাড়াবে বই কমবে না। ইতিমধ্যে পুতিনের ভাড়া করা যুদ্ধবাজ বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের ইয়েভজেনি প্রিগোজিন বাখমুতের রণক্ষেত্র ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছেন। পর্যাপ্ত গোলাবারুদ সরবরাহ না করার জন্য দোষারোপ করেছেন তিনি। যুদ্ধরত বাহিনীর কাছ থেকে এমন হুঁশিয়ারি পুতিনের জন্য স্বাভাবিকভাবেই কোনো সুখের সংবাদ নয়। পুতিনের চিন্তার আরো কারণ, সম্প্রতি রাশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় আরো বেশ কয়েক দফা ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছে! অর্থাৎ, রাশিয়ায় বাড়ছে ড্রোনের আঘাত!
মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, গত বুধবার রাতে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে দুটি তেল শোধনাগার লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালানো হয়। ঐ ঘটনায় দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলার কারণে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়েছে। শুধু রাশিয়ার মাটিতে ড্রোন আছড়ে পড়ছে, এমনটা নয়। ইউক্রেনে রাশিয়া-অধিকৃত এলাকাতেও ড্রোনের আঘাত হানার ঘটনা বাড়ছে ক্রমশ। সম্প্রতি রাশিয়া-অধিকৃত বিভিন্ন অঞ্চলে সন্দেহজনক ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত মাসে ইউক্রেন সীমান্ত থেকে ৪০০ কিমি ভেতরে কিরেইয়েভস্ক শহরে একটি ড্রোন গুলি করে নামানোর পর বিস্ফোরণে কমপক্ষে তিন জন আহত হন।
ফেব্রুয়ারি মাসে মস্কোর ১০০ কিলোমিটার দূরে গুবাস্তোভো নামক একটি গ্রামে বিধ্বস্ত হয় একটি ড্রোন। স্থানীয় গভর্নর সে সময় বলেছিলেন, এটা ছিল বেসামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালানোর চেষ্টা। ভেঙে পড়া ড্রোনটি দেখে মনে হয়, এটি ছিল ইউজে টুয়েন্টিটু জাতীয় একটি ড্রোন। ইউক্রেনে উৎপাদিত এ ধরনের ড্রোন ৮০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে।’ হামলার ঘটনা ঘটে গত বছরের ডিসেম্বরেও। ঐ মাসে ইউক্রেন সীমান্তের ৬০০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এক বিমানঘাঁটিতে ড্রোন হামলার কথা জানায় রুশ সামরিক বাহিনী, যাতে নিহত হন তিন জন। বলে রাখা দরকার, উপরি-উক্ত আক্রমণগুলোর কোনোটিরই দায় নেয়নি ইউক্রেন। সরকারিভাবে তো নয়ই, আলোচনা, বক্তৃতায়ও এসব ঘটনার দায় স্বীকার করে কোনো কথা বলেননি ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ। তবে কিয়েভের সামরিক বাহিনী বলেছে যে, রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর হামলার জবাবে পালটা আক্রমণের প্রস্তুতির একটি অংশ হিসেবে এ ধরনের আক্রমণগুলো বেশ কাজে দিচ্ছে। এর ফলে রাশিয়ার সরঞ্জাম আনা-নেওয়ার ক্ষমতা খর্ব হচ্ছে।
সত্যি বলতে, ড্রোন হামলার ঘটনা বেশ ভোগাচ্ছে রাশিয়াকে। রুশ মিডিয়ার বিভিন্ন খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত রাশিয়া ও রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনীয় ভূখ-ের ভেতরে ২০টিরও বেশি ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছে। আক্রমণগুলো ঘটেছে বিশেষ করে রাশিয়ার ব্রিয়ানস্ক ও বেলগোরদ এবং রুশনিয়ন্ত্রিত ক্রিমিয়া ও এর রাজধানী সেভাস্তপোলে। এসব হামলার লক্ষ্য ছিল তেল স্থাপনা, বিমানঘাঁটি ও রেললাইন। তবে সে যাই হোক, একবারে ক্রেমলিনকে টার্গেট করে ড্রোন হামলা চালানোর সাহস ইউক্রেন যুদ্ধকে আরো উসকে দিয়েছে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার পক্ষ থেকে বড় ধরনের হামলার আশঙ্কা ভাবাচ্ছে ইউক্রেনকে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির মতোই শান্তি উবে গেছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের মন থেকেও। যেমনটি বলা হয়েছে লেখার প্রথম অংশেÍঘুম নেই মুকুট-সম্রাট পুতিনের চোখে! ( সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক) লেখক : সিএনএনের মতামত বিভাগের (সিএনএন অপিনিয়ন) ব্যবস্থাপনা সম্পাদক,সিএনএন থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com