অবশেষে ২৬ এপ্রিল শি জিনপিং ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে বহু প্রতীক্ষিত ফোনে আলাপচারিতা বা ফোনালাপ হয়েছে। উঁচুস্তরের এই জাতীয় আলাপচারিতার বিষয়বস্তু গোপন রাখা হয়, তবে চীনা বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত শি-জেলেনস্কি ফোনালাপের ‘রিডআউট’-এ ইতিবাচক স্বর অনুভব করা যায়।
প্রেসিডেন্ট শি নন, স্বয়ং জেলেনস্কি শি-কে ফোন করেছিলেন এবং ফোন করার পূর্বে জেলেনস্কি ওয়াশিংটনের সঙ্গে পরামর্শ করেননি, ফলে বাইডেনের বৈদেশিক নীতি-বিষয়ক দল খুব বিরক্ত হয়েছে। ৯০ মিনিট স্থায়ী আলাপচারিতায় শি রুশ ভাষার অনুবাদকের সাহায্য নেন। আপাতদৃষ্টে মনে হয় যে ইউক্রেনীয় ভাষা জানে, এমন একজন চীনা অনুবাদককে খুঁজে পাওয়া যায়নি! সম্ভব? কে জানে! অথবা হতে পারে যে যদিও ডনবাসসহ সারা ইউক্রেনে রুশ ভাষা ও রুশ সম্পর্কিত সবকিছু বেআইনি বটে তবে জেলেনস্কির মাতৃভাষা ইউক্রেনীয় নয় বলে রুশ ভাষায় স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারবেন চিন্তা করে রুশ অনুবাদক রাখা হয়। আবার হয়তো-বা রাশিয়ার সঙ্গে ‘নো লিমিট’ সমন্বিত সহযোগিতার বিষয়টি ইউক্রেনকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
যাহোক, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের ওপরে চীন যে বারো পয়েন্টের পজিশন পেপার প্রকাশ করে তার বরাত দিয়ে শি জেলেনস্কিকে সরাসরি বলেন যে ‘শান্তি আলোচনার পথকে সহজতর মসৃণ করতে চীন মুখ্য ভূমিকায় থাকবে’; এবং ডায়ালগ ও আলোচনাই হলো সমাধানের একমাত্র পথ। চীন-ইউক্রেন সম্পর্ক প্রসঙ্গে শি বলেন যে ৩১ বছরের বিকাশ উন্নয়ন ও সঞ্জীবনী দিনগুলো দুই দেশকে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও সহযোগিতার প্রশ্নে, জেলেনস্কির একাধিকবার ইতিবাচক ভূমিকার প্রশংসা করেন শি, এবং গত বছর (২০২২) ইউক্রেন থেকে চীনা নাগরিকদের নিরাপদ অপসারণে সহযোগিতার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানান। বলেন যে, চীন-ইউক্রেন সম্পর্ক পারস্পরিক সার্বভৌমত্ব ও ভূখ-ীয় অখ-তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের উপরে প্রতিষ্ঠিত। দুই পক্ষকেই ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে বিবেচনা ও নাড়াচাড়া করতে হবে ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সততার ঐতিহ্যসহ চীন-ইউক্রেন সম্পর্ককে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপের দিকে নিয়ে যেতে হবে।
ইউক্রেনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রশ্নে চীন পূর্বাপর একই রকম রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিকাশ যেমনই হোক না কেন, ইউক্রেনের সঙ্গে চীন পারস্পরিক হিতকর সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। অর্থাৎ জেলেনস্কিকে শি চমৎকার অফার দিচ্ছেন, জেলেনস্কির দায়িত্ব হলো ‘সুযোগটি লুফে নেওয়া এবং রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য সন্তোষজনকভাবে দরকারি শর্তাবলি সৃষ্টি করা। অবশ্য, চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)’-এ ইউরোপের যে কয়টি দেশ যোগ দিয়েছে, সেই তালিকায় ইউক্রেনও অন্তর্ভুক্ত। এই সুবাদে ২০১৪ সাল থেকে কিয়েভে ‘বিআরআই’-এর বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সেন্টার ছিল। এই প্রজেক্টের অধীনে বেশ কিছু উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালিত হয়। যেমন :মারিউপলে ও মিকোলায়েভে, (খাদ্যশস্য প্রেরণের জন্য শেষোক্ত স্থানে বর্তমানে পোর্ট টার্মিনাল নির্মিত হয়েছে) সূর্যমুখী বীজের প্রসেসিং কমপ্লেক্স। ২০১৭-২০১৮ সালে, কিয়েভের মেট্রো সিস্টেমের চতুর্থ লাইন, ‘হুয়াভেই’-এর ফোর-জি সংস্থাপনের কাজ ইত্যাদি শুরু হয়। তাছাড়াও, কিয়েভ যেমন চীন থেকে মূলত মেশিনারি, যন্ত্রপাতি, গাড়ি, রাসায়নিক দ্রব্য ইত্যাদি আমদানি করত, চীনে কিয়েভ রপ্তানি করত খাদ্যদ্রব্য, ধাতু এবং কিছু মেশিনারি। কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও সেমিকনডাক্টর (চিপ) উৎপাদনে ব্যবহারের জন্য মোট নিয়োন গ্যাসের অর্ধেকটা আসত মারিউপল ও ওডসায় অবস্থিত দুটো ইউক্রেনীয় কোম্পানি থেকে। বেইজিং ছিল কিয়েভের উঁচু স্তরের বাণিজ্য পার্টনার। ২০২২ সালে রুশ স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন শুরু হলে সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়।
সাম্প্রতিক কালে, এক এক করে ইউরোপীয় নেতাদের বেইজিং ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে শি জেলেনস্কিকে বলেন যে ‘ইউক্রেন সংকট জটিলতর দিকে বিকশিত হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক ল্যান্ডস্কেপে তার গুরুতর অভিঘাত পড়তে বাধ্য’। জেলেনস্কিকে তিনি চীনের বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের ইউরেশিয়া বিষয়ক দপ্তরের ডিপুটি ডিজি ‘লি হুই’কে ইউক্রেনে প্রেরণের প্রতিশ্রুতি দেন, যার কাজ হবে ইউক্রেন সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পার্টিগুলোর সঙ্গে গভীর যোগাযোগ রাখা। প্রতিশ্রুতিমতো চীন লি হুই-এর মতো অভিজ্ঞ জনকে ইউক্রেনে পাঠিয়েছে। লি হুই চীনের অভিজ্ঞতম ইউরেশিয়াবিদদের একজন, উচ্চপদস্থ কূটনীতিক হিসেবে তিনি দীর্ঘ ১০ বছর ক্রেমলিনে কর্মরত ছিলেন। তিনি ইউক্রেন ও রাশিয়া সম্বন্ধে গভীরভাবে পরিচিত, স্লাভদের মন-মানসিকতার সঙ্গে সম্যক পরিচিত এবং রুশ ভাষায় পারদর্শীও বটে।
চীনের কাছে ইউক্রেনের মূল্য হলো ‘বিআরআই’-এর ‘সংযোগস্থল’ হিসেবে। ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য বাণিজ্য এবং বৃহত্তর পরিসরে, পূর্ব ইউরোপের ও পশ্চিম চীনের মধ্যে ‘কানেকটিভিটি করিডর সংযোগগুলো’র সৃষ্টি ব্যাহত হচ্ছে। চীনের বৈদেশিক নীতির অপরিহার্য ভিত্তি হলো ‘বিআরআই’ কনসেপ্ট। আবার, রাশিয়া-চীন সমন্বিত কৌশলগত পার্টনারশিপের তথা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে (চীনের ভূরাজনীতি) ‘বিআরআই’ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত।
রুশ-চীন লিডারশিপ চালিত ‘ব্রিক্স’ (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা)-কে অর্থনৈতিক ক্লাব বলা যায়; নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) নামে এর নিজস্ব ব্যাংক আছে একটি (বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশ এই ব্যাংকের সদস্য)। ব্রিক্স মূলত বাণিজ্য নিয়ে কাজ করে থাকে। সাংহাই কো-অপারেশন সংস্থার কাজ হলো নিরাপত্তা সম্পৃক্ত কর্মকা-। অর্থাৎ ব্রিক্স হলো সফট পাওয়ার, এবং দ্বিতীয়টি হলো হার্ড পাওয়ার। এই দুই সংস্থা একত্রে বহুপাক্ষিক পন্থা বিকাশে নিয়োজিত রয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন ইন্টেলিজেন্সের ফাঁস হওয়ার ঘটনা (এবং ইতিপূর্বে সেইমুর হার্শের নর্ডস্ট্রিম রিপোর্ট) ওয়াশিংটনে গভীর অভ্যন্তরীণ বিভেদের সৃষ্টি করেছে এবং ‘স্থায়ী অবস্থা’ নিয়ে অবস্থান করছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে জমকালো পিআর সমৃদ্ধ ইউক্রেনের বসন্তকালীন অফেনসিভ না ঘটার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসটিজের হ্রাসকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু নিয়ো-কন (জারভেটিভ) দল এই বিশ্লেষণকে তীব্র ভাষায় অসত্য বলে প্রতিপন্ন করছে। নিয়ো-কনদের দাবি হলো যে ইউক্রেনীয়দের আক্রমণের মুখে রুশ বাহিনীর মধ্যে যে নিয়ন্ত্রণবিহীন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে তাতেই তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ‘কলাপস’ করবে। তাদের এই দাবি প্রমাণিত হয়নি। যাহোক, এই অত্যুৎসাহী দল কিন্তু সমাধান দেয়নি যে ন্যাটোর যদি রাশিয়াকে পরাজিত করার মতো সামরিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপাসিটি না থাকে সেই সংস্থা কেমন করে তবে সম্মিলিত রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে সাফল্যের সঙ্গে লড়াই করবে? বস্তুত, নিয়ো-কনদের যুদ্ধজ্বরের প্রচ-তা রাশিয়া ও চীনকে সামরিক সখ্য স্থাপনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। (অর্থোডক্স) ইস্টারের সময় চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর তিন দিনব্যাপী মস্কো ভ্রমণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে চীন ও রাশিয়া নিশ্চিত যে যুদ্ধের আশঙ্কাকে মোটেই আর অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না এবং তা মোকাবিলা করার প্রস্তুতি দরকার।
সবশেষে, চীনের মধ্যস্থতায় পরিচালিত আলোচনাকে যুক্তরাষ্ট্র তার ইউক্রেন স্ট্র্যাটেজির প্রতি বিরাট চৈনিক আঘাত হিসেবে বিবেচনা করতে পারে, এবং শি-জেলেনস্কি আলোচনা যদি আরেকটি ‘সৌদি-ইরান’ ঘটনার জন্ম দেয়, তবে ওয়াশিংটনকে ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হবেÍএমন পরিস্থিতিকে এড়াতে জেলেনস্কির ওপরে ‘কাউন্টার অফেনসিভ’ জাতীয় কিছু ঘটানোর চাপ আসতে পারে বলে যারা ভাবছিলেন, তাদের জেলেনস্কি ক্রেমলিনে ব্যর্থ ড্রোন আক্রমণ উপহার দেন। লেখক: ইউরোপ প্রবাসী, ভূরাজনীতি বিশ্লেষক