রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনে পূর্বাঞ্চলীয় শহর বাখমুতের দখল নিয়েছে রুশ সেনারা। তার এই দাবি সঠিক হলে গত গ্রীষ্মের পর রুশবাহিনীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য হবে তা। নয় মাসের বেশি সময় ধরে চলমান যুদ্ধে রুশ ও ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে সবচেয়ে দীর্ঘ ও রক্তাক্ত লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে বাখমুতের লড়াই। ইউক্রেন দাবি করেছে, এখনও তারা শহরটির প্রান্তে কয়েকটি ভবনের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে তারা যে স্বীকারোক্তি দিয়েছে তাতে শহরটি মোটামুটি রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাশিয়ার বাখমুত দখল করা হবে তাদের বিধ্বস্ত সেনাবাহিনীর জন্য কয়েক মাসের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য। প্রশ্ন হচ্ছে, বাখমুতের লড়াইয়ে প্রকৃত অর্থে কে জয়ী হয়েছে? সমরবিদরা বলছেন, এই বিষয়টি শুধু বিধ্বস্ত শহরটির নিয়ন্ত্রণ কার হাতে রয়েছে তা দিয়ে নির্ধারণ করা যাবে না। বরং যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায় দ্বারা নির্ধারিত হবে।
বাখমুতের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষার জন্য লড়াই করেছে ইউক্রেনীয় সেনারা। তারা রুশ সেনাদের ক্লান্ত করে তুলেছে। একই সময়ে তারা রাশিয়ার দখলকৃত ভূখ- পুনরুদ্ধারের জন্য পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছে। লড়াইয়ে শহরটির ইউক্রেনীয় সেনারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে কিয়েভ প্রতিরক্ষার জন্য অতিরিক্ত ইউনিট মোতায়েন করলে।
শহরটি দখলের লড়াইয়ে উঠে এসেছে মস্কোর যুদ্ধের লক্ষ্য কতটা সীমিত হয়ে পড়েছে। রুশ সংবাদমাধ্যম যুদ্ধের শুরুতে উল্লেখ করেছিল, তাদের সেনবাহিনী কিয়েভের শাসকদের উৎখাত করতে চায়। কিন্তু সম্প্রতি তারা বাখমুতের প্রতিদিনের লড়াইয়ের তথ্য তুলে ধরা শুরু করেছে। এমনকি প্রতিটি ভবন দখলের কথাও সংবাদ আকারে প্রকাশ করা হচ্ছে। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে কিয়েভের সেনারা শহরের পশ্চিামাংশে অবস্থান নিয়ে সীমিত পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে। এতে তারা কিছু সাফল্যও পেয়েছে। গত শনিবার রুশ ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিন বলেছেন, তারা শহরটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। রুশ আক্রমণের নেতৃত্বে রয়েছে ওয়াগনারের যোদ্ধারা। শহরটিতে গত কয়েক দিন ধরে লড়াই মূলত পশ্চিমাংশের বহুতল ভবন থাকা এলাকায় সীমিত ছিল। এলাকাটি ‘প্লেন’ নামে পরিচিত। কারণ শহরের প্রবেশ পথে একটি সোভিয়েত যুদ্ধবিমান দাঁড়িয়ে রয়েছে। গত রবিবার ওয়াগনার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, তার যোদ্ধারা রাশিয়া ত্রিরঙা ও ওয়াগনার গ্রুপের কালো রঙের পতাকা বাখমুতের পশ্চিমাংশের একটি বিধ্বস্ত ভবনে ছাদে উড়াচ্ছে। পেছনে দেখা যাচ্ছিল ফসলের মাঠে কামানোর গোলার ধ্বংসযজ্ঞ। দুই পতাকা নাড়িয়ে ওয়াগনারের এক যোদ্ধা ‘জয়’ বলে চিৎকার করছিলেন। ইউক্রেনের উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী হান্না মালিয়া শনিবার দাবি করেছিলেন, ইউক্রেনীয় সেনারা এখনও কয়েকটি শিল্প ও অবকাঠামো স্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করছে। গত রবিবার ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় শাখার মুখপাত্র কর্নেল সেরহি চেরেভাতি বলেছেন, তাদের সেনারা এখনও কিছু স্থানের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের কিনারায় সুরক্ষিত অবস্থান নিয়েছে। তিনি বলেন, শহরটি ধ্বংস হয়ে গেছে। সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে এর কোনও গুরুত্ব নেই। আমরা শুধু চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছি, যাতে করে তারা স্থির হতে না পারে এবং ধারণা করতে না পারে কোথায় পাল্টা আক্রমণ হবে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার নিয়মিত সেনাবাহিনী ও ওয়াগনার গ্রুপকে বাখমুত ‘মুক্ত’ করার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। শহরটিকে রাশিয়া ও দেশটির সংবাদমাধ্যম সোভিয়েত আমলের নাম আর্টিমোভস্ক হিসেবে তুলে ধরছে। জাপানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, এটি দুঃখজনক, একটি ট্র্যাজেডি। কিন্তু আজ বাখমুত শুধু আমাদের হৃদয়ে। শহরটি দখলে রাশিয়ার দাবি অস্বীকার করেছেন তিনি। জেলেনস্কি বলেছেন, আপনাদের বুঝতে হবে, শহরটিতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। তারা সবকিছু ধ্বংস করে ফেলেছে, কোনও ভবন নেই।
কয়েক মাস ধরে শহরটি রক্ষায় লড়াই করা ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রশংসা করেছেন তিনি। বলেছেন, ইউক্রেনের সেনা সদস্যরা বাখমুতে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সামরিক অভিযান বাস্তবায়ন করছে। এই বিষয়ে বিস্তারিত না জানালেও তিনি দাবি করেছেন, আজ পর্যন্ত রাশিয়া বাখমুত দখল করতে পারেনি। তিনি বলেছেন, এই শব্দগুলোর দুটি বা তিনটি ব্যাখ্যা হতে পারে না। বাখমুতের পতনের দাবি সঠিক হলে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের সবচেয়ে দীর্ঘ ও রক্তাক্ত লড়াইয়ের অবসান হবে। সম্প্রতি হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, বাখমুতে ২০ হাজার রুশ সেনা নিহত হয়ে থাকতে পারে। কিছু দিন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি বলেছেন, ওয়াগনার গ্রুপের প্রায় অর্ধেক যোদ্ধা নিহত হয়েছে। ইউক্রেন নিজেদের সেনা নিহতের কথা জানায়নি। তবে তারাও ব্যাপক প্রাণহানির স্বীকার হয়েছে। সূত্র: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল