মা বাবার হাত ধরেই মূলত চা গাছের সাথে পরিচয় তার। বয়স যখন ৯ বছর তখন থেকেই চা পাতা উত্তোলন(চয়ন) করেন উপলক্ষ্মী ত্রিপুরা। তাঁর মা ও বাবাসহ পূর্বের তিন পুরুষের ধারাবাহিকতায় উপলক্ষ্মী ত্রিপুরাও ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন একজন চা শ্রমিক। ১৯৭৮ সালে নেপচুন চা বাগানের শ্রমিক পল্লিতেই জম্ম উপলক্ষির। মা বাবা পছন্দ করে নাম রেখেছিলেন উপলক্ষ্মী। তার পৃথিবীতে আসার উপলক্ষটাই এখন স্বার্থক হয়েছে বলে মনে করেন তিনি নিজেই। ১৯৭৮ এ জম্মের নয় বছর পর ১৯৮৭ সালেই শুরু তাঁর চা পাতার সাথে মিতালি। একটি দু’টি পাতা উত্তোলন করতে করতে এখন হয়ে গেছেন দেশ সেরা পাতা উত্তোলন কারী (চয়নকারী)। গত ৪ জুন চা দিবস উপলক্ষে সারাদেশে সেরা চা পাতা চয়নকারী হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রীর হাত থেকে দেশ সেরার পুরস্কার গ্রহন করেন উপলক্ষ্মী ত্রিপুরা। তাঁর দেশ সেরা হওয়ার পিছনের গল্প জানতে গিয়েছিলাম উপলক্ষ্মীর কর্মস্থল ফটিকছড়ির নারায়ণহাট ইউনিয়নে অবস্থিত নেপচুন চা বাগানে। খুঁজতে খুঁজতে তাঁর দেখা মিলে বাগানের ১৩ নং ব্লকে। দেশ সেরা হলেও একদিনের জন্যও বন্ধ নেই উপলক্ষির চা পাতা উত্তোলন বা চয়ন করা। সেরা হওয়ার আনন্দে অন্যান্য শ্রমিকরাসহ দ্বিগুন উৎসাহে চা পাতা তুলছেন তিনি। তাঁর গত এক বছরের চা পাতা চয়নের রেকর্ডে রয়েছে ঘন্টায় প্রায় ৭৮ কেজি পাতা উত্তোলন বা চয়ন। উপলক্ষ্মীর চা পাতা উত্তোলনের মাঝে রয়েছেন এক ধরনের ছন্দ। কাজের ফাঁকেই কথা হয় তাঁর সাথে। সেরা হওয়ার পিছনে কি যাদু এমন প্রশ্ন করা হলে উপলক্ষি বলেন, ‘তাঁর কাছে বেশী পাতা উত্তোলনের জন্য বিশেষ কোন যাদু নেই’। তিনি বলেন, ছোট বেলায় মা বাবার সাথে চা বাগানে প্রবেশ। ৯ বছর বয়সে চা পাতার সাথে তাঁর মিতালি। উপলক্ষি বলেন তাঁর সব সময় চা পাতাকে নিয়েই ভাবনা। কিভাবে দু’টো পয়সা বেশী পাবেন সেজন্য চেষ্টা করেন একটু অন্যদের চেয়ে বেশী চাপাতা উত্তোলনের। এ জন্য তাঁর চিন্তা চেতনা ধ্যান সব কিছু চা পাতা কেন্দ্রিক। একাগ্রতা আর চা পাতার প্রতি ভালবাসা থেকেই তিনি পৌছে গেছেন সর্বোচ্চ স্থানে। নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠির হতদরিদ্র পরিবারে জম্ম হওয়ার কারণে নিজে তেমন পড়া লেখা করতে পারেননি উপলক্ষ্মী। নিজের সংসার জীবনের দারিদ্রতার কষাঘাতে বড় মেয়েকেও পাড়েননি স্কুলের সর্বোচ্চ গন্ডি পার করাতে। কিন্তু এখন তিনি বদ্ধ পরিকর তাঁর বাকী তিন ছেলে মেয়েকে শিক্ষিত করতে। মা বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই জলভরা চোখে উপলক্ষ্মী বলেন, তাঁর শ্রেষ্ঠ্যত্বের পুরস্কারটি প্রয়াত মা বাবাকেই উৎসর্গ করলেন তিনি। তবে দিন শেষে তাঁর সেরা হওয়ার পিছনে নেপচুন চা বাগানের মালিক, সকল কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ তাঁর কাজের সহকর্মী শ্রমিকদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান উপলক্ষ্মী। অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি পড়ালেখা করিনি। আমার জন্ম, বড় হওয়া বিয়ে সবই এই চা বাগানে। ছোটবেলা থেকেই এখানে কাজ করছি। কাজ করতে করতেই দ্রুত চা পাতা তোলার কাজ শিখেছি।’ নেপচুন চা বাগানের ১৭ নং সেক্টরের সর্দারনী প্রণতি মজুমদার বলেন, ‘আমাদের উপলক্ষ্মী ত্রিপুরা চা পাতা তুলে দেশসেরার পুরষ্কার পেয়েছে। এ জন্য আমরা অনেক খুশি! আমরা গর্বিত। আমরা চায় সে আরও সফল হোক। যাতে আমাদের সর্দার, বাবু, সাহেব ও নেপচুন চা বাগানের অনেক নাম হবে। এছাড়াও সর্দারনী প্রণতি মজুমদার চা শ্রমিকদেরকে যথাযত মুল্যায়ন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীসহ চা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান।’ নেপচুন চা বাগানের বাগানের ডেপুটি ম্যানেজার রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘এক বছরে তিনি উত্তোলন করেছেন ২৮ হাজার ৩৪৪ কেজি চা পাতা; যা তাকে এনে দিয়েছে ‘জাতীয় চা পুরস্কার’। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ চা বোর্ডের এ পুরস্কার পেয়েছেন উপলক্ষী ত্রিপুরা। পুরস্কার হিসেবে চা বোর্ডের পক্ষ থেকে এক ভরি ওজনের সোনার ক্রেস্ট ও সনদ দেওয়া হয়েছে। আট ক্যাটাগরিতে দেওয়া পুরস্কারের মধ্যে একমাত্র চা শ্রমিক হিসেবে ‘শ্রেষ্ঠ চা পাতা চয়নকারী’র সম্মাননা পেলেন উপলক্ষ্মী ত্রিপুরা। ডেপুটি ম্যানেজার রিয়াজ উদ্দিন আরও বলেন, পুরস্কারের জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনীত হওয়ার পর উপলক্ষ্মীকে পূনরায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। আবারো চা বোর্ডের টিমের কাছে পাতা উত্তোলনের পরীক্ষা দিতে হয়। সে পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হন তিনি। সেদিন উপলক্ষী এক ঘণ্টায় ৪৯ দশমিক ৯০ কেজি চা পাতা উত্তোলন করে নিজের শ্রেষ্ঠ্যত্বের প্রমান দিয়েছেন। তিনি বলেন, শ্রেষ্ঠ চা পাতা চয়নকারী (উত্তোলনকারী) হিসেবে আমাদের বাগানের এই শ্রমিক চা বোর্ডের পুরস্কার পাওয়ায় বাগানের সবাই গর্বিত। মূলত বাগানের মালিক, কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের সমন্বিত করার প্রচেষ্টার ফল এটি। এ ছাড়া নেপচুন চা বাগান কর্তৃপক্ষ সব সময় শ্রমিকের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। জানা যায়, উপলক্ষী ত্রিপুরার এক ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে দুইজন ইস্পাহানী গ্রুপের মালিকানাধীন এ নেপচুন চা বাগানে কাজ করেন। তার স্বামী বিশু কুমার ত্রিপুরাও চা বাগানের শ্রমিক। তার ছোট তিন মেয়ে বাগানের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। মেজ মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, চতুর্থ জন স্থানীয় বিদ্যালয়ের নবম এবং ছোট মেয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। পড়ালেখা করা তিন সন্তানের ভবিষ্যৎ যেন সুন্দর হয় এটি এখন উপলক্ষির একমাত্র প্রত্যাশা।