শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫১ পূর্বাহ্ন

ব্যস্ততার শেষ নেই মাধবদীর কামারপাড়ায়

আল আমিন (মাধবদী) নরসিংদী :
  • আপডেট সময় বুধবার, ২১ জুন, ২০২৩

আর মাত্র কয়েকদিন পরই পবিত্র ঈদুল আযহা। আর এ ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মাধবদী থানা এলাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন হাট-বাজারের দা, চাকু, কুড়ালসহ লোহার যন্ত্র তৈরির কারিগররা। দিনের শেষে রাতেও বিরাম নেই এ কারিগরদের। নির্ঘুম রাত পার করছে এ কারিগররা। শুন-শান আর ট্যুং-ট্যাং শব্দে মুখরিত এখন মাধবদীর কামারশালাগুলো। কামারদের এই ব্যস্ততা জানান দিচ্ছে ঈদুল আযহা অতি সন্নিকটে। গত বুধবার রাতে মাধবদী পৌর শহরের গরুর হটের বৃহৎ কামারশালা কামারপট্টি এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কেউ হাতুড়ি দিয়ে লোহা পেটাচ্ছে, কেউ হপার টানছে অথবা তৈরী করা সামগ্রীতে শান (ধার) দিচ্ছে। কোরবানীর পশুর চামড়া ছাড়ানো থেকে শুরু করে গোস্ত কাটার কাজে ব্যবহার করা হয় কামারশালার বিভিন্ন শৈল্পিক সামগ্রী। মাধবদী গরু বাজারের ও সদর উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারের কামার পট্টির কারিগরদের যেন ব্যস্ততার শেষ নেই। অধিকাংশ দোকানেই নিজেদের তৈরী যন্ত্রপাতি বিক্রি করা হচ্ছে। তৈরী করা এসব দা, বটি, চাকু, কুড়াল কিনতেও দেখা গেছে অনেক ক্রেতাদের। তবে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীও রয়েছেন, যারা শুধু ঈদের সময়ই এ ব্যবসাটি করে থাকে। অন্যান্য সময়ের চেয়ে ঈদুল আযহার সময় কর্মব্যস্ততা বেড়ে যায় কামার পট্টিতে। কারণ ঈদুল আযহার সময় পশু কোরবানিকে কেন্দ্র করে প্রচুর পরিমানের দা, চাকু, বঁটি আর চাপাতির জোগান দিতে হয় এ কর্মকারদের। ঈদে শুধু চাকু বা চাপাতি দিয়েই কাজ শেষ হচ্ছে না। বছরের প্রায় সব সময়ই এ পণ্যের চাহিদা থাকলেও ঈদের সময়টিতে চাহিদা একটু বেশি থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে নতুন পণ্য সামগ্রী ক্রয়ের চেয়ে অনেকেই পুরনো দা, বটি, ছোড়া, চাপাতি (সান) ধার করিয়ে নিতেই পছন্দ করেন। এজন্য আবার মৌসুমী শান কারিগর বাড়ি বাড়ি গিয়ে বঁটি শান করে থাকেন। মাধবদীতে ভ্রাম্যমান শান কারিগর না থাকলেও ঈদুল আযহা উপলক্ষে বিভিন্ন জেলা থেকে ভ্রামমান শান দেয়ার লোকের সমাগম হয়েছে। স্থায়ীভাবে যে ক’টি দোকান রয়েছে, সেখানেও অনেকে নিয়ে আসছেন তাদের পুরনো দা, বঁটি শান করাতে। প্রায় ২৫ বছর ধরে এ লোহার যন্ত্রপাতি তৈরি করছেন মাধবদী আনন্দী মহল্লার যতিন্দ্র কর্মকার। এছাড়া মাধবদী, শেখেরচর, পাঁচদোনা, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, আলগীসহ আশপাশের হাট বাজারগুলোতে রয়েছে যতিন্দ্র কর্মকারের মতো অনেক কর্মকার। পূর্বপুরুষের পেশা হিসেবে যতিন্দ্র কর্মকারের মতো অনেকেই যুক্ত আছেন এ পেশায়। কর্মকার বাবুল দাস বলেন, প্রতিদিন দুই-তিন হাজার টাকা আয় হয়। তবে আমাদের মূল টার্গেট থাকে কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে। বেচাকেনা এখনো পুরোপুরি শুরু না হলেও প্রচুর পরিমাণে অর্ডার আসা শুরু হয়েছে। তাই তো কর্মব্যস্ততাও বেড়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রবীণ এ কর্মকার। গত বছরের তুলনায় এবার ঈদে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে বলে জানান তিনি। কোরবানিকে কেন্দ্র করে বেশি অর্ডার আসছে চাপাতি, দা, বঁটি, ছুরি, কুড়ালসহ পশু কোরবানি সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির, বললেন সাথে থাকা জগদীস কর্মকার। তিনি বলেন, কাজের চাপ বেশি থাকলেও কয়লার সমস্যার কারণে কাজের ক্ষতি হচ্ছে। কাজ এগোচ্ছে না। যন্ত্র তৈরীর জ্বালানি কয়লার দামও বাড়তি। গত ঈদে এক বস্তা কয়লার দাম ছিল ১ হাজার টাকা আর এবার তা আমাদের কিনতে হচ্ছে ৩ হাজার টাকায়। যা একদিনেই শেষ হয়ে যায়। গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতেই এখন গ্যাস ব্যবহার হয় তাই কয়লা পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় আমাদের ঢাকা থেকে অতিরিক্ত দাম দিয়ে কয়লা কিনে আনতে হচ্ছে। পাশের দোকানের দীপক দাস কর্মকারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লোহার এসব যন্ত্রপাতির কাঁচামাল কিনতে হয় ঢাকা শহরের নয়াবাজার, ধোলাইখাল থেকে যার মূল্য পড়ে কেজি প্রতি দেড় থেকে দুই’শ টাকা পর্যন্ত আর একটু ভালো মানের স্প্রীং লোহা কিনতে গেলে ২৫০/৩০০ টাকা হয়ে থাকে। এক কেজি লোহা থেকে তৈরি একটি দা বিক্রি হয় ৪৫০ বা ৫০০ টাকায়। ঈদ মৌসুমে গত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন কামারশালা ঘুরে দেখা গেছে, বড় ছুরি, ছোট ছুরি, চামড়া ছাড়ানোর ছুরি, চাপাতি ও বটি দা‘র চাহিদাই সবচেয়ে বেশী। শহরের কামারপট্টির এক দোকানী বিশ্বনাথ কর্মকার বলেন, হুজুররা গরু জবাইয়ের জন্য ১৮ ইঞ্চি ছুরি ব্যবহার করেন। ঈদের সময়ে এটাই চলে বেশি। জনৈক ক্রেতা জানান, এবার প্রতিটি কামার শিল্পের দাম গতবারের তুলনায় অনেক বেশী। তবে কামারেরা বলছেন তার উল্টো। তারা অভিযোগ করে বলেন, লোহার দাম এবং কয়লার দাম বেশি হওয়ায় মজুরি খরচ বাদ দিয়ে তেমন কিছুই থাকে না। এই পেশায় পরিশ্রমের চেয়ে বেতন কম। দিন-রাত সারাক্ষণ আগুনের পাশেই বসেই কাটাতে হয়। সে তুলনায় আমরা অনেক কম দামেই এসব বিক্রি করছি। কামারেরা আরও জানান, এভাবে যদি লোহা ও কয়লার দাম বাড়তেই থাকে তাহলে এ পেশাকে টিকিয়ে রাখাই কঠিন হবে। এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাপ-দাদার কাছ থেকে এই কাজ শিখেছি। অন্য কাজ শিখিনি। তাই এই পেশা ছেড়ে দেয়ার কোন উপায় নেই। এটা শুধু কামারদের শংকা নয়, বাস্তবতা কিন্তু তাই প্রমাণ করে। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা দেশের ঐতিহ্যবাহী এ পেশাটি ধীরে ধীরে বিলুপ্তই হয়ে যাচ্ছে।
আশির দশকেও গ্রামগঞ্জের যেখানে সেখানে কামারশালা দেখা যেত। কিন্তু এখন আর এগুলো সচারাচর চোখে পড়েনা। এর প্রধান কারণ, শারীরিক ক্ষতি, অধিক পরিশ্রম, উপযুক্ত মজুরী না পাওয়া এবং সর্বপরি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। তবে প্রতি বছর কোরবানীর ঈদ এলেই কিছুটা কদর বাড়ে কামারদের। এরপর থেকে বছরের অবশিষ্ট দিনগুলোতে অধিকাংশ কামারেরাই থাকেন প্রায় কর্মহীন। যেকারণে অভাব অনটনেই চলছে দরিদ্র কামারদের জীবন সংসার। হচ্ছেনা তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন। ফলে অনেক কামারই তাদের এই আদিপেশা ছেড়ে বেছে নিচ্ছেন বিকল্প পেশা। ঐতিহ্যবাহী এ পেশাটি বিলুপ্ত হওয়ার আগেই এর পৃষ্টপোষকতা প্রয়োজন বলে মনে করছেন মাধবদীর অভিজ্ঞ মহল।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com