সংকট কাটাতে বিভিন্ন ব্যাংক এখন ৯.৫০% সুদেও আমানত নিচ্ছে। পরিস্থিতি এমন যে ব্যাংকগুলো প্রকল্প ঋণ বিতরণ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির দায় মেটাতে ব্যাংকগুলো মার্কিন ডলার কেনার চাপে আছে। সে জন্য নগদ টাকায় রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কেনার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে একটিকে অন্যটির কাছ থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারও এখন উচ্চ সুদে টাকা ধার করছে।
ফলে ব্যাংকগুলোতে টাকা, তথা তারল্য নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে। সংকট কাটাতে সাড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদেও আমানত নিচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক। তবে সংকটে পড়া শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো ১৫ শতাংশ সুদেও তহবিল সংগ্রহ শুরু করেছে বলে শোনা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাংকঋণের সুদহার যতটা বেড়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে আমানতের সুদ। এরপরও ব্যাংকগুলো কাঙ্ক্ষিত আমানত পাচ্ছে না। ব্যাংকে টাকার টানাটানি সামলাতে প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার সহায়তা বা ধার দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই চিত্র গত সপ্তাহের।
আমানতের সুদহার সাড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে তারল্যে চাপ আরও কিছুদিন থাকবে। এই সময়ে নতুন বিনিয়োগ হবে না, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে সার্বিক অর্থনীতিতে। এদিকে তীব্র তারল্য-সংকটের পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। বিশেষ করে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারা নতুন কোনো প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে না। সুদহার বাড়ানোয় ভোক্তাঋণ বিতরণও কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনাই এখন সরকারের প্রধান লক্ষ্য। এ জন্য ঋণের সুদহার বাড়িয়ে টাকাকে দামি করা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতির ওপর। আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ কত হলো, আবার সুদহারই-বা কোথায় গেল, সেটা এখন বিবেচ্য নয়।
সরকারের ঋণের সুদ বেড়েছে: সরকার ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো থেকে টাকা ধার করে। এতে বেড়েছে সুদহার। ১৩ নভেম্বর সরকার ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ৩ হাজার ৩০ কোটি টাকা তুলেছে, যেখানে সুদহার ছিল ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ। একই দিন ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার ছিল ৯ দশমিক ৯০ থেকে ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। সেদিন ৬৪৭ কোটি টাকা তোলে সরকার। ৭৮২ কোটি টাকা তোলা হয় ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে, যার সুদহার ছিল ১০ থেকে ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া ১৫ নভেম্বর ৫ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদহার ছিল ১০ দশমিক ৯৯ শতাংশ। সেদিন সরকার বন্ডের মাধ্যমে ৮১৬ কোটি টাকা তুলেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, ট্রেজারি বিলের সুদহার ১২ শতাংশ পর্যন্ত উঠতে পারে। এতে ঋণের সুদহারও বাড়বে। লক্ষ্য, মূল্যস্ফীতি কমানো।
আমানত ও ঋণ পরিস্থিতি: ট্রেজারি বিলের সুদহারের ভিত্তিতে এখন ব্যাংকঋণের সুদের হার নির্ধারিত হচ্ছে। যে পদ্ধতিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে, সেটাকে বলা হয় স্মার্ট বা সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল। প্রতি মাসের শুরুতে এই হার জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি নভেম্বর মাসের জন্য স্মার্ট রেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো সাড়ে ৩ শতাংশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাড়ে ৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদহার বাড়াতে পারে। ফলে ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
ঋণের সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ও তারল্যে টান পড়ায় আমানতের সুদহার বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৯ শতাংশ। সংকটে পড়া কোনো কোনো ব্যাংক আরও বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। এরপরও চাহিদামতো আমানত পাচ্ছে না বেশির ভাগ ব্যাংক। গত আগস্ট-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে মাত্র ৫ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা, একই সময়ে ঋণ বেড়েছে ১৯ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা।
এদিকে তারল্য-সংকটে পড়ায় শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) রাখতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংককে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি অন্য ব্যাংকগুলোকে রেপো বা বিশেষ সহায়তা হিসেবে টাকা ধার দিয়ে যাচ্ছে। এভাবে ১২ নভেম্বর ১৭ হাজার ৭৭৪ কোটি, ১৩ নভেম্বর ১৩ হাজার ৩৭৭ কোটি, ১৪ নভেম্বর ১৫ হাজার ৪৯৬ কোটি ও ১৫ নভেম্বর ১৯ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা দিয়েছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলার ক্রয় ও সরকারের ঋণের কারণে নগদ টাকায় টান পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাহিদামতো নগদ জমা রাখার জন্য এখন আগের চেয়ে বেশি তারল্য সহায়তা দিচ্ছে। আমানতের সুদহার সাড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে তারল্যে চাপ আরও কিছুদিন থাকবে। এই সময়ে নতুন বিনিয়োগ হবে না, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে সার্বিক অর্থনীতিতে। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমে যেতে পারে। উৎস: প্রথমআলো অন লাইন