দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক, আইনি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পতন ঘটে। বিশ্বব্যবস্থায় অচলাবস্থা চলতে থাকে বছরের পর বছর। এরপর সময় যত গড়িয়েছে, নানাবিধ সংকট থাবা বসিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল সিস্টেমের গায়ে। এমন কথা বলা ভুল হবে না, বিশ্বব্যবস্থার এই ক্ষত সারিয়ে তুলতে না পারার ব্যর্থতার কারণেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো সংঘাতের সাক্ষী হতে হচ্ছে বিশ্বকে। বিশ্বব্যবস্থায় সংকট এতটা গভীরে যে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো চলছে। যুদ্ধাবস্থার কারণে সংকট চলছে আরো বেশ কিছু অঞ্চলে। সাম্প্রতিক সময়ের ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের কথা তো না বললেই নয়।
বর্তমানে যেসব যুদ্ধের অবতারণা ঘটতে দেখা যাচ্ছে এবং আরো যেসব যুদ্ধ বাধার উপক্রম, প্রকৃত অর্থে তার জন্য বেশি করে দায়ী ‘ইউক্রেন যুদ্ধ’। অনেকের দ্বিমত থাকলেও এ কথা সত্য, চলমান এই যুদ্ধ বহু দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির নিয়ন্ত্রণেই ছিল। এই যুদ্ধের নাটাই এখনো এই পক্ষের হাতেই। আবার গাজার যুদ্ধের কথা যদি ধরা হয়, সেখানেও প্রায় সব ক্ষেত্রে এই পক্ষই কলকাঠি নাড়ছে। আরো একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, দুই-দুটি ইরাক যুদ্ধÍপ্রথমে ১৯৯০-৯১ সালে এবং পরেরটা ২০০৩ সালে, বিশ্বরাজনীতির পট পরিবর্তনে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। মূলত এই দুই সংঘাতের পরেই বিশ্বব্যবস্থা ঢুকে যায় অন্ধকার গলিতে। পরবর্তী সময়গুলোতে ধারাবাহিকভাবে যেসব যুদ্ধ-সংঘাত সংঘটিত হয়েছে, তাতে কেবল হাজার হাজার লাশের সারিই প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। মূলত এর মধ্য দিয়েই ওয়ার্ল্ড অর্ডার পরিবর্তিত হতে থাকে একটু একটু করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দিকে তাকালে দেখতে পাব, ঐ সংঘাত ছিল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় একধরনের ‘একমুখী আচরণের বিজয়’ উদ্যাপন। রাশিয়াকে কোণঠাসা করার চিত্রই পরিলক্ষিত হয় এই যুদ্ধের পুরোটা জুড়ে। রাশিয়া ও তার মিত্ররা সম্ভবত আজকের যুগেও তা মাথার মধ্যে নিয়ে চলেছে!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমরা কী দেখতে পাই? এই সংঘাতের পটভূমি আরো রহস্যময়! এক নতুন সিস্টেম গঠনের প্রচেষ্টার ফসল হলো ‘সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড অর্ডার’, যেখানে উদীয়মান শক্তিগুলো মাঠের বাইরে ছুড়ে ফেলার চিন্তা ছিল বিশ্বমোড়লদের মাথায়।
পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধ ইন্টারন্যাশনাল সিস্টেমে পরিবর্তন বয়ে আনবে, এটাই স্বাভাবিক। এই অর্থে পরের দশকগুলোতে এবং সর্বোপরি আজকের বিশ্বে ‘একটি নতুন প্রবণতা’ লক্ষ করছি আমরা। একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে চীন, ভারত এবং কিছু ক্ষেত্রে রাশিয়াকে টার্গেট করে হিসাব করলেই বিষয়টা পরিষ্কার বোঝা যাবে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, নতুন বিশ্বব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বা হচ্ছে মূলত এই একটি কারণেই।
নতুন বিশ্বব্যবস্থা সৃষ্টির পেছনে আরেক কারণ হলো ‘আন্তর্জাতিক ঐকমত্য’। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশে জর্জ ডব্লিউ বুশের একটি বক্ততৃার কথা মনে আছে নিশ্চয়? বুশ একপ্রকার জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘বিশ্বকে অবশ্যই ওয়াশিংটনের সব ধরনের আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে। অন্য সব বিষয়কে অপ্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।’ বুশের এ ধরনের কথা মার্কিন মনোভাব কেবল সেই যুগেই প্রতিফলিত করেনি, আজকের বিশ্বেও তা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একইভাবে। আসলেই বুশের ঐ ঘোষণা অবাক করেছিল বিশ্বকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে তৎকালীন বিশ্বব্যবস্থায় ততটা সন্তুষ্ট ছিল না, বুশের কথায় তা স্পষ্ট হয়। অর্থাৎ, নতুন চুক্তির সন্ধানে ছিল খোদ ওয়াশিংটন নিজেইÍএমন কথা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হওয়ার পরপরই নতুন ব্যবস্থার খোঁজে নামে মার্কিন প্রশাসনগুলো।
অনেকে বলতে পারেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন আধুনিক বিশ্বব্যবস্থা থেকে দূরে সরে যেতে চাইবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত বিশ্বাস দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং পড়ছে। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ চালিয়েও অনেকের আস্থাভাজন হতে পারেনি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট। এর মধ্যে আবার মার্কিন রাজনীতিতে ঢুকে গেছে দুই দল, তথা ডেমোক্র্যাট পার্টি ও রিপাবলিকানদের দুই ধরনের চিন্তাচেতনা। দুই ধরনের রাজনৈতিক স্রোতের মুখে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে অস্তিত্বের প্রশ্নে লড়ছেÍএ কথা অপ্রাসঙ্গিক নয়।
সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আমরা দেখে আসছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানামুখী জটিল সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এক দল (ডেমোক্র্যাট পার্টি) গণতান্ত্রিক মনোভাব বজায় রাখার চেষ্টা করছে তো আরেক দল (রিপাবলিকান) বিচ্ছিন্নতাবাদী রূপের দিকে সরে যেতে চাইছে ক্রমশ। আমেরিকার ইতিহাস বিশ্লেষণে এই হিসাবকে তো ‘জটিল ও কঠিন’ না বলে উপায় নেই!
আমেরিকার ‘ঘরের ঝামেলা’ বিশ্বব্যবস্থায় প্রভাব ফেলবে স্বভাবতইÍবাস্তব চিত্রও তাই। জলবায়ুসংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অবস্থান, ইরানের পারমাণবিক পরিকল্পনা, এমনকি মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত ন্যাটোসহ জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন বেশ কিছু সংস্থা নিয়ে ওয়াশিংটনের ক্রমাগত দোদুল্যমানতা লক্ষ করার মতো। বিভিন্ন ইস্যুর শান্তিপূর্ণ সমাধান কিংবা নতুন চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রেও টানাপোড়েন চলতে দেখা যায় মার্কিন রাজনীতিতে। বাইডেন প্রশাসন বিশ্বনেতৃত্বের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বটে, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ভিন্ন ধারার চিন্তাভাবনায় বিশ্বাসী বলেই মনে হয়। ট্রাম্প সম্ভবত মনে করেন, এ ধরনের নেতৃত্ব দিন শেষে ‘নিরর্থক’। আগামী বছরের নভেম্বরে আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কে ক্ষমতায় আসবেন, তা নিয়ে ইতিমধ্যে দুই শিবিরের মধ্যে লড়াই শুরু হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই নির্বাচনের ফলাফল নতুন বিশ্বব্যবস্থার রূপরেখা নির্ধারণে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। আন্তর্জাতিক আইন, রাজনীতি, বাণিজ্য, যুদ্ধের নিয়মনীতি, তথা আন্তর্জাতিক ঐকমত্যের প্রশ্নে আমূল পরিবর্তর লক্ষ করব আমরা। মস্কো, বেইজিং, ব্রাসিলিয়া, প্রিটোরিয়া, আংকারা এবং বিশ্বের আরো কিছু প্রান্ত থেকে যেভাবে উচ্চকণ্ঠের আওয়াজ শোনা যায় ধারাবাহিকতভাবে, তাতে বেশ ভালোমতোই বোঝা যায়, এগুলো নিছক সাধারণ বিষয় নয়! বিদ্যমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতি ক্রমবর্ধমান হতাশাই এক্ষেত্রে বেশি দৃশ্যমান। এই তালিকায় রাশিয়া রয়েছে সবার ওপরে। সম্প্রতি ‘রাশিয়া কলিং!’ ফোরামে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভাষণ অনেকে শুনে থাকবেন। ঐ ভাষণে ১৫তম বারের মতো তিনি এ কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন, ‘আমরা একটি নতুন মডেল তৈরি করতে চাই। একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ধারা, যেখানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সততা থাকবে, থাকবে সৎ প্রতিযোগিতা। সবাই যেখানে মুখ্য হিসেবে পরিগণিত হবে।’ পুতিনের এ ধরনের কথাবার্তা কীসের ইঙ্গিত বহন করে?
এ বছরের মার্চ মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন মস্কো সফরে যান, তখনো তার মুখে একই ধরনের কথা শুনেছি আমরা। বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘চীন সত্যিকারের বহুপাক্ষিকতাকে সমুন্নত রাখতে রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করবে। একটি বহুমুখী বিশ্ব গড়ার সঙ্গে সহমত পোষণ করবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বৃহত্তর গণতন্ত্রকে উন্নীত করার প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করবে। সর্বোপরি, বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থাকে আরো ন্যায়সংগত করতে সর্বোচ্চ সাহায্য করবে।’ অর্থাৎ, নতুন বিশ্বব্যবস্থা আজকের দিনে আর ‘নতুন আলোচনা’ নয়Íবর্তমান বাস্তবতা এটাই। আন্তোনিও গ্রামসির বিখ্যাত উক্তি এক্ষেত্রে স্মরণ করা যায়, ‘পুরোনো বিশ্ব মারা যাচ্ছে এবং নতুন বিশ্ব জন্ম নেওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে।’
প্রশ্ন উঠতে পারে, এর মানে কি এই যে, উদীয়মান বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সামনে একেবারে নতুন রাজনৈতিক, আইনি ও অন্যান্য কাঠামো তৈরি করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই? এক্ষেত্রে বলতে হয়, বিদ্যমান তথা পুরোনো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে যেভাবে ধারাবাহিক ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে নতুন ব্যবস্থা গড়ে ওঠা কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না। উপরন্তু, নতুন নতুন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর হতে দেখব আমরা। আরো বড় কথা, ‘বিকল্প অর্থনৈতিক প্ল্যাটফরম’ গড়ে উঠতে থাকবে ক্রমাগত। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, পুতিনের সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সফর এবং বেশ কয়েক জন গ্লোবাল সাউথ নেতার মস্কো ও বেইজিংয়ে ছুটে যাওয়ার অর্থ কী? এসব কি বৈশ্বিক রাজনীতির মানচিত্র পালটে যাওয়ার দৃশ্যপট নয়? এ ধরনের ‘তীর্থযাত্রা’ ক্রমবর্ধমান, যা পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তি।
পুরোনো তত্ত্বের আলোকে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ঠিক করার সম্ভাবনাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই বটে, কিন্তু গ্লোবাল নর্থের অন্তর্নিহিত বৈষম্যের মতো বিষয়ের কি সুরাহা হবে এতে করে? যদি বলি, বর্তমান ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়েই বৈশ্বিক বৈষম্যের সমাধান সম্ভব, তবে তা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে বিশ্বনেতৃত্বকেই। বিশ্বনেতারা কি সত্যিকার অর্থেই সমস্যার জুতসই সমাধান টানতে পারছেন? যদি না পারেন, তবে কঠিন বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে হলেও বিকল্প চিন্তা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই তাদের সামনে। উৎস: ইত্তেফাক। লেখক: দ্য প্যালেস্টাইন ক্রনিকলের সম্পাদকগালফ নিউজ থেকে অনুবাদ: সুমৃত খান সুজন