প্রখ্যাত লেখক জর্জ অলওয়েলের সাড়া জাগানো গ্রন্থ অ্যানিমেল ফার্মের তাৎপর্যপূর্ণ একটি উক্তির ভাবানুবাদ করলে এমন হতে পারে। ‘সকল পশুই সমান তবে কিছু পশু অন্যদের চেয়ে কিছু বেশি সমান’। এ বাক্যটি প্রতীকী বা রূপক। বাক্যটির অন্তর্নিহিত বক্তব্যটা যদি মনুষ্য সমাজের দিকে টেনে এনে প্রতিস্থাপন করা হয়, তবে বলা যাবে, সাধারণের চেয়ে কিছু ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি অনেক বেশি সমান। অলওয়েলের কথাটা সম্ভবত উপহাসোচ্ছলেই ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এ অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যাই হোক, এই বক্তব্যকে তত্ত্ব হিসেবে ধরে নিয়ে এর ব্যাখ্যা হতে পারে, সমাজে সবার জন্য আইন-কানুন সমভাবে প্রযোজ্য হওয়াটাই নিয়ম।
তবে কখনো কখনো এ নিয়মের মারাত্মক ব্যত্যয় ঘটানো হয়। সে ক্ষেত্রে আইনকে পাশে ফেলে দিয়ে, ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টির ওপর কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সেটা শুধু মাত্র অমানবিক নয়, অনেক ক্ষেত্রে জিঘাংসার স্তরে পৌঁছে যায়। আবার কখনো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের প্রতি অনুরাগ বা স্বার্থের জন্য সেই আইনটি তাদের মাথার ওপর দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এখানেই অনুরাগ-বিরাগের প্রশ্ন এসে উপস্থিত হতে পারে। বৈষম্যের কথাও স্বাভাবিকভাবে ওঠে আসে। কোনো সুস্থ স্বাভাবিক সমাজের নিয়মনীতি কখনোই এটা হতে পারে না বরং অসুস্থ সমাজের এটি অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য।
এমন বোধটা যদি এখন বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে এনে বিশ্লেষণ করা যায়, তবে বিষয়টা হয়তো এমনটাই দাঁড়াতে পারে। ক্ষমতাসীনরা বা তাদের সুহৃদরা যত কিছুই তথা ভুলত্রুটিই করুক, সেটাই স্বতঃসিদ্ধ, বিশুদ্ধ এবং সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকবে। তাদের সেসব কর্মকা- যদি জনস্বার্থের পরিপন্থীও হয়, আইন-কানুনের ধারে কাছে না থাকে, সেসব নিয়ে সমালোচনার তীব্র ঝড় উঠলেও মাথা ঘামানোরও প্রয়োজন নেই। পক্ষান্তরে তাদের প্রতিপক্ষ সিদ্ধ সরল সহজ পথ ধরে চললেও তাদের তাপে-পাপে জর্জরিত করা হবে বা হচ্ছে। এখন আইনকে বাঁকাপথে নিয়ে নানা ছলচাতুরী করে, প্রতিপক্ষকে জব্দ-স্তব্ধ করা হচ্ছে। নিজেদের নাক কেটে হলেও ক্ষমতাসীন শক্তি প্রতিপক্ষের যাত্রা ভঙ্গ করতে বদ্ধপরিকর। জেল-জুলুম আর নির্যাতন করে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে তাদের ‘ভ্যানিশ’ করে দিতে হবে এমনই তাদের সিদ্ধান্ত। এজন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আইন-কানুন নীতি-নৈতিকতাকে তুচ্ছ অচ্যুত করা হচ্ছে। আজকে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিবেশ পরিস্থিতি এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। অসহিষ্ণুতা তিক্ততা আর চরিত্র হরণের রাজনীতির পরিচর্যা করছে সরকার। সরকারি দলের নেতাদের চলনে বলনে অহমিকা ও অসহিষ্ণুতার চরম বহির্প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। আজ বাংলাদেশ যেন এক শ্বাসরুদ্ধকর জনপদে পরিণত হয়েছে। যে কেউ এসব কথা উচ্চারণ করলে যেকোনো মুহূর্তে বিপদ এসে তার ঘরের দুয়ারের কড়া নাড়তে পারে।
আবার অলওয়েলের সেই তত্ত্বকে যদি আন্তর্জাতিক বলয়ে নিয়ে আসা হয়, তবে দেখা যাবে একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ দেশের জন-আকাক্সক্ষাকে পশ্চিমের যেসব দেশ ইতিবাচকভাবে গ্রহণ ও সমর্থন করছে, তাদের প্রতি ক্ষমতাসীন শক্তির ক্ষোভ উষ্মার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। পক্ষশক্তির ক্ষোভের জাগায়টা হচ্ছে, তাদের ক্ষমতায় থাকার ক্ষেত্রে কেউ যদি এতটুকু ব্যত্যয় সৃষ্টি করতে চায়। সে যেই হোক কোনো আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়া হবে না। কখনো মুগুর মারা বা বাক্যবাণে জর্জরিত করা হবে। বন্ধু সুহৃদ শুধু তাদেরই থাকতে পারে। অন্য কারো নয়। এমন আচরণ বা মনোভাব প্রভুসুলভ হলেও সেটারই চর্চা হবে। এসবকে নিয়ে কাউকে দ্বিচারিতও বলতে দেয়া হবে না। দলযন্ত্র রাষ্ট্র শাসন করবে ভিন্ন কিছু নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, দেশের জন-আকাক্সক্ষা হচ্ছে কেবল মাত্র সঠিকভাবে ভোটাধিকারটা ফিরে পাওয়া। জনতার এই মনোবাঞ্ছনা ক্ষমতাসীন সরকার তাদের সবচেয়ে বড় বিপদ বলে মনে করে। ১৫ বছর ধরে নানাভাবে জনগণের কাছে ঋণী হয়ে আছে ক্ষমতাসীন শক্তি। সুষ্ঠু ভোটে তারা হেরে যাবে এটা নিশ্চিত জেনে, ঋণের কানাকড়ি বুঝিয়ে দিতে হলে কী উপায় হবে। তাই ক্ষমতাসীন শক্তি ভোট নিয়ে হট্টগোল বাধাতে চায়। যাতে হট্টগোলের ভিতর দিয়ে দেশের জন-আকাক্সক্ষা হচ্ছে কেবল তাদের ভোটাধিকারটি ফিরে পাওয়া। জনতার এই মনোবাঞ্ছনাটা ক্ষমতাসীন সরকার তাদের সবচেয়ে বড় বিপদ বলে মনে করে। কেননা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতাসীন শক্তি দেশ ও দেশের মানুষকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করেছে। এমন বঞ্চনা এখন সব সীমা অতিক্রম করেছে। ভোটের অধিকার তাদের ফিরিয়ে দিলে মানুষ তার বঞ্চনার প্রতিটি পাই পাই হিসাব চাইবে। সেজন্য সরকার ভোট নিয়ে যত গোল-হট্টগোল বাধাচ্ছে। সরকারের কৌশল হচ্ছে ভোট নিয়ে হট্টগোল বাধিয়ে একটা চোরাগোপ্তা পথ রচনা করে মসনদে ফিরে যাওয়া। আর সে কারণে তাদের সব প্রতিপক্ষকে লৌহ পিঞ্জরে আটকে রাখা হচ্ছে, যাতে সেই শক্তি ভোট বুভুক্ষু মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে না পারে, লড়াই করতে না পারে। অপর দিকে, গণতন্ত্রের প্রশ্নে এ দেশের মানুষের সুহৃদ পশ্চিমের সেই সব শক্তিকে শুধু উপেক্ষাই করছে না, অকৃতঘেœর মতো আচরণ করছে, মন্দ বকছে। অবাক হতে হয়। পশ্চিমা শক্তি এ দেশের জন-আকাক্সক্ষার পাশে থাকাকে ক্ষমতাসীনরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো বলে অভিহিত করে ঢাকঢোল পেটাচ্ছে।
পক্ষান্তরে সরকারের জুলুম-নির্যাতন ও জনগণের অধিকার হরণসহ সব অপকর্মের যারা বাইরে থেকে বা ভিন্ন ভূখ- থেকে তাদের মদদ দিচ্ছে, সেসব শক্তির প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে সরকার ও তাদের স্নেহভাজন সব ব্যক্তি। অথচ প্রশ্ন তোলা হয় না নিজেদের স্বার্থের জন্য সরকার তার বন্ধুদের নাক গলানো পছন্দ করছে, উপভোগ করছে। অপর দিকে, দেশের বৃহত্তর মানুষের অধিকারের প্রতি বাইরে থেকে যারা সহানুভূতি প্রকাশ করছে, তাদের ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা প্রকাশের কোনো লাগাম নেই। অথচ সরকার এখন তাদের চরম অর্থকষ্টে প্রতিটি দিন এক দুঃসহ যাতনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করছে। যে পশ্চিমকে তারা অহর্নিষ গালমন্দ করছে, তাদের কাছে থেকে অর্থসঙ্কট থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য ধার-কর্জ পেতে হাত বাড়িয়েছে। অথচ এটা কতটা লজ্জার ব্যাপার। তবে ধার পাওয়ার পরও যে সরকারের আর্থিক সঙ্কট কেটে যাবে তা কিন্তু নয়, সামান্য সময়ের জন্য হয়তো অতি সামান্য স্বস্তি আসবে। ওপরে ভোট নিয়ে কিছু কথা বলা হয়েছে। তবে সে ভোট নিয়েও সরকারকে উভয় সঙ্কটে পড়তে হচ্ছে। শাঁখের করাতের মতো এখন তাদের যেতে-আসতে কাটছে। যে দেশে পাখি নেই, সেখানে তেলাপোকাই পাখি হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে প্রকৃত এবং বড় দলগুলো কি এখন খাঁচাবদ্ধ। প্রায় সবাই খাঁচাবদ্ধ। তাই, এখন তেলাপোকাদের নিয়ে দল সাজাতে চাচ্ছে সরকার। তবে এ নিয়েও সরকার সমস্যায় পড়েছে। এই পোকামাকড়দের চাহিদা কিন্তু বিরাট। এখন তাদের চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব চাহিদা পূরণ না হলে কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে এসব পোকামাকড় যদি বেরিয়ে যায়। সে দুশ্চিন্তায় পড়ে ক্ষমতাসীনদের অবস্থা এখন শ্যাম রাখি না কুল রাখি। কোনটাকে যে তারা ধরে রাখতে পারবে সেটা বোধগম্য নয়। ndigantababar@gmail.com