শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১০ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
খেলাধুলার মাধ্যমে মাদককে সমাজ থেকে বিতাড়িত করতে হবে-মাফরুজা সুলতানা মাইলস্টোন কলেজে নবম শ্রেণির বালিকাদের অংশগ্রহণে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত বিদেশি প্রভুদের নিয়ে বিতাড়িত স্বৈরাচার ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে: তারেক রহমান সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সুপারিশ  ‘বিবেচনায় রয়েছে’: বদিউল আলম ১৬ বছর বঞ্চিতদের এবার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বইমেলয় স্টল বরাদ্দের দাবি ইসির অগাধ ক্ষমতা থাকলেও প্রয়োগে সমস্যা ছিল: বদিউল আলম আমাদের শিক্ষা কর্মসংস্থান খোঁজার মানুষ তৈরি করছে, যা ত্রুটিপূর্ণ: প্রধান উপদেষ্টা সেন্টমার্টিন: ‘স্থানীয়দের জীবিকা বনাম পরিবেশ রক্ষা’ আ. লীগ-জাপা নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাবিতে কফিন মিছিল ১৫ বছরের জঞ্জাল সাফ করতে সময় লাগবে: মির্জা ফখরুল

‘একটা মুরগি কেনার মুরোদ নাই, শার্ট-প্যান্ট পরে ভাব দেখাইতে আইছে’

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০২৪

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে ২২ হাজার টাকা বেতনে সহকারী ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করেন মোরশেদ আলম (৪৫)। বাসা ভাড়া, গ্যাস বিল আর বিদ্যুৎ বিল দিতেই বেতনের অর্ধেক টাকা চলে যায় তার। শনিবার (১৬ মার্চ) বিকালে নাজিরাবাজার থেকে সংসারের সদাই কিনতে এসে তীব্র অস্বস্তিতে পড়েন মোরশেদ।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাসায় চাল, তেল শেষ। একটা মুরগিও নিতে বলেছে। দোকানি পোলট্রি মুরগির কেজি চাইলো ২৩০ টাকা। বললাম গত সপ্তাহেও তো ২০০ টাকা ছিল। দাম কমিয়ে রাখো। বললো, ‘দাম প্রতিদিনই বাড়ে। কমাতে পারবো না। আরও দু-এক দোকান দেখেন, একই দাম।’ তখন বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে এক কেজির একটা মুরগি দাও। দোকানদার বললো, ‘এক কেজির কোনও মুরগি নেই। সব দেড় কেজির ওপরে।’ বললাম, ভাই, একটু দেখেন এক কেজি পাওয়া যায় কিনা। দোকানি দুই-তিনটা মেপে বললো, ‘এক কেজি ৪০০ গ্রাম আছে।’ বললাম তাহলে থাক। তখন দোকানি বলে উঠলো, ‘একটা মুরগি কেনার মুরোদ নাই, শার্ট-প্যান্ট পরে ভাব দেখাইতে আইছে।’ কথাটা এখনও আমার কানে বাজছে। এ ছাড়া ৫২ টাকা কেজির চাল ৫০ টাকায় দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার অনুরোধ জানান ব্যবসায়ীকে। সেখানেও তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয় তাকে। পাঁচ-সাতটি দোকান ঘুরেও খোলা সয়াবিন তেল না পাওয়ায় আধা লিটার বোতলের সয়াবিন তেল কিনে কোনোরকমে বাজার শেষ করেছেন তিনি। শুধু মোরশেদ নন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে সব পণ্যই নাগালের বাইরে। দামের এই ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয়ের সঙ্গে ব্যয় ধরতে হাঁসফাঁস অবস্থা নি¤œ ও মধ্য আয়ের মানুষের। কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে বিপণিবিতান, সবখানে জীবন দুর্বিষহ। তবু সংসার চালাতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা ছাড়া উপায় নেই।
আবার চাহিদা বেশি থাকলেও প্রয়োজনীয় পণ্য অল্প পরিমাণে কিনতে বাজারে যান অনেকে। অল্প পণ্য কিনে কোনোভাবে পরিবার চালান তারা। কিন্তু এই অল্প পণ্য কিনতে এসেও অবহেলা ও কটুকথার শিকার হতে হচ্ছে মধ্য ও নিম্নবিত্তদের। বাজার ঘুরে এসব দৃশ্যের দেখা মেলে।

পুরান ঢাকার রায় সাহেব বাজারে দেখা গেছে, জাহানারা বেগম (৩৮) অনেকক্ষণ ধরে ফল বিক্রেতার সঙ্গে দরকষাকষি করছেন। অনেকক্ষণ পর ২৫০ গ্রাম কালো আঙুর ৯০ টাকায় দিতে রাজি হন দোকানদার। কিন্তু যখনই মাপতে গেলেন, তখনই ঘটে বিপত্তি। দোকানদার তাকে আঙুর না দিয়ে অন্য ক্রেতাদের সঙ্গে দরদাম শুরু করেন। শুরু হয় কথা-কাটাকাটি। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই জাহানারা বেগম লেন, আমার পরে তিন জন আঙুর কিনতে এসেছেন। তাদের মধ্যে দুজন দুই কেজি করে, আরেকজন এক কেজি আঙুর কিনলেন। আমি আগেই দোকানদারকে এক পোয়া (২৫০ গ্রাম) আঙুর দিতে বললাম। দোকানদার আমাকে উপেক্ষা করে পরের তিন জনকে আঙুর দিলো। জানতে চাইলে সে আমাকে বললো, ‘আপনার তো কম, আপনি একটু দাঁড়ান, স্যারগোরে আগে দিয়ে দিই।’ তখন আমি বললাম, আমার একটু তাড়া আছে, আমি আগে এসেছি, আমাকে আগে দেন। দুবার বলার পর দোকানদার আমাকে ধমকের সুরে বললো, ‘আরে আপা একটু ধৈর্য ধরেন, নয়তো অন্যদিকে যান। আপনার অল্প জিনিসের জন্য কি আমি দামি কাস্টমার হারাবো?’ ক্ষোভ জানিয়ে জাহানারা বলেন, আমি কি ফ্রিতে দোকানদারের কাছে আঙুর চেয়েছি? ছোট মেয়ের কথা মনে করে আরও খানিকটা অপেক্ষা করে তারপর আঙুর নিলাম।
নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুরই দাম বেশি মন্তব্য করে এই গৃহিণী বলেন, তেল, পেঁয়াজ এক পোয়া বা আধা কেজি কিনতে গেলে দোকানদার মুখের তাকায়, তারপর বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে। আর যদি দোকানে কাস্টমার বেশি থাকে, তাহলে সবার শেষে সদাই দেয়। টাকা দিয়ে পণ্য কেনার পরও প্রতিনিয়তই আমাদের এমন কটুকথা শুনতে হয় শুধু পরিমাণ অল্প বলে। একটা বিষয় লক্ষ করলাম, যারা ভিক্ষা করে দোকানে দোকানে, তাদের সঙ্গে আরও সুন্দর ও সাবলীল কথা বলে দোকানিরা। আমরা অল্প জিনিস কিনতে গেলেই নাক সিটকায়।
জাহানারা বেগমের মতো এমন অসংখ্য মানুষ অল্প পণ্য কিনতে এসে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে কটুকথার শিকার হন, হয়তো হতেও হবে। নিত্যদিনের এসব ঘটনায় কষ্টে থাকা মানুষ ঝগড়া না করে নীরবে সহ্য করে চলে যান। মনসুর আলী (৪২) সচরাচর মাছ-মাংস না কিনলেও রোজা আসার পর থেকে চেষ্টা করেন সেহরিতে পরিবারসহ ভালো-মন্দ খেয়ে রোজা রাখার। এ জন্য পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজারের কাঁচাবাজারে মাছ কিনতে এসেছেন তিনি।
তিনি বলেন, আমার ছয় সদস্যের পরিবার। তিন ছেলে মেয়ে, স্ত্রী ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে বুড়িগঙ্গার ওপারে (কেরানীগঞ্জ) থাকি। এখানে ইসলামপুরে কুলিগিরি করে যা পাই, তা দিয়েই সংসার চালাই। আজ বাজারে এসেছি মাছ কিনতে। পকেটে আছে ৪০০ টাকা। মাছ ছাড়াও আরও জিনিস কিনতে হবে। দোকানদারকে সব মাছের দাম জিজ্ঞেস করলাম। দেখলাম হিসাবে মিলছে না। সব মাছের দাম অনেক বেশি। পরে ১০০ টাকার ছোট মাছ কিনেছি। অনেকের ভিড়ে মাছ বিক্রেতা কয়েকবার বলার পরও আমার কথা কানে নেয়নি। কারণ সবাই কমবেশি দুই-তিন পদের কয়েক কেজি করে মাছ কিনেছেন। আমি কয়েকবার ১০০ টাকার পুঁটি মাছ দিতে বলায় খুব বিরক্তির সঙ্গে মেপে দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তার পাশের দোকান থেকে আধা কেজি মুরগির পা, মাথা, ঘিলা-কলিজা কিনেছি ৬০ টাকা দিয়ে। দেখলাম কলিজায় কালো দাগ পড়ে গেছে। এমন দাগ কীসের, জানতে চাইলে দোকানদার আমাকে গলা উঁচিয়ে বললো, ‘আরে বেটা নিলে নে, নয়তো যা‌। এই জিনিস নেওয়ার মানুষের অভাব নাই।’ ছেলেমেয়ের কথা চিন্তা করে কোনও কিছু না বলেই নিয়ে নিলাম। প্রতিনিয়ত নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের এমন অল্প পরিমাণে পণ্য কিনতে এসে বেশ অস্বস্তিতে পড়তে হয়। অবশ্য দোকানদাররা এই বিষয়টিকে অস্বীকার করে অন্যভাবে উপস্থাপন করছেন। তাদের দাবি, অল্প কিনুক আর বেশি কিনুক, সবাই আমাদের জন্য ক্রেতা। আর ক্রেতারা হচ্ছেন দোকানদারের লক্ষ্মী। তবে ক্ষেত্রবিশেষে দোকানের স্টাফরা কিছুটা বিপত্তি ঘটায় বলে স্বীকার করেছেন দোকানদাররা।
পুরান ঢাকায় আলিফ রহমান নামে এক দোকানি বলেন, ছোট দোকানের ক্ষেত্রে এমনটা সুযোগ নেই। ছোট দোকানিরা যারাই আসুক তাদের সঙ্গে সবসময় ভালোভাবে কথা বলে। কিন্তু বড় দোকানের ক্ষেত্রে যখন কাস্টমারের অনেক বেশি চাপ হয়, তখন হয়তো যার পণ্যের পরিমাণ বেশি, তাকে আগে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে যারা অল্প পরিমাণে জিনিসপত্র কিনতে আসেন, তাদের অপেক্ষা করতে হয়। এ জন্য তারা কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হন। এদিকে দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ ও সিন্ডিকেটের কাছে সরকার পণবন্দি বলে প্রতিনিয়তই সরকারকে উপহাস করছেন বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা। তবে সরকারদলীয় লোকজনও জোর দাবি জানাচ্ছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুরান ঢাকায় আওয়ামী লীগের পদধারী এক নেতা বলেন, আমি জন্মের পর থেকেই আওয়ামী লীগের সাপোর্ট করি এবং সূত্রাপুর থানার একজন পদধারীরা নেতা। তা সত্ত্বেও আমি বলছি, সরকার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। ফলে দেশের মানুষের দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই। সরকার উন্নয়ন করেছে, এ কথা যেমন কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, তেমনি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ, এটাও অস্বীকারের সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ জনগণ কিছু চায় না। তারা চায় শুধু চায় জিনিসপত্রের দাম যেন কমে। সরকার যদি শুধু এই একটা কাজ করতে পারে, তাহলে জনগণের ভোগান্তি কমবে। জনগণের আর কোনও চাওয়া থাকবে না।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com