সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত-মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়। চরিত্রই হলো তার প্রকৃত বা আসল পরিচয়।
মানুষের জীবনাচরণ ও চিন্তাধারায় যে ভাব পরিলক্ষিত হয়, তাই চরিত্র। চরিত্র মানুষের মহার্ঘ্যতম বস্তু। শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার। চরিত্র মানুষকে ন্যায়, সংযম ও শ্রদ্ধাবোধ শিক্ষা দেয় এবং সৎপথে চলতে উদ্বুদ্ধ করে। মূলত চরিত্র বলতে মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছুকেই বুঝায়। তবে সচ্চরিত্র মানুষের অর্জন করতে হয়। এ অর্জন এক দিনে সম্ভব নয়।
মানুষ তার জীবনপ্রণালীর ধারাবাহিকতার মধ্যদিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এটি অর্জন করে থাকে। যিনি চরিত্রবান তিনি কখনো সত্য থেকে স্খলিত হন না। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না, ক্রোধে আত্মহারা হন না। কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেন না। তিনি সবসময় মানুষকে ভালোবাসার চোখে দেখেন। সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সূত্র ধরেই শিশুর চরিত্র গঠিত হয়। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী স্কুলের সহপাঠী ও খেলার সাথীদের সাথে মিশে তার চরিত্রের রূপ বিকশিত হয়।
পারিপার্শ্বিক অবস্থা মানবচরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যে যেরূপ পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে বাস করে তার চরিত্র সেভাবেই গঠিত হয়। এ জন্য এসব ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। চরিত্র সাধনার ধন আর সংসার প্রলোভনময়। পাপের হাজারো প্রলোভন মানুষকে বিপথে চালিত করতে সর্বদাই সচেষ্ট। আত্মসংযমের মধ্যদিয়ে সব প্রলোভনকে দমন করে মানুষকে সঠিক পথে চলার চেষ্টা করতে হয়। যার মনোবল দৃঢ় নয়, সে চরিত্র লাভের উপযোগী নয়। সে মানবসমাজে অধম। সভ্য জগতে তার কোনো স্থান নেই।
আমরা হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনাচরণকে চরিত্র গঠনের সঠিক নমুনা হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘চারিত্রিক সৌন্দর্য ও গুণাবলির পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি।’ মানুষের চারিত্রিক পবিত্রতা অর্জন করার ব্যাপারই ছিল মহানবী সা: প্রেরণার মূল উদ্দেশ্য। গোটা বিশ্বের কাছে হজরত মুহাম্মদ সা: তাঁর কথা ও কাজ দ্বারা উন্নত ও উত্তম চরিত্রসমূহের এক নমুনা তুলে ধরেছেন। জীবনের সব ক্ষেত্রে তার বাস্তব জীবনের গুণাবলিকে আঁকড়ে থাকার উপদেশ দান করেছেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম যে চরিত্রের দিক থেকে উত্তম।’ প্রত্যেক চরিত্রবান ব্যক্তির চরিত্রে একটি বিশেষ ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। আর সেটিই হলো চরিত্রের বলিষ্ঠতা।
কোনো মানুষ যদি সমাজে শ্রদ্ধাভাজন হয়, তা সে চরিত্রের জন্যই হয়ে থাকে। চরিত্রবান ব্যক্তি সত্য কথা বলতে কোনো ভয় পায় না। চরিত্রবান ব্যক্তি আত্মমর্যাদা ও জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে থাকেন। মিথ্যা ও পাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে তিনি ভয় পান না।
রাসূলুল্লাহ সা: আব্দুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি প্রধানকে (যার উপাধি ছিল আশাজ্জ) সম্বোধন করে বলেছিলেন, ‘নিঃসন্দেহে তোমার মধ্যে এমন দু’টি প্রশংসনীয় সৌন্দর্য বিদ্যমান যা আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। একটি হলো ব্যক্তিত্ব আর দ্বিতীয়টি হলো শিষ্টাচার।’
কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা হজরত লুত আ:-এর সম্প্রদায়ের অশ্লীলতা, চারিত্রিক অধঃপতন ও তাদের ওপর নেমে আসা ভয়াবহ শাস্তির কথা আলোচনা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে- ‘অবশেষে যখন আমার হুকুম এসে পৌঁছল, তখন আমি ওই জনপদের উপরকে নিচে করে দিলাম এবং তার উপর স্তরে স্তরে পাথর বর্ষণ করলাম।’ (সূরা হুদ-৮২)
চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষা করার ক্ষেত্রে ইসলাম অনেক গুরুত্বারোপ করেছে। যেসব কারণে মানুষের চারিত্রিক কলুষতা তৈরি হয়, সেগুলোকে নিষিদ্ধ করেছে। তারপরও কেউ যদি অপকর্মে লিপ্ত হয় তাহলে তার কঠিন শাস্তির বিধান দিয়েছে। চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষায় ইসলামের দিকনির্দেশনা নি¤œরূপ :
দৃষ্টি অবনত রাখা : নারী-পুরুষ উভয়ের দৃষ্টি সংযত রাখা। দৃষ্টিপাতের মাধ্যমেই সূত্রপাত হয় অনেক পাপাচারের। তাই নারী-পুরুষ প্রত্যেকে নিজের দৃষ্টি অবনত রাখতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আপনি মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। ঈমানদার নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে।’ (সূরা নূর : ৩০-৩১)
বেগানা নারী-পুরুষ নির্জনে একত্রিত না হওয়া : বেগানা নারী-পুরুষ একান্ত নির্জনে একত্রিত হলে শয়তান তাদের ওপর আক্রমণ করে কুকর্মে লিপ্ত করে। একাকী ঘরে পর্দার আড়ালে হলেও নির্জন বাস শরিয়তে নিষিদ্ধ। হাদিস শরিফে নবী করিম সা: ইরশাদ করেন, ‘কোনো পুরুষ যেন কোনো বেগানা নারীর সাথে একান্তে গোপনে অবস্থান না করে। কারণ, শয়তান উভয়কে অশ্লীলতার জঘন্যতম গুনাহের কাজে লিপ্ত করবে।’ (মিশকাত শরিফ-৩১৮৮)
অন্য হাদিসে হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- নবীজী সা: বলেন, ‘মাহরামের বিনা উপস্থিতিতে কোনো পুরুষ কোনো নারীর সাথে সাক্ষাৎ করবে না। এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার স্ত্রী হজ করার জন্য বেরিয়ে গেছে এবং অমুক অমুক জেহাদে অংশগ্রহণের জন্য আমার নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। নবীজী বললেন, ফিরে যাও এবং তোমার স্ত্রীর সাথে হজ সম্পন্ন করো।’ (বুখারি-৫২৩৩)
কোমল কণ্ঠে কথা না বলা : নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি আল্লাহ তায়ালা একটি আকর্ষণবোধ সৃষ্টি করেছেন। এর কারণে নারী-পুরুষ যখন পরস্পরের সান্নিধ্যে আসে তখন উভয়ের মনে কুবাসনা জাগ্রত হয়। মোম যেমন আগুনের স্পর্শে এলে গলে যায়, নারী-পুরুষ একত্রিত হলেও শয়তান তৃতীয়জন হয়ে তাদেরকে অশ্লীল কাজের প্রতি আহ্বান করে।
এ জন্য আল্লাহ তায়ালা নারী ও পুরুষের মধ্যে পর্দার বিধান দিয়েছেন। পুরুষের সাথে মোলায়েম কণ্ঠে কথা না বলা, দৃষ্টি অবনত রাখা, শরীরের সৌন্দর্য প্রকাশ না করা ইত্যাদি। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না। ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে।’ (সূরা আহজাব-৩২)
সৌন্দর্য প্রকাশ না করা : নারীর মধ্যে আল্লাহ তায়ালা কমনীয় সৌন্দর্য দান করেছেন। নারীর সৌন্দর্য শুধু স্বামীর জন্য। স্বামীর সামনেই যাবতীয় সৌন্দর্য প্রকাশ করবে। পরপুরুষের সামনে তা প্রকাশ করা মানে হলো অশ্লীলতার পথ খুলে দেয়া। আল্লাহ তায়ালা নারীদের উদ্দেশে বলেন- ‘তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে। মূর্খ যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না।’ (সূরা আহজাব-৩৩)
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নারীকে নিজেদের ঘরে অবস্থান করতে বলেছেন এবং বাইরে ঘুরে সৌন্দর্য প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন। লেখক : বিশিষ্ট আলেম ও প্রবন্ধকার