কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে এক দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রআন্দোলন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মন্ত্রীসভার সব সদস্যের পদত্যাগ দাবিতে আগামীকাল রোববার সারাদেশে সর্বাত্মক অসহযোগ শুরু হবে বলে সমাবেশ থেকে ঘোষণা দেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
শিক্ষার্থীদের এক দফা ঘোষণাপত্রে যা বলা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবির ঘোষণাপত্র পাঠ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গত শনিবার (৩ আগস্ট) বিকেলে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ছাত্র-জনতার সমাবেশে এই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, যেহেতু বর্তমান সরকারের নির্দেশে নির্বিচারে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। নারী-শিশু-ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক কেউ এই গণহত্যা থেকে রেহাই পাননি।
যেহেতু, সরকার এই হত্যাযজ্ঞের বিচার করার পরিবর্তে নির্বিচারে ছাত্র-জনতাকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করছে।
যেহেতু, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হত্যাযজ্ঞ সংঘটন করেছে। যেহেতু, ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক-মজুরসহ আপামর জনগণ মনে করছে, এই সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ বিচার ও তদন্ত সম্ভব নয়। সেহেতু, আমরা বর্তমান স্বৈরাচারী সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করছি। একইসঙ্গে সবার নিকট গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি গ্রহণযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানাচ্ছি। এ সময় নাহিদ ইসলাম বলেন, যদি ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ জারি হয়, আমরা মেনে নেব না। এখন ছাত্র-জনতার এগিয়ে আসতে হবে। আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে অসহযোগ আন্দোলন পালন করবেন। সরকার যদি জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, এটা জনগণ মানবে না। আপনারা যদি অস্ত্র চালান, তাহলে প্রতিরোধ হবে।
ক্ষমা চাওয়ার সময়ও পার হয়ে গেছে : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মোঃ নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘সরকারের কাছে বিচার চাওয়া বা সংলাপে বসারও সুযোগ আর নেই। ক্ষমা চাওয়ার সময়ও পার হয়ে গেছে।’ টেলিগ্রামে দেয়া এক বার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘যখন সময় ছিল তখন সরকার ব্লক রেইড দিয়ে শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করেছে, নির্যাতন করেছে। আখতার হোসেন, আরিফ সোহেলসহ রাজবন্দীদের কারাগারে রেখে আমরা কোনো ধরনের সমঝোতায় যাবো না।’ তিনি লিখেছেন, ‘১৯শে জুলাই আমরা কারফিউ ভঙ্গ করে শাটডাউন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছিলাম। আমাদের সে বক্তব্য কোনো মিডিয়ায় প্রচার করতে দেওয়া হয় নাই। সে রাতে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম অত্যাচার করা হয় এ ঘোষণার জন্য এবং আন্দোলন প্রত্যাহার ও সরকারের সাথে আলোচনায় বসার জন্য জবরদস্তি করা হয়।’ নাহিদ বলেন, ‘ছাত্রজনতা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিল৷ সরকার দমন-পীড়ন করে সেটিকে সংঘাত ও সহিংসতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। কারফিউ ও ইন্টারনেট বন্ধ করে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এবার এরকম পরিস্থিতি হলে কারো জন্যই পরিণতি ভালো হবে না।’
নাহিদ ইসলাম লিখেছেন, ‘পরবর্তীতে ডিবি অফিস থেকেও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দফতরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আমাদের অনশন ও রাজপথে আন্দোলনের কারণে সে পরিকল্পনা সফল হয়নি।’
‘আমরা এখনো শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখতে চাই। আমরা কোনো সহিংসতা, প্রতিহিংসা ও প্রাণনাশ চাই না৷ নিরাপত্তা বাহিনীকেও এরজন্য সহযোগিতা করতে হবে। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের রাজপথে দেখা গেলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে এর দায়ভার নিতে হবে’, লিখেছেন নাহিদ ইসলাম।
‘তবে রক্ত ঝড়লে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। আমরা ন্যায়বিচার ও জীবনের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। গণজোয়ার তৈরি হয়েছে। কোনো ধরনের দমন-পীড়ন, প্রোপাগা-া ও ষড়যন্ত্র করে এ আন্দোলন থামানো যাবে না,’ নাহিদ ইসলাম।
ঢাকার পয়েন্টে পয়েন্টে বিক্ষোভ-অবস্থান: রাজধানীর আফতাবনগর, বাড্ডা, রামপুরা, বনশ্রী, মিরপুর-১০ ও সায়েন্সল্যাব, শহীদ মিনারে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। শনিবার সকাল থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা এ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেন তারা। আফতাবনগরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা কর্মসূচিতে অংশ নিতে জড়ো হয়েছেন কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শনিবার সকাল সাড়ে ১১টা থেকে রামপুরার আফতাবনগরের জড়ো হন তারা। এ সময় ব্যাপক পুলিশ সদস্যের অবস্থানও লক্ষ্য করা যায়। কয়েক হাজার শিক্ষার্থী রাজধানীর বাড্ডা রামপুরা সড়কে অবস্থান নিয়েছেন। এ সময় বাড্ডা থানার অর্ধশতাধিক পুলিশ রাস্তা থেকে সরে গেছে।
বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ইউআইটিএস ও সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অংশ নিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, এদিন সকাল সাড়ে ১১টা থেকে শিক্ষার্থীরা অবস্থান শুরু করেন। পরে ১১টা ৫০ মিনিটে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী একযোগে ৯ দফা দাবি আদায়ে স্লোগান দেয়া শুরু করেন।
তারা বলেন, ‘নয় দফা আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরবো না। দেশজুড়ে আমাদের ভাই-বোনদের হত্যা করা হয়েছে। সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এই হত্যাকা-ের বিচার চাই।’
বনশ্রী বি ব্লকের সামনে আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষার্থী অভিভাবকরা বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। এ সময় তারা বিভিন্ন স্লোগন দিতে থাকেন। এছাড়া সায়েন্সল্যাবে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’, ‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’সহ নানা স্লোগান দিচ্ছেন তারা। সায়েন্স ল্যাব মোড়ে সকাল থেকে অনেক পুলিশ সদস্যকে অবস্থান করতে দেখা গেছে।
এদিকে রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে অবস্থান নিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। দুপুর ১২টার দিকে বিক্ষোভকারীরা সেখানে জড়ো হতে শুরু করেন। পরে দুপুর ১টার দিকে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্রে করে সহিংসতায় নিহতদের স্মরণ করে ‘আমার ভাই মরল কেন’সহ বিভিন্ন শ্লোগান দেন বিক্ষোভকারীরা। রাজধানীর শনির আখড়ায় সড়কে অবস্থান নিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তারা নানা ধরনের স্লোগান দিচ্ছেন। রায়েরবাগ, যাত্রাবাড়িতে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
উল্লেখ্য, সারা দেশে আজ শনিবার বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গতকাল শুক্রবার রাত পৌনে ৮টার দিকে ফেসবুক লাইভে এই কর্মসূচির ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান।
একইসঙ্গে আগামীকাল রোববার থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন তারা। ‘সারা দেশে ছাত্র-নাগরিকের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা করে খুনের প্রতিবাদ ও ৯ দফা’ দাবিতে এই কর্মসূচির ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।