করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের খবরের প্রভাব রফতানি বাণিজ্যে পড়তে শুরু করছে। দেশে কভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয় চলতি বছরের ৮ মার্চ। এরপর টানা এক মাসের মতো নিষ্ক্রিয় ছিল রফতানিমুখী কারখানাগুলো। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোতে জানুয়ারি থেকে সংক্রমণ শুরু হয়। মার্চের মধ্যেই ছোট থেকে বড় প্রায় সব ব্র্যান্ডের খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর ক্রয়াদেশ একের পর এক বাতিল বা স্থগিত করে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো। বিজিএমইএর দেয়া তথ্যমতে, সংগঠনটির সদস্য ১ হাজার ১২৩ কারখানার ৩১১ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। এসব ক্রয়াদেশের আওতায় ছিল ৯৭ কোটি ৭০ লাখ ১০ হাজার পিস পোশাক। বিজিএমইএ প্রতিনিধিরা বলছেন, প্রথম ঢেউয়ের প্রভাবে বিপুল পরিমাণ ক্রয়াদেশ একের পর এক বাতিল হচ্ছিল। বাতিলের পরিমাণ এখন পর্যন্ত যৎসামান্য হলেও ক্রয়াদেশ সরবরাহের সময় পিছিয়ে দিচ্ছেন ক্রেতারা। বেশির ভাগ ক্রয়াদেশে স্থগিতাদেশ দিচ্ছেন ক্রেতারা। কিছু কিছু বাতিলও হচ্ছে। বাস্তবতা হলো ইউরোপে বিশেষ করে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের রিটেইল বাজার এখন বন্ধ, স্পেন ও জার্মানির রিটেইল খোলা আছে। খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ থাকলেও পণ্য কেনাবেচা কীভাবে হবে,এমন প্রশ্ন তুলে বিজিএমইএ পর্ষদ সদস্যরা বলছেন, বড় আকারে ক্রয়াদেশ বাতিল হচ্ছে না। কিন্তু তিন লাখ পিসের ক্রয়াদেশ থেকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এক থেকে দেড় লাখ পিস বাতিল করা হচ্ছে। বাকি দেড় বা দুই লাখ পিসের ক্রয়াদেশ সরবরাহের সময় পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে ছোট থেকে বড় সব ধরনের ক্রেতার ক্ষেত্রেই। তবে প্রথম ঢেউয়ের মতো বাতিল বা স্থগিত পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি।
মার্চের শুরুতে দেশে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হলে একের পর এক ক্রয়াদেশ হারাতে থাকেন তৈরি পোশাক খাতের রফতানিকারকরা। পরে পরিস্থিতি কিছুট স্বাভাবিক হলে জুন নাগাদ ক্রয়াদেশ ফিরে পেতে শুরু করেন তারা, যার প্রতিফলন ঘটে জুলাইয়ের রফতানি চিত্রে। কিন্তু প্রথম ঢেউয়ের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতে ফের আঘাত হেনেছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। যার প্রভাবে এরই মধ্যে ৩০ শতাংশ কমেছে তৈরি পোশাকের রফতানি আদেশ।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনার প্রথম ঢেউয়ের স্থবিরতা কাটিয়ে জুন মাস নাগাদ ক্রয়াদেশ পেতে শুরু করে দেশের রফতানিমুখী পোশাক কারখানাগুলো। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু অক্টোবরেই আবারো পতন হয় রফতানিতে। মূলত পশ্চিমা দেশগুলোতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় ক্রেতারা ক্রয়াদেশের লাগাম টেনে ধরতে শুরু করেছেন। শীতের মৌসুমকে কেন্দ্র করে ক্রয়াদেশ বৃদ্ধির প্রত্যাশা থাকলেও পোশাক রফতানিকারকদের সেই আশায় এখন গুড়ে বালি। শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর এক জরিপে দেখা গেছে, কভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে পোশাকের ক্রয়াদেশ কমেছে অন্তত ৩০ শতাংশ। যদিও এ জরিপে পোশাক খাতের সব মালিকের সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, বিশেষ কোনো ব্র্যান্ডের কথা বলছি না, কিন্তু প্রচুর ব্র্যান্ড আছে যারা ক্রয়াদেশে সরবরাহ সময় পেছাচ্ছে এবং ৩০ শতাংশের মতো ক্রয়াদেশ কমেছে। এ নিয়ে জানতে চাইলে ক্রেতাদের চাপে অনেক শিল্প মালিকই কথা বলছেন না। তবে যারা বলছেন তাদের তথ্যমতে গড়ে ৩০ ভাগ কমেছে ক্রয়াদেশ। বিজিএমইএর জরিপে উঠে আসা ৩০ শতাংশ ক্রয়াদেশ কমার তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে পাওয়া ব্র্যান্ড ক্রেতাভিত্তিক কনটেইনার পরিবহনের পরিসংখ্যানের। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বড় ক্রেতাদের বেশির ভাগেরই রফতানি কনটেইনার পরিবহন কমেছে গত অক্টোবর মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে এইচঅ্যান্ডএমের পণ্য পরিবহন করা টোয়েন্টি ফিট কনটেইনারের সংখ্যা ছিল ৮৬৩। এ সংখ্যা কমে দ্বিতীয় সপ্তাহে ৭৩০ ও তৃতীয় সপ্তাহে ৫৫০-এ নেমে আসে।
পণ্য পরিবহনে প্রাইমার্কের কনটেইনারের সংখ্যা অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ২৩০ থেকে নেমে তৃতীয় সপ্তাহে হয়েছে ১৯৬টি। সিঅ্যান্ডএর ক্ষেত্রে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ২১০ থেকে তৃতীয় সপ্তাহে কমে হয়েছে ১৮০টি। তবে ওয়ালমার্টের ক্ষেত্রে কনটেইনার পরিবহনের চিত্র ছিল ভিন্ন। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ওয়ালমার্ট চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১৪০ কনটেইনার পোশাক পণ্য পরিবহন করলেও তৃতীয় সপ্তাহে তা বেড়ে ৩০০টিতে উন্নীত হয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর ও পোশাক শিল্প মালিকদের তথ্যে ক্রয়াদেশ কমানোর বিষয়ে একমত নন সব ক্রেতা। এ বিষয়ে এইচঅ্যান্ডএম, ওয়ালমার্ট, প্রাইমার্ক, সিঅ্যান্ডএ ও এমঅ্যান্ডএম বা মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে কেউ বলছেন, বর্তমান কভিডের দ্বিতীয় ঢেউ প্রবাহের বাস্তবতায় ক্রয়াদেশ বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে পোশাক শিল্প মালিকদের ভাগ্য ভালো যে ক্রয়াদেশ মাত্র ৩০ শতাংশ কমেছে। পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার শঙ্কা এখনো কাটেনি। তবে বড় ক্রেতাদের একটি অংশ বলছে, ক্রয়াদেশ কমেনি, অনেক ক্রয়াদেশ আসছে পর্যায়ক্রমে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রেক্ষাপটে কিছু ক্রয়াদেশ সরবরাহের সময়সূচি বদলাচ্ছে।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইথিওপিয়ায় এইচঅ্যান্ডএম রিজিওনাল হেড জিয়াউর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সামগ্রিক ক্রয়াদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বলতে পারব না। তবে শুধু আমাদের প্রতিষ্ঠানের বাস্তবতা বিবেচনায় ৩০ শতাংশ ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার বিষয়ে আমি একমত নই। আমাদের প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত কোনো ক্রয়াদেশ বাতিল করেনি। ক্ষেত্রবিশেষে ক্রয়াদেশ সরবরাহের সময়সূচিতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধিরা ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট কিছু না বললেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে বিজিএমইএর সংগ্রহ করা পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, চলতি নভেম্বর মাসের ১ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত গত বছরের একই সময়ের তুলনায় পোশাক রফতানি ৭ দশমিক ২২ শতাংশ কম হয়েছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরের প্রথম ১৪ দিনে রফতানি হয়েছিল ১০৫ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের পোশাক। চলতি নভেম্বরের একই সময়ে রফতানি হয়েছে ৯৭ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের পোশাক।
জানতে চাইলে ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, ক্রয়াদেশের গতিপ্রকৃতি ক্রেতাভেদে ভিন্ন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া আমাদের কিছু ক্রয়াদেশ স্থগিত হয়েছে কিন্তু কোনো ক্রেতা বাতিল করেননি। যুক্তরাজ্যের ক্রেতারা ক্রয়াদেশ সরবরাহের সময় গড়ে চার সপ্তাহ পিছিয়ে দিচ্ছে।