আজকাল প্রায় সময় পণ্যদ্রব্যে ভেজাল দিতে দেখা যায়। কিছু কিছু ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা মুখে মুখে কসম কেটে পণ্যদ্রব্যকে নির্ভেজাল ও খাঁটি বলে দাবি করে ভেজাল ও ত্রুটিযুক্ত পণ্য চালিয়ে দেয়। বিশেষত অনলাইন ব্যবসার ক্ষেত্রে ফটোশপের মাধ্যমে পণ্যকে চকচকে করে বাহারি বিজ্ঞাপনে ক্রেতাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। বাস্তবে অনলাইনে দেখানো পণ্যের সাথে ক্রেতার হাতে পাওয়া পণ্যে অনেক ক্ষেত্রে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ইসলাম অন্যান্য প্রতারণার মতোই ব্যবসার ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতারণা ও ধোঁকাবাজিকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আওফা রা: বলেন, এক লোক বাজারে বেচাকেনা করার সময় মানুষকে নিজের পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট করতে অনবরত শপথ করে যাচ্ছিল যে, তার দ্রব্যের এত এত দাম উঠেছে এবং অমুক ব্যক্তি এত দাম হাঁকিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ বাস্তবে এমন দাম উঠেনি। তখন কুরআনের এই আয়াতটি নাজিল হয়, ‘যারা সামান্য মূল্যের লোভে আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা ও শপথের ব্যবহার করে আখিরাতে তাদের কোনো অংশ নেই, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কোনো কথাই বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদের পবিত্র করবেন না, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি’ (সূরা আল ইমরান-৭৭, সহিহ বুখারি-২০৮৮)। রাসূল সা: বলেছেন, ‘ধোঁকাবাজ ও প্রতারক আমাদের দলভুক্ত নয়’ (সহিহ মুসলিম-১৬৪)। নবীজী সা: নিয়মিত বাজার মনিটরিং করতেন যাতে কোনো ব্যবসায়ী এমন জঘন্য পন্থা অবলম্বন করতে না পারে। একদিন চদ্মবেশে রাসূল সা: মদিনার নিকটস্থ বাজারের বেচাকেনা দেখতে বের হলেন। তিনি দেখলেন, এক ব্যবসায়ী বস্তার ভেতরে ভেজা গম রেখে ওপরের শুকনো গম দেখিয়ে বিক্রি করছেন। তিনি সেই ব্যবসায়ী লোকটির কাছে গিয়ে তাকে কড়াভাবে শাসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এভাবে যারা পণ্যের ত্রুটি লুকিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নেয় তারা আমার উম্মতের দলভুক্ত নয়’ (সহিহ মুলিম-১০২)। আরেকটি হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি ত্রুটিযুক্ত পণ্য বিক্রি করে অথচ গ্রাহকের কাছে সেই ত্রুটির কথা গোপন রাখে, সে নিজেকে আল্লাহর ক্রোধে নিপতিত করে। ফেরেশতারাও সর্বদা তার ওপর অভিশাপ দিতে থাকে’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-২২৪৭)। একজন মুমিনের দোষ-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু মিথ্যা, প্রতারণা ও খেয়ানতের দোষ কিছুতেই মুমিনের মধ্যে থাকতে পারে না। রাসূল সা:-এর কাছে জিজ্ঞেস করা হলো, মুমিনের মধ্যে কি কোনো দুর্বলতা থাকতে পারে? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁÑ থাকতে পারে;। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, মুমিন কি কৃপণ হতে পারে? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ- হতে পারে’। তারপর আবার জিজ্ঞেস করা হলো, মুমিন কি মিথ্যুক হতে পারে? তিনি বললেন, ‘না’ মুমিন মিথ্যাবাদী হতে পারে না’ (বায়হাকি শুয়াবুল ঈমান-৪৮১২)।
খলিফা হজরত ওমর রা: নিয়মিত বাজারে তদারকি করতেন। যারা ব্যবসায়ে অসৎ উপায় অবলম্বন করত তাদের জনসম্মুখে শাস্তি দিতেন। তিনি বলতেন, ‘ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা ছাড়া কেউ যেন আমাদের বাজারে ব্যবসা করতে না আসে। নতুবা ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় সে সুদে জড়িয়ে পড়বে’ (আল মুয়ামালাতুল মালিয়াতুল মুয়াসারা-১৭)। ইসলামের মহান মনীষীদের বেশির ভাগই ব্যবসায়-বাণিজ্য করে জীবন ধারণ করতেন। তারা সবসময় পণ্যের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করতেন এবং প্রতারণা থেকে সাবধান থাকতেন। একবার ইমাম আবু হানিফা র: তার কর্মচারীকে দোকানে বসিয়ে রেখে বাইরে বের হয়েছিলেন। তিনি এসে দেখেন কর্মচারী সব মালামাল বিক্রি করে দিয়েছে। যার মধ্যে কিছু ত্রুটিযুক্ত কাপড়ও ছিল। তিনি জানতে পারলেন, ত্রুটির কথা না বলেই কাপড়গুলো বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। তাই তিনি ওই দিনের বিক্রিলব্ধ সব টাকা দান করে দিলেন। সব ধরনের মিথ্যা, প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি থেকে বিরত থেকে সততার সাথে ব্যবসায়-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার শিক্ষা ইসলাম আমাদের দিয়েছে। লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট