জিকির শব্দের অর্থ কোনো কিছু স্মরণ করা, বর্ণনা করা, মনে রাখা বা মনে করা ইত্যাদি। জিকরুল্লাহ বলতে আল্লাহকে স্মরণ করা, আল্লাহর কথা বর্ণনা করা, আল্লাহকে মনে রাখা বোঝায়। মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত আমাদের স্রষ্টাকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করা। অথচ আমরা খুব কমই স্রষ্টাকে স্মরণ করি এবং কৃতজ্ঞতা কমই প্রকাশ করি। স্রষ্টাকে স্মরণের অনেক রকম অবলম্বন রয়েছে। এসবের মধ্যে জিকির, হোক মনে মনে কিংবা মুখে মুখে, হচ্ছে একটি উপায়। যার মাধ্যমে আমরা স্রষ্টাকে দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে ফাঁকেই স্মরণ করতে পারি। প্রতিদিনের আমলের খুব বড় একটা অংশ হচ্ছে জিকির বা অনবরত পাঠ। জিকিরের অনেক বেশি ফজিলত রয়েছে।
দুনিয়ার বস্তুগত সামগ্রিক বিষয়ের মধ্যে জিকিরের গুরুত্ব অনেক বেশি। রাসূল সা: বলেন, ‘দুনিয়াটা অভিশপ্ত এবং এর মধ্যস্থিত সব কিছুই অভিশপ্ত। তবে আল্লাহর জিকির, জিকিরের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়, আলেম (জ্ঞানী) ও জ্ঞানার্জনকারী (অভিশপ্ত নয়)’ (সহিহ তারগিব ওয়াত তাহরিব-৭৪)। আল্লাহর জিকির ছাড়া বাকি সব কিছুকেই অভিশপ্ত, সুবহান আল্লাহ। আল্লাহকে যদি কেউ মন দিয়ে ডাকে তবে সেই ডাকে নিশ্চয়ই কোনো গাফিলতি বা ভ্রষ্টতা থাকে না। আর এর জন্যই দুনিয়ার যাবতীয় সব বিষয় থেকে জিকির একটি শ্রেষ্ঠ কাজ।
আল-কুরআন আমাদের বারবার আল্লাহর জিকিরের গুরুত্ব বুঝিয়েছে। কুরআনে জিকিরের নির্দেশ দিতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘যারা দাঁড়িয়ে-বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশম-লী ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে এবং (বলে,) হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এ নিরর্থক সৃষ্টি করোনি। তুমি পবিত্র। তুমি আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করো’ (সূরা ইমরা-১৯১)। এর অর্থ হলো- বিস্ময়কর এই সৃষ্টি এবং আল্লাহর মহা কুদরত দেখেও যে ব্যক্তি মহান স্রষ্টার পরিচয় লাভ করতে পারে না, সে প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানীই নয়। দ্বিতীয় আয়াতে জ্ঞানীদের আল্লাহর জিকর করার স্পৃহা এবং আসমান ও জমিনের সৃষ্টি সম্পর্কে তাদের চিন্তা ও গবেষণা করার কথা বর্ণিত হয়েছে। হাদিসেও রাসূল সা: বলেছেন, ‘দাঁড়িয়ে নামাজ পড়। যদি দাঁড়িয়ে পড়তে না পারো, তাহলে বসে বসে পড়। আর যদি বসে বসে পড়তে না পারো, তবে পার্শ্বদেশে শুয়ে শুয়ে পড়’ (বুখারি-১১১৭)। এ ধরনের লোক যারা সবসময় আল্লাহর জিকর করেন ও তাঁকে স্মরণে রাখেন এবং আসমান ও জমিনের সৃষ্টি ও তার রহস্য ও যুক্তিসমূহ সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করেন, তারা বিশ্বস্রষ্টার মহত্ত্ব ও মহাশক্তি, তার জ্ঞান ও এখতিয়ার এবং তার রহমত ও প্রতিপালকত্ব সম্পর্কে সঠিক পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হন। ফলে আপনা-আপনিই তাদের মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে, বিশ্বের প্রতিপালক এই বিশাল পৃথিবীকে অনর্থক সৃষ্টি করেননি; বরং এর উদ্দেশ্য হলোÑ বান্দাদেরকে পরীক্ষা করা। যে বান্দা পরীক্ষায় সফলতা অর্জন করতে পারবে, সে লাভ করবে চিরস্থায়ী জান্নাতের নিয়ামত। আর যে পরীক্ষায় ব্যর্থ হবে, তার জন্য হবে জাহান্নামের আজাব। এই জন্যই তারা (জ্ঞানীজন) জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা পাওয়ার দোয়াও করে থাকেন।
জাকির বা আল্লাহর জিকিরকারীকে রাসূল সা: মুফার্রিদ বলেছেন। রসূলুল্লাহ সা: মক্কার পথে চলতে থাকেন। অতঃপর ‘জুমদন’ নামে একটি পর্বতের কাছে গেলেন। এরপর তিনি বললেন, ‘তোমরা এ জুমদান পর্বতে সফর করো। মুফার্রিদরা অগ্রগামী হয়েছে। মানুষরা প্রশ্ন করল, মুফার্রিদ কারা! হে আল্লাহর রাসূল সা:? তিনি বললেন, ‘বেশি বেশি আল্লাহর জিকিরে নিয়োজিত পুরুষ ও নারী’ (সহিহ মুসলিম-৬৭০১)।
অতিরিক্ত জিকির করার মাধ্যমে ইসলামের মাঝে শক্তভাবে নিবদ্ধ থাকা সম্ভব। কারণ বান্দা যখন অনবরত আল্লাহকে ডাকবে এবং স্মরণ করবে, তখন অন্যান্য সব চিন্তা খুব কমই আসবে। এর একটা বিশেষ ফজিলত অবশ্যই রয়েছে। জনৈক সাহাবি বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য ইসলামের শরিয়তের বিষয়াদি অতিরিক্ত হয়ে গেছে। সুতরাং আমাকে এমন একটি বিষয় জানান, যা আমি শক্তভাবে আঁকড়ে থাকতে পারি। তিনি বললেন, ‘সর্বদা তোমার জিহ্বা যেন আল্লাহ তায়ালার জিকিরে সিক্ত থাকে’ (ইবনে মাজাহ-৩৭৯৩)। রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালার এক গ্রুপ ভ্রাম্যমাণ বর্ধিত ফেরেশতা রয়েছে। তারা জিকিরের বৈঠকগুলো সন্ধান করে বেড়ায়। তারা যখন কোনো জিকিরের বৈঠক পায় তখন সেখানে তাদের (জিকিরকারীদের) সাথে বসে যায়। আর পরস্পর একে অপরকে বাহু দ্বারা ঘিরে ফেলে। এমনকি তারা তাদের মাঝে ও নিকটতম আকাশের ফাঁকা জায়গা পূরণ করে ফেলে। আল্লাহর জিকিরকারীরা যখন পৃথক হয়ে যায় তখন তারা আকাশম-লীতে আরোহণ করে। তিনি বলেন, ‘তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা কোথা থেকে এসেছ? অথচ তিনি তাদের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অবহিত। তখন তারা বলতে থাকে, আমরা ভূম-লে অবস্থানকারী আপনার বান্দাদের কাছ থেকে এসেছি, যারা আপনার তাসবিহ পড়ে, তাকবির পড়ে, তাহলিল বলেÑ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর) জিকির করে, আপনার প্রশংসা করে এবং আপনার কাছে তাদের প্রত্যাশিত বিষয় প্রার্থনা করে। তখন আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দারা আমার কাছে কী প্রার্থনা করে?’ তারা বলেন, তারা আপনার কাছে আপনার জান্নাত প্রত্যাশা করে। তিনি বলেন, ‘তারা কি আমার জান্নাত প্রত্যক্ষ করেছে?’ তারা বলেন, না; হে আমাদের প্রভু! তিনি বলেন, ‘তারা যদি আমার জান্নাত প্রত্যক্ষ করত তাহলে তারা কী করত?’ তারা বলেন, তারা আপনার কাছে আশ্রয় চায়। তিনি বলেন, ‘কী বিষয় থেকে তারা আমার কাছে আশ্রয় চায়?’ তারা বলেন, হে আমাদের প্রভু! আপনার জাহান্নাম থেকে (মুক্তির জন্য)। তিনি বলেন, ‘তারা কি আমার জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করেছে?’ তারা বলেন, না; তারা প্রত্যক্ষ করেনি। তিনি বলেন, ‘তারা যদি আমার জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করত তাহলে কী করত?’ তারা বলেন, তারা আপনার কাছে ক্ষমা প্রর্থনা করে। তিনি বলেন, তখন আল্লাহ বলবেন, ‘আমি তাদের মার্জনা করে দিলাম এবং তারা যা প্রার্থনা করছিল আমি তা তাদের প্রদান করলাম আর তারা যা থেকে আশ্রয় চেয়েছিল আমি তা থেকে তাদের মুক্তি দিলাম। অতঃপর তারা বলবে, হে আমাদের রব! তাদের মাঝে তো অমুক পাপি বান্দা ছিল, যে তাদের সাথে বৈঠকের কাছ দিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে বসেছিল। তিনি বলেন, তখন আল্লাহ বলবেন, ‘আমি তাকেও মাফ করে দিলাম। তারা তো এমন একটি কওম যাদের সঙ্গীরা দুর্ভাগা হয় না’ (সহিহ মুসলিম-৬৭৩২)।
জিকির ভালো ঘুমের জন্য হতে পারে উত্তম কোনো মাধ্যম। আর জিকির অবস্থায় যদি কারো ঘুম চলে আসে তাহলে সারারাত সে জিকিরের পুণ্য অর্জন অবস্থায় থাকবে। আবুল আহওয়াস রহ: থেকে বর্ণিত- আবদুল্লাহ রা: বলেছেন, আল্লাহর জিকির করলে শয়তানের পক্ষ থেকে ঘুম এসে যাবে। তোমরা চাইলে অনুশীলন করে দেখতে পারো। তোমাদের কেউ যখন শয্যাগত হয়ে ঘুমাতে ইচ্ছা করে তখন সে যেন মহামহিম আল্লাহর জিকির করে’ (আদাবুল মুফরাদ-১২২০)। লেখিকা : গবেষক