করোনাপূর্ব গতিতে ফিরছে দেশের অর্থনীতি। আমদানি-রফতানি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি বৃদ্ধির ফলে রাজস্ব আহরণও বাড়ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবি আর) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কিছুটা ঘাটতি থাকলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রাজস্ব আহরণ হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা বেশি। সাত মাসে আহরণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আহরণ হয়েছিল ১ লাখ ২৬ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। এক মাস হিসেবে গত জানুয়ারিতে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ২১ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবি আরের সদস্য (করনীতি) মো. আলমগীর হোসেন বলেন, দেশের রাজস্ব খাত করোনাভাইরাসের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও অর্থবছরের সাত মাসে রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। রাজস্বে প্রবৃদ্ধি অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত বহন করে। আগামীতে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি আরো বাড়বে। রাজস্ব বাড়ার পেছনে নীতিগত কিছু সিদ্ধান্ত কাজ করেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চলমান মহামারীর শুরুতেই মহামন্দার অশনি সংকেত শুনতে পায় বিশ্ব। গত বছরের শুরুতেই বৈশ্বিক অর্থনীতিকে স্থবির করে দেয় কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব। শ্লথ হয়ে পড়ে শিল্পোৎপাদন। পর্যটনসহ সার্বিক সেবা খাতেও প্রবৃদ্ধি নেমে আসে নেতিবাচক পর্যায়ে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও দেখা দেয় নিশ্চলতা। বেড়ে যায় কর্মহীনতা ও দারিদ্র্য।
ওই সময় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে ধস নেমেছিল, তার ধাক্কা এসে পড়েছিল বাংলাদেশেও। মহামারীর প্রভাবে গত বছরের শেষ পর্যন্ত অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই ছিল নিম্নমুখী। বেড়েছে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য। রাজস্ব আয় কমে যায়। ব্যাংক খাতেও লেনদেনের মাত্রা নেমে আসে। নেতিবাচক ধারায় নেমে আসে ঋণ প্রবৃদ্ধি। তবে শেষ পর্যন্ত বড় মাত্রায় ধস এড়াতে সক্ষম হয় বাংলাদেশের অর্থনীতি। বরং এ মুহূর্তে কভিডজনিত শ্লথতা কাটিয়ে পুনরুদ্ধারের সুখবর পাওয়া যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, দেশের অর্থনীতি এখন করোনা-পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরছে। অন্যদিকে কভিডের আগে দেশের পুঁজিবাজার বেশ দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সেটিতেও এখন কিছুটা হলেও গতি ফিরেছে।
প্রকৃতপক্ষে ডিসেম্বর থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত পাচ্ছিলেন সংশ্লিষ্টরা। চলতি মাসে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, পুনরুদ্ধারের পথে অর্থনীতির চাকা এখন অনেক বেশি গতিশীল। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সচল হয়েছে আকাশপথও। ফলে করোনাপূর্ব অবস্থানে প্রত্যাবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে বৈদেশিক শ্রমবাজারেও। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৪ হাজার ৩১৪ জন বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যেতে পেরেছেন, যা গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় প্রায় ২১ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে এ সময় ঋণের চাহিদাও বেড়েছে। ডিসেম্বরে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে আগের মাসের তুলনায় ১ দশমিক ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় এ বৃদ্ধির হার ছিল ৯ দশমিক ৯১ শতাংশ।
নভেল করোনাভাইরাসের আঘাতে দেশের ব্যাংক খাতের লেনদেনে স্থবিরতা নেমে এসেছিল। লেনদেন কমে গিয়েছিল চেক, ইএফটি, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডসহ সব ডিজিটাল মাধ্যমেই। গত বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোয় চেকের মাধ্যমে লেনদেন কমে গিয়েছিল ৩০ শতাংশের বেশি। ওই প্রান্তিকে চেকের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল ৪ লাখ ৭ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। করোনার বিপর্যয় কাটিয়ে গত অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোতে চেকের মাধ্যমে লেনদেন ৬ লাখ ৬ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। চেকের মাধ্যমে হওয়া লেনদেনের এ পরিসংখ্যান ২০১৯ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকের চেয়েও বেশি। ২০১৯ সালের শেষ প্রান্তিকে চেকের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা।
চেকে লেনদেনের মতোই ইএফটি, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডসহ ডিজিটাল ব্যাংকিং লেনদেন করোনার আগের অবস্থায় ফিরেছে। কিছু ক্ষেত্রে মহামারীপূর্ব অবস্থা থেকেও এ লেনদেনের সংখ্যা অনেক বেশি বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে।
সরকারের দেয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ও কৌশলগুলো বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখছে। সংকট কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশকে কয়েক বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছে বহুপক্ষীয় ব্যাংক ও দ্বিপক্ষীয় অংশীদাররাও।
কভিডকালে জনবান্ধব রাজস্বনীতি ও সম্প্রসারণমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণের কারণে বাজারে মুদ্রা ও ঋণের সরবরাহ বেড়েছে বলে জানালেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় গুণগত বিষয় হলো, প্রধানমন্ত্রী এটিকে একটি শক্তিশালী কাঠামোর ওপর দাঁড় করিয়েছেন। কভিডকালে বড় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে অর্থনীতির সূচকগুলো সচল রাখা সম্ভব হয়েছে। ফলে মহামারী পরিস্থিতিতে অর্থনীতির সূচকগুলো ভেঙে পড়েনি। এছাড়া প্রণোদনার অর্থ সরাসরি সুবিধাভোগীর ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হয়েছে। এতে অর্থের অপচয় কম হয়েছে। আবার যারা সুবিধা পাওয়ার যোগ্য কিন্তু পাননি, তাদের অর্থ আমাদের কাছে রয়েছে। সুবিধামতো সময়ে দেয়া হবে। সরকারের সব সংস্থা ও কর্মকর্তারা টিম হিসেবে কাজ করার কারণেই অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।
সংকটকালে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন অভিবাসী শ্রমিকরা। এ সময়ে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে রেকর্ড পরিমাণে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ১ হাজার ৪৯০ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেশি। ফেব্রুয়ারিতেও আগের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। গত মাসের প্রথম ২৩ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৪৯ কোটি ডলার। রেমিট্যান্সের এ উচ্চপ্রবৃদ্ধিই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশী মুদ্রায় বর্তমান রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে দেশের প্রায় এক বছরের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব।
দেশের ব্যাংক খাতের লেনদেন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরেছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো থেকে আমরা যে পরিসংখ্যান পাচ্ছি, তা আশাব্যঞ্জক। দেশের ব্যাংক খাতের সূচকগুলো করোনাপূর্ব পরিস্থিতিতে ফিরেছে। রেমিট্যান্সের উচ্চপ্রবৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের রফতানি খাতও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আমদানি প্রবৃদ্ধি ফিরে এসেছে। অর্থনীতির সব সূচকই প্রবৃদ্ধির ধারায় ফেরাটা বড় অর্জন।
দেশব্যাপী করোনাকালে লাখো মানুষ চাকরি হারিয়েছে। দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ হয়েছে। ছোট ও ক্ষুদ্র অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। সামগ্রিক প্রভাবে দেশের সিংহভাগ মানুষের আয় কমে যায়। আমদানিকারক দেশগুলো তাদের বাণিজ্য সচল রাখতে হিমশিম খাওয়ায় বাংলাদেশের রফতানি খাত বড় ধাক্কা খায়। ২০২০ সালের তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে রফতানি (ফ্রি অন বোর্ড) প্রায় ৫ শতাংশ কমেছে। তবে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রফতানির পরিমাণ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে মাত্র ১ শতাংশ। ফলে ধীরে হলেও গতি ফিরছে রফতানি খাতে। ব্যাংকগুলোয় আমদানি-রফতানির এলসি খোলার হার বাড়ছে। পোশাক শিল্প খাতের কারখানাগুলোও প্রায় পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করেছে। এ খাতের স্থগিত হওয়া অর্ডারগুলো ফিরে আসছে। রফতানি খাতের প্রবৃদ্ধি এখন নেতিবাচক হলেও তার মাত্রা আগের চেয়ে কমেছে। বর্তমান ক্রয়াদেশ ফিরতে শুরু করলেও মারাত্মক মূল্য চাপ মোকাবেলা করছেন শিল্পমালিকরা। গত ডিসেম্বরে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে রফতানির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির হার নেমেছে ঋণাত্মক ৩ দশমিক ৯২ শতাংশে। রফতানির এ পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে আরো সহযোগিতা করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সংসদ সদস্য আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, কভিড-১৯-এর প্রভাব রফতানি খাতের ওপর যতটা পড়ার আশঙ্কা ছিল, ততটা পড়েনি। এর মূলে আছে প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণতা। তার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ ব্যবহার করে রফতানিমুখী শিল্পগুলো সক্রিয় রাখা গেছে। এখন শিল্প সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে দ্রুতগতিতে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগী সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নতুন নতুন নীতি সহায়তার পাশাপাশি বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণের প্রয়োজন আছে।
কভিডের প্রভাবে বিনিয়োগেও স্থবিরতা দেখা দেয়। গত এপ্রিল-মে মাসে ব্যাপকহারে পতন ঘটে নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রস্তাবে। সেপ্টেম্বর থেকে পরিস্থিতিতে আবারো পরিবর্তন আসতে শুরু করে। স্থানীয় বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করতে শুরু করেছে স্থানীয় বড় করপোরেটরা। পাশাপাশি দেশের অবকাঠামো খাতে বড় বিনিয়োগের আগ্রহ বাস্তবায়নের তাগিদ দেখাতে শুরু করেছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। বৈদ্যুতিক রেলেই ১২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আগ্রহ বাস্তবায়নের তৎপরতা দেখা গিয়েছে সম্প্রতি।
এ বিষয়ে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ২০২১ সালে বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে আমরা অনেক আশাবাদী। বিশ্বের অনেক দেশের বিনিয়োগকারীরাই বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে নতুন সম্ভাবনাও দেখা দিচ্ছে। বিনিয়োগ ও ব্যবসার সেবাগুলো সহজ করতে অনেক ধরনের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে, বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিস বিধিমালাও জারি হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে বিদেশী বিনিয়োগ আরো বেশি আকর্ষণীয় হবে বলে আমি আশা করি।