‘খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ’র ওয়েবিনারে বক্তরা
করোনাভাইরাসে মহামারিতে প্রায় ৬৫.৭১ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে এবং ৩৭.১৪ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে খাদ্যসহ দৈনন্দিন চাহিদা মেটাচ্ছেন বলে খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ জানিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ’ আয়োজিত ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও খাদ্যগ্রহণে প্রভাব’ শীর্ষক জরিপের ফলাফল নিয়ে ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
বক্তারা বলেন, মহামারি করোনার প্রথম ধাক্কা মোটামুটি কাটিয়ে উঠতে শুরু করলেও দ্বিতীয় ঢেউ দেশে ভয়ঙ্করভাবে দেখা দিয়েছে। এ প্রেক্ষিতে সরকার করোনার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে লকডাউন শুরু করেছে। ফলে আয় কমে যাওয়ায় বিপদে পড়েছে দেশের দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক খাদ্যসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। যা স্বল্প আয়ের মানুষের খাদ্য অধিকার ও খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, এখন একটি অস্বাভাবিক সময় আমরা অতিক্রম করছি। মানুষের আয় কমে গেছে, পাশাপাশি খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি দরিদ্র মানুষকে বিপদগ্রস্ত করেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে খাদ্য সামগ্রী বিক্রির একটি উদ্যোগ নিয়েছি। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারেও তেল, চিনি, পেঁয়াজসহ দ্রব্যমূল্য বেড়ে চলেছে, তার একটা প্রভাব দেশের বাজারেও পড়ছে। দাম কমানোর জন্য খাদ্য, কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যার যার জায়গা থেকে কাজ করছে।
মন্ত্রী বলেন, সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। গত বছরে হঠাৎ বন্যার কারণে চালের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাজারে এর প্রভাব পড়েছিল। তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে না কমলে আমাদের পক্ষে বেশি কিছু করার থাকে না। তবে টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে বিক্রির পরিমাণ আমরা বৃদ্ধির চেষ্টা করছি। আমাদেরকে এখন আসলে কোভিডকে মাথায় রেখেই আগামী সকল পরিকল্পনা করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, যেসব মানুষ দারিদ্র্য ঝুঁকিতে রয়েছে, বর্তমান করোনা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে তারাও খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পতিত হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম দেখা যায় না। সেজন্য দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কমিশন গঠন করা দরকার। এ কমিশন গবেষণার আলোকে সুপারিশ তুলে ধরবে এবং বাজার মনিটরিংয়ে ভূমিকা রাখবে।
তিনি বলেন, খাদ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা দরকার। পুষ্টি নিশ্চিত করতে বৈচিত্রপূর্ণ খাদ্যগ্রহণে মানুষকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি ন্যায্যমূল্যে যোগান নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে শিশুদের পুষ্টির বিষয়টির উপর বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। দ্রব্যমূল্য সম্পর্কিত সঠিক তথ্যও জনগণকে জানাতে হবে, যাতে মানুষের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি না হয়।
সায়মা হক বলেন, বাজেটে শহরের বস্তিবাসী দরিদ্রদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ থাকা উচিত ছিল। জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কার্যক্রমগুলো যত দ্রুত সম্ভব ডিজিটালাইজেশন করা দরকার। স্বাস্থ্যের পাশাপাশি খাদ্য ও পুষ্টি এ সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বের বিষয়। বিশেষ করে শিশুদের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য ১০০ কোটি টাকা যে বরাদ্দ কর্মসংস্থানের উদ্দেশে তা খুবই অপ্রতুল এবং এখানেও নগর দারিদ্র্য উপেক্ষিত।
দক্ষিণ এশিয়া, ইকো কোঅপারেশনের কর্মসূচি পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাদেশ সরকার একটি কৃষিবান্ধব সরকার এবং কৃষকদের নানারকম সহযোগিতা করে থাকেন। কিন্তু খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটলেও কৃষকরা সেখান থেকে লাভবান হয় না। লাভবান হয় মজুতদাররা। তাদের সিন্ডিকেটই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। লকডাউনের সময় আবারও খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি সে পরিস্থিতিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। কৃষক যেন কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় সেদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। বাজার মনিটরিংয়ের উপর জোর দিতে হবে। সরকারি সহায়তা যেন প্রকৃত দরিদ্র মানুষ পায় সেক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনতে হবে।
করোনাকালে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখ করে খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ ও নির্বাহী পরিচালক, ওয়েভ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক মহসিন আলী বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে সরকারের অনেক ভালো উদ্যোগও ম্লান হয়ে যায়। খোলা বাজারে বিক্রি বৃদ্ধির পাশাপাশি দরিদ্র মানুষ যেন তাদের হাতের কাছে খাদ্যসামগ্রী পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।
জরিপের ফলাফল উপস্থাপনকালে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে দেশের অর্থনীতি গত বছর থেকেই বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখনই শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। ইতোমধ্যে সরকার লকডাউন ঘোষণা করেছে করোনার বিস্তার ঠেকানোর জন্য। এর ফলে নি¤œ আয়ের মানুষ বিশেষত দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, রাস্তার ধারের হকাররা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, যা দরিদ্র মানুষের জন্য বাড়তি ও অসহনীয় চাপ তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, স্বল্প আয়ের মানুষের খাদ্য অধিকার হুমকির মুখে পড়েছে। ধান-চাল, আটা, তেল, শাক-সবজি এগুলোর মূল্যস্ফীতি জানুয়ারি ২০২১ থেকে আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার প্রবণতা অক্টোবরে কিছুটা ভালো ছিল। খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ ইতোমধ্যে যে তাৎক্ষণিক জরিপ চালিয়েছে তাতে আমাদের বেশিরভাগ মানুষের এ মুহূর্তের যে পর্যবেক্ষণ তারই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।
জরিপে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ ব্যক্তির পরিবার তিনবেলা খাবার যোগাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। তাদের প্রাণিজ আমিষ গ্রহণের মাত্রা হ্রাস পেয়েছে। প্রায় ৬৫.৭১ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। ৩৭.১৪ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে খাদ্যসহ দৈনিন্দিন চাহিদা মেটাচ্ছেন। স্বল্প আয়ের এসব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারি সহায়তা দরকার। তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমানে চালের বাজারে সিন্ডিকেটের দেখা পাওয়া যায় না। কিন্তু সরকার অনুমোদিত বৃহৎ রাইস মিলাররা যে পরিমাণ চাল মজুত করার এখতিয়ার রাখে তা চালের বাজার অস্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে, যা ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ হতে পারে।
এ প্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য যেসব করণীয় তিনি তুলে ধরেন সেগুলো হলো: ১. খাদ্য নিরাপত্তাকে সকল নাগরিকের অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করতে হবে। ২. খোলাবাজারে চাল বিক্রি বৃদ্ধি করতে হবে।
৩. আগামী এক বছরের জন্য এলাকাভিত্তিক কয়েকটি স্থায়ী খোলা বাজারে বিক্রির জন্য দোকান-স্টোর তৈরি করা যেতে পারে। ৪. টিসিবির বিক্রির সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। ৫. সমাজের ধনী ব্যক্তিদের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ভীত হয়ে দ্রব্যসামগ্রী কিনে মজুত করার প্রবণতা পরিহার করতে হবে। ৬. স্থানীয় পর্যায়ে মুদি দোকানগুলোর মজুতব্যবস্থা নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।