জুটমিল বন্ধ, চালুর উদ্যোগ নেই। পাটশিল্পের এই ধারা দেশের অর্থনীতিতে নতুন বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কারণ চাষিসহ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সাড়ে ৪ কোটি মানুষের জীবিকা চলছে পাট ঘিরে। বেসরকারি খাতের জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) জানায়, শতাধিক পাটকল বন্ধের পাশাপাশি দেড়শ’ কল উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। এখনও চালু থাকা মিলগুলো খুব বেশি দিন চালু রাখা সম্ভব হবে না। বিজেএমএ এবং জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) পাটকলের সংখ্যা ছিল ২৯৬। প্রত্যক্ষভাবে জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা ২ লাখ। এর মধ্যে দেড় লাখ শ্রমিক এখন বেকার।
পাটকল মালিকদের ভাষ্য, কারসাজি ও মজুদদারির কারণে পাটের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, মৌসুমের শুরুতে অধিক পরিমাণে কাঁচা পাট রফতানি হয়েছে এবার। পরে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করতে অনেকে পাট মজুদ করে রেখেছে। তাই বাজারে জোগান কম। ফলে দাম বাড়ছে। এ বছর পাট উৎপাদন হয়েছে ৯২ লাখ ২৬ হাজার বেল। আগের বছর তা ছিল ৭৪ লাখ। এ বছর পাট উৎপাদন হয়েছে ৭২ লাখ ৮৬ হাজার বেল। পাটকলগুলোতে ব্যবহার হয়েছে ৩০ লাখ বেল। গৃহস্থালিতে ব্যবহার হয় প্রায় ৭ লাখ বেল। লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ী ও কিছু পাটকল মালিকের হাতে রয়েছে এখন ১১ লাখ থেকে ১২ লাখ বেল। কিন্তু বাজারে তেমন পাট নেই। এগুলো বৈধ ও অবৈধ মজুদে আটকা পড়ে আছে।
জাতীয় চাহিদাপূরণের জন্য পাট ও পাটবীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়ক উন্নত প্রযুক্তির স¤প্রসারণ কাজ করছে পাট অধিদফতর। পাট উৎপাদন বৃদ্ধিতে ৪৬টি জেলার ২৩০টি উপজেলায় প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে পাটবীজ উৎপাদন ৩৬টি জেলার ১৫০টি উপজেলায়, পাট পচন ২৮টি জেলার ১০০টি উপজেলায় কাজ করছে। এবার কুড়িগ্রাম, নাটোর, লালমনিরহাট, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুড়া এবং মাদারীপুরে পাটের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। এ মৌসুমে ঝিনাইদহের ৬ উপজেলায় ২২ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। এসব এলাকায় প্রতি মণ পাট প্রকারভেদে ২৮০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আজগর আলী বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকা আর পরিচর্যা ভালো হওয়ায় এবার কৃষক পাটের ভালো ফলন পেয়েছে। এতে আরও কৃষকরা অনুপ্রাণিত হবে। আগামীতে পাটের আবাদ বাড়বে।
বাংলাদেশের কৃষকের ঘরে ঘরে পাটের স্বর্ণযুগ যেন ফিরে এসেছে। বাজারে পাট বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন কৃষকরা। গ্রামের হাটবাজারে প্রচুর পাট উঠছে। এ যেন ৩০ বছর আগের চিত্র। সারাদেশে সাড়ে ৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। ফলন ভালো দামও ভালো। এবার সারাদেশে পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে কম বেশি ৯০ লাখ বেল। পাটের উৎপাদন বেড়েছে; অথচ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় দেশের প্রায় সব পাটকল বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ পাট নিয়ে চাষিরা মহাব্যস্ত সময় পাড় করছেন। ক্ষেতে এবং বাজারে ব্যস্ত পাট চাষিরা। একদিকে চলছে পাট কাটা, আরেকদিকে জাগ দিয়ে চলছে আঁশ ছাড়ানোর কাজ। জমির আইলের দুপাশে সবুজ, আর চাষিদের উঠানে সোনালি কাঠির ছড়াছড়ি। ফলন ভালো হওয়ায় দিনভর কাজ করেও ক্লান্তি ছাপিয়ে কৃষকদের চোখেমুখে স্বস্তির ছাপ। বিভিন্ন জেলার পাটক্ষেতে হাসিমুখে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। আঁশ ছাড়ানোর পর পাওয়া পাটকাঠি গ্রামে জ্বালানির প্রধান উৎস। পাটচাষ কমে গেলে পাটকাঠি না পেয়ে বৃক্ষ নিধনের প্রবণতা বাড়তে পারে। যা পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা। কৃষিবিদরা বলছেন, পাট চাষ কৃষকদের অন্য পেশায় বা অন্য স্থানে পেশার তাগিদে উপার্জনের জন্য স্থানান্তর কমাতেও ভূমিকা রাখে।
অন্যদিকে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে পাটকল। সরকারি পাটকল বন্ধের পাশাপাশি বেসরকারি পাটকল এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলোও বন্ধের উপক্রম। আর সরকারি সব পাটকল ২০১৯ সালে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এসব পাটকল চীনকে দিয়ে চালু করার দাবি উঠলেও তা বন্ধ রয়েছে।
জানতে চাইলে পাট অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. এনায়েত উল্লাহ খান ইউছুফ (যুগ্ম সচিব) ইনকিলাককে বলেন, দেশের পাট উৎপাদন করতে নানা ধরনের প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এবার কুড়িগ্রাম, নাটোর, লালমনিরহাট, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুড়া এবং মাদারীপুরে পাটের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। জাতীয় চাহিদাপূরণের জন্য পাট ও পাটবীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়ক উন্নত প্রযুক্তির স¤প্রসারণ কাজ করা হচ্ছে।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে এবার সাড়ে ৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। আর এ থেকে মোটামুটি ৯০ লাখ বেল পাটের আঁশ উৎপন্ন হবে।
এদিকে কৃষি অধিদফতরের উপ-পরিচালক (পাট উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ) মো. জামিলুর রহমান বলেন, কয়েক বছর থেকে দেশে পাটের চাষ কিছুটা থমকে গিয়েছিলো। বর্তমানে সারাদেশে পাট চাষ বাড়ানো হচ্ছে। এবার ৮ থেকে সাড়ে ৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। আর এ তিন ধরনের পাট চাষ করেছে কৃষকরা। প্রতি বিঘা থেকে ৯ মণ চাষ হয়েছে। বাজারে প্রতি মণ পাট ৩২০০-৩৩০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিজেআরআই) এক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৪ দশমিক ২ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় এবং উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৩৮ লাখ টনে। ২০১০-১১ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যথাক্রমে ৭ দশমিক শূন্য ৮ এবং ৭ দশমিক ২৫ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় এবং উৎপাদিত পাটের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৫ দশমিক ২৬ এবং ১৩ দশমিক ৭৪ লাখ টন। এর অর্থ দাঁড়ায়, পাট উৎপাদনে ধারাবাহিকতার অভাব। তাছাড়া রিপোর্ট মোতাবেক উপর্যুক্ত তিন অর্থবছরে হেক্টর প্রতি পাট উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ২ দশমিক শূন্য ৮, ২ দশমিক ১৫ এবং ১ দশমিক ৯০ টন। ২০১০-১১ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেয়েছে।
প্রাপ্ত এক তথ্যে জানা যায়, চীনে এক একর জমিতে ১ দশমিক ১৫ টন পাটের ফলনের বিপরীতে বাংলাদেশে এক একর জমিতে পাটের ফলন শূন্য দশমিক ৬৮ টন। ফলে পাট চাষে জমির পরিমাণ বাড়লেও সে পরিমাণে দেশে উৎপাদন বাড়েনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাট চাষে জমির পরিমাণ বাড়লেও উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। এখন যা প্রয়োজন তা হলো পাটের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। জাতীয় চাহিদা পূরণের জন্য পাট ও পাটবীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ বিষয়ে প্রযুক্তির স¤প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। উন্নত পদ্ধতি ও কলাকৌশল অবলম্বনে পাটবীজ উৎপাদনে এবং মানসম্মত পাট উৎপাদনে কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদানে জোর দিচ্ছে সরকার। বাজারে চালের দাম তিন বছরের মধ্যে এখন সর্বোচ্চ। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যকেও দামে টেক্কা দিয়েছে পাট। এক কেজি কাঁচা পাটের দাম এখন প্রায় আড়াই কেজি চালের দামের সমান। পাট বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা কেজি, প্রতি মণ সাড়ে পাঁচ হাজার। এই দর দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তবু মিলছে না, তাই দাম বাড়ছে দিন দিন। এত চড়া দামে পাট কিনে পণ্য উৎপাদন করে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। তাই একের পর এক বন্ধ হচ্ছে পাটকল। সরকারি পাটকল বন্ধের পাশাপাশি বেসরকারি পাটকল এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলোও বন্ধের উপক্রম। আর সরকারি সব পাটকল ২০১৯ সালে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।