বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিদ্যায়তনিক (একাডেমিক) চর্চা বিশ্বজুড়ে বাড়ছে। বিশ্বের ৪ মহাদেশের ৩০টি দেশের ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা ও চর্চা হচ্ছে। এ ছাড়া চীনা ভাষায় রবীন্দ্ররচনাবলির ৩৩ খ-ের অনুবাদ থেকে শুরু করে লালনের গান ও দর্শন ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। সোভিয়েত আমলে রুশ ভাষাতে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের ব্যাপক অংশের অনুবাদ হয়েছে। গবেষকেরা মনে করছেন, ইংরেজি, চীনা ও জাপানি ভাষার পরপর বাংলা ভাষা নিয়ে বিশ্বের আগ্রহ বাড়ছে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়ে থাকে। এর বাইরে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, পোল্যান্ড, রাশিয়া, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, চেক রিপাবলিক, কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের মোট ৩০টি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা হয়ে থাকে। এসব গবেষণায় বিদেশি গবেষকেরা ছাড়াও বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের গবেষকেরাও যুক্ত আছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার বলেন, বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষার চর্চা নিয়ে গবেষণায় তিনি দেখতে পেয়েছেন, মূলত প্রাচ্যবিদ্যাচর্চা কিংবা দক্ষিণ এশিয়া অধ্যয়নের মতো বিভাগগুলোর আওতায় বাংলা নিয়ে বেশি গবেষণা হয়ে থাকে।
বিদ্যায়তনে বাংলা চর্চা: যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে উনিশ শতক থেকেই প্রাচ্যবিদ্যা ও ভাষাচর্চা বিভাগের অধীনে বাংলা নিয়ে গবেষণাকাজ চলছে। যুক্তরাজ্যে বতর্মানে বাংলা ভাষাভাষীদের পাশাপাশি কাজ করছেন জেডি অ্যান্ডারসন, টি ডব্লিউ ক্লার্ক, জন বোল্টন, উইলিয়াম রাদিচে, হানা রুথ টমসন প্রমুখ। হানা রুথ টমসন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সোয়াসে বাংলা বিভাগে কাজ করছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অদিতি লাহিড়ী বাংলা রূপতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন কয়েক দশক ধরে। যুক্তরাষ্ট্র কমপক্ষে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। এর মধ্যে নিউইয়র্ক, শিকাগো, মিনেসোটা, ফ্লোরিডা, মেরিল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়া, ভার্জিনিয়া, উইসকনসিন ও হার্ভার্ড উল্লেখযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার অর্থপ্রকাশে মনস্তত্ত্বের ভূমিকা নিয়ে কাজ করছেন জাস্টিন আলফান্সো চাকোন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে মারিয়া হেলেন বেরো কাজ করেন নজরুলসাহিত্য নিয়ে। এ বিষয়ে তাঁর বইও প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলা ভাষা শেখানোর বাইরেও গবেষণা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ও লালন সাঁইকে নিয়েও। ক্লিনটন বি সিলি, র?্যালফ নিকোলাস, ক্যারল সলোমন, ক্যারোলিন রাইট, হেনরি গ্লাসি প্রমুখ বিদেশি বাংলা গবেষকের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাচর্চার প্রসার ঘটেছে। তাঁদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর কবিতা নিয়ে ক্লিনটন বি সিলির গবেষণার সুনাম বিদ্যায়তনের বাইরেও ব্যাপক খ্যাতি পেয়েছে। তিনি মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়েও কাজ করেছেন। একই রকম খ্যাতি পেয়েছে যুক্তরাজ্যের কবি ও গবেষক উইলিয়াম রাদিচের রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ। কানাডার জোসেফ ও’কনেল এবং ভ্যাংকুভারে ব্যারি মরিসনসহ বেশ কয়েকজন বাংলায় অধ্যাপনা ও গবেষণা করছেন। মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজেন্দ্র সিংহের বাংলা বিষয়ে গবেষণা ও প্রকাশনা রয়েছে।
জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রবাসী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের পাশাপাশি মার্টিন কেম্পশেন বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ ও গবেষণা করেছেন। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের হান্স হারডার গবেষণা করেছেন চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার নিয়ে। তিনি প্রাচীনতম বাংলা কবিতা চর্যাপদ নিয়েও গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন।
পোল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এলভিয়েতা ওয়াল্টার বাংলা থেকে পোলিশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ও বিভূতিভূষণ অনুবাদ করছেন। বেলজিয়ামের নাগরিক ফাদার দ্যতিয়েন গবেষণা করেছেন বাংলা ভাষার পুরোনো বই ও পা-ুলিপি নিয়ে। সেসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে বাংলা ভাষায় রচনা করেছেন মৌলিক সাহিত্য। অতি সম্প্রতি ডেনমার্কের আলবর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা বিষয়ে গবেষণার জন্য বেঙ্গল স্টাডি সেন্টার খোলার প্রক্রিয়া চলছে। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাচর্চার সূচনা করেছিলেন লেখক ও চিন্তাবিদ আবু সয়ীদ আইয়ুব ও শিবনারায়ণ রায়। তাঁদের প্রেরণায় মারিয়েন ম্যাডার্ন বাংলা গবেষণা ও অনুবাদে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয় সে দেশে যেসব এশীয় ভাষা শেখার জন্য গুরুত্ব দিয়েছে, বাংলার অবস্থান তাতে তৃতীয়।
এশিয়ায় বিশেষভাবে বাংলার চর্চা হয় জাপান, চীন, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়। তবে জাপান ও সাম্প্রতিক চীন এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। জাপানে প্রায় ৭০ বছর আগে কাজুও আজুমা রবীন্দ্র-অনুরাগ থেকে বাংলা ভাষাচর্চা শুরু করেছিলেন। জাপান ফাউন্ডেশন ও টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেই শিরায়, কিওকো নিওয়া, উদিচা দম্পতিসহ বেশ কয়েকজন বাঙালি গবেষক সেখানে কাজ করছেন। তিন বছর আগে টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজে শুরু হয়েছে বাংলা ভাষা শেখানো। জাপানি শিক্ষার্থীরা সেখানে বাংলা ভাষা শেখা ও চর্চার সুযোগ পাচ্ছেন। সেখানে পাঠদান করছেন কিওকো নিওয়া, কাজুহিরো ওয়াতানাবে ও মনজুরুল হক।
জাপানের কিয়োতো ও ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বতর্মানে বাংলা ভাষা শিক্ষা দিচ্ছেন হুজিয়ারা ও তোমিও মিজকামি। বাংলা ছাড়াও বাংলাদেশের চাক ভাষা নিয়ে অভিধান রচনা করছেন তাঁরা। এ ছাড়া গিফু বিশ্ববিদ্যালয়ের হিদিকি মাকি বাংলা ও জাপানি ভাষার বাক্য গঠন নিয়ে তুলনামূলক গবেষণা করছেন। রেডিও এনএইচকেতেও বাংলা ভাষা শিক্ষাসহ নিয়মিত অনুষ্ঠান হচ্ছে বাংলায় কাজুহিরো ওয়াতানাবের নেতৃত্বে। সম্প্রতি বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয়েছে বাংলা বিভাগ। সেখানে নিয়মিত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্লাস চালু হবে আগামী বছর থেকে। চীন থেকে এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের বেশ কিছু অনুবাদকর্ম। এ ছাড়া রবীন্দ্রসাহিত্য চীনা ভাষায় অনুবাদের কাজ করছেন চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনালের সাবেক ৩০ কর্মী।
শুরু ঔপনিবেশিক যুগে: উনিশ শতকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড ও পর্তুগালের মতো ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণার সূত্রপাত। মূলত এশিয়াটিক সোসাইটির হাত ধরে সে গবেষণা পরে একটি কাঠামো পায়। এসব দেশের ঔপনিবেশিক প-িত ও ধর্মপ্রচারকদের হাতে বাংলা ভাষার চর্চা শুরু হয়। ব্রিটিশ প-িত জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন ১৮৯৪ থেকে ১৯২৮ সালের মধ্যে ২০ খ-ে আট হাজার পৃষ্ঠার লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া নামে বিখ্যাত সমীক্ষাগ্রন্থ প্রকাশ করেন।
এ যুগে ভৌগোলিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে নতুন ধরনের চর্চা শুরু হয়েছে। প্রায় প্রতিবছরই বিশ্বের নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ খোলা হচ্ছে, একাডেমিক কোর্স চালু হচ্ছে, অনেকেই বাংলা নিয়ে গবেষণা করছেন। অধ্যাপক সৌরভ সিকদারের গবেষণা মতে, ইংরেজি ও চীনা ভাষার পরই বিশ্বজুড়ে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। ২০১০ সালে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা দেওয়ার পর এই আগ্রহ আরও বেড়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলা: বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহের কারণে বিশ্বের অন্তত ছয়টি দেশের রাষ্ট্রীয় বেতারে বাংলা ভাষার আলাদা চ্যানেল রয়েছে। আরও ১০টি দেশের রেডিওতে বাংলা ভাষায় আলাদা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে ছয়টি ও যুক্তরাষ্ট্রে ১০টি বাংলাদেশি মালিকানাধীন ও বাংলা ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ থেকে পাঠকেরা প্রথম আলোর অনলাইন সাইটে নিয়মিত সংবাদ পড়ে থাকেন। সেই অর্থে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বাংলাভাষী মানুষের বসবাস রয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। এই হিসাব আমলে নিলে বিশ্বজুড়েই বাংলাভাষীদের পদচারণা। বাংলা ভাষায় যুক্তরাজ্য থেকে মোট ১২টি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হয়। বেতার বাংলা নামে সেখানে একটি বাংলা রেডিও স্টেশন রয়েছে। ধূমকেতু, জন্মভূমি, প্রতিদিন, স্বদেশ-বিদেশ নামে পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকাও প্রকাশিত হচ্ছে। ইউরোপের ইতালিতে বর্তমানে পাঁচটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা এবং রোম ও ভেনিস শহর থেকে তিনটি বাংলা রেডিও স্টেশন পরিচালিত হচ্ছে। ইতালি থেকে ছয়টি অনলাইন টেলিভিশনও এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে শতাধিক ফেসবুক টেলিভিশন চালু রয়েছে। এ ছাড়া ডেনমার্ক, জার্মানি, সুইডেনসহ ইউরোপের আটটি দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ থেকে বাংলা ভাষায় মুদ্রিত ও অনলাইন পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পৃথিবীর যে দেশেই বাঙালি গেছে, সেখানেই বাঙালি সংস্কৃতি, সাহিত্য ও সাংবাদিকতাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। বাংলা সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি সেখানে তারা বাংলা সাহিত্যচর্চাও করেছে। যতটা না বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে, তার চেয়ে এটা বেশি হয়েছে নিজেদের আত্মপ্রকাশের তাগিদে।