তিস্তায় জেগে ওঠা চরে বাদাম চাষ করে ভালো ফলনের স্বপ্ন দেখছেন কাউনিয়া উপজেলার চরাঞ্চলের কৃষকরা। উপজেলার আরাজি হরিশ্বর, গুপিডাঙ্গা, প্রাননাথ চর, নাজিরদহ চর, পল্লীমারী চর, গদাইর চর, চর গনাই, হরিচরন শর্মা, ঢুসমারা চর, টাপুরচর, হয়রৎখাঁ, বিশ্বনাথসহ তিস্তা নদীবেষ্টিত গ্রামসহ চরগুলো ঘুরে দেখা গেছে, দিগন্তজুড়ে বাদাম আর বাদাম ক্ষেত। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজের সমারহ। উপজেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে এবার প্রচুর বাদাম চাষ হয়েছে। ধু ধু বালুচরেও এখন সবুজের সমারোহ। দিগন্তব্যাপী বাদামের সবুজপাতা হলুদ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন কৃষকরা। কেউ কেউ আগাম বাদাম তুলে রোদে শুকাচ্ছেন। চাষাবাদ সহজ, বিপণনে ঝামেলাহীন ও তুলনামূলকভাবে অধিক লাভ হওয়ায় কৃষকরা কাঁচা বাদামের নাম দিয়েছেন ‘গুপ্তধন’। বাদাম গাছ প্রায় পরিপক্ক হওয়ায় তিস্তা চরে বালির নিচে হাত বাড়ালেই উঠে আসছে মুঠো মুঠো গুপ্তধন। প্রতিটি বাদাম গাছের মুঠি (উপরের অংশ) ধরে টান দিলে উঠে আসছে থোকা থোকা সোনালি রঙের চিনা বাদাম।
বর্ষার প্রমত্ত্বা তিস্তা আগ্রাসী হয়ে যেমন গিলে খায় বসতি, তেমনই শুকনো মৌসুমে ফিরিয়ে দিচ্ছে কিষাণ-কিষাণীর স্বপ্ন। এ যেন সাক্ষাৎ দ্বিচারিনী। তিস্তার ভাঙাগড়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা মানুষ চরাঞ্চলে বাদাম চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। চলতি মৌসুমে বাদামের ফলন অনেকটা ভালো ও বাজারে দাম বেশি পাওয়ার আশা কৃষকের।
কাউনিয়া উপজেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৫৫০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ চলমান। এরমধ্যে তিস্তার চরাঞ্চলে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলাতেই ৫৫০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতা এখনো চলমান বলে জানায় কৃষ বিভাগ। বেলে, দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটিতে তেল জাতীয় ফসল বাদামের ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাই তিস্তার তীর ঘেঁষা ইউনিয়নগুলোতে সবচেয়ে বেশি চিনা বাদাম চাষ হয়েছে।
উপজেলা কৃষি বিভাগের মতে, চরাঞ্চলে বেশির ভাগ বারি চিনাবাদাম-৭ ও ৮ এর চাষ হয়। এ ছাড়া, বিনা-৪ ও বিজি-২ এর ফলনও ভালো হয়ে থাকে। সূত্রমতে, বীজ বপনের ১২০ থেকে ১৫০ দিনের মধ্যে চিনাবাদাম পরিপক্ক হয়। রবি মৌসুমের শুরুতে বপন করা চিনাবাদাম এখন ঘরে তোলার মৌসুম। এখন বাদামের সবুজপাতা হলদে রঙ ধারণ করছে। আগাম চাষ করা চিনাবাদাম এখনই তোলার উপযুক্ত সময়।
বিশ্বনাথ চরের বাদাম চাষি নুর মোহাম্মদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আলু তুলে চলতি মৌসুমে সে ২ দোন (২৫ শতকের দোন) জমিতে উপজেলা কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় ও পরামর্শে বাদাম চাষ করেছেন। চিলমারী হাট থেকে দেশি বীজ এবং উপজেলা কৃষি অফিস থেকে বিনা-৪ জাতের বীজ নিয়ে রোপণ করেছেন তিনি। ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত ২ দোন জমিতে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৫ হাজার টাকা। তিনি আশা করছেন, প্রায় ৮ থেকে ১০ মণ বাদাম হবে। বর্তমানে বাদাম ২ হাজার থেকে ২২শ’ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। সব খরচ বাদ দিয়ে নুর মোহাম্মদ এ মৌসুমে বাদামে প্রায় ১৫ হাজার টাকার মতো লাভের আশা করছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, কোথাও বাদাম তোলা হচ্ছে। আবার কোথাও বাদামের চারা পরিপক্ক হয়েছে, তোলার অপেক্ষায় রয়েছে। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চরাঞ্চলের কৃষকরা বাদাম তুলছেন। পরিবারের নারী ও শিশুরাও এ কাজে সহযোগিতা করছেন। বাদাম চাষিরা জানান, রোপণের পর অন্য ফসলের ন্যায় পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয় না। বীজ রোপণ ও বাদাম উঠানোর শ্রমিক খরচ ছাড়া তেমন কোনো খরচ নেই বললেই চলে। কাউনিয়া ৫নং বালাপাড়া ইউনিয়নের চেয়াম্যান আনছার আলী ও মধুপুর ইপি চেয়ারম্যান রাশেদুল ইসলাম জানান, ইউনিয়ন দুটি পুরোপুরি তিস্তা নদীর তীরে। ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকা নদীগর্ভে। কিছু কিছু জায়গায় চর জেগে উঠায় নদীর পাড়ের মানুষ বাদাম চাষ করছে। চাষিদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হলে তারা বাদাম চাষে আরও বেশি আগ্রহী হবে। উপজেলা কৃষি স¤প্রসারণ কর্মকর্তা শাহনাজ পারভীন বলেন, চলতি বছর ৫৫০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ হচ্ছে। কাউনিয়ায় বাদাম চাষের বড় অংশ তিস্তার চরাঞ্চল। কৃষকরা বাদাম চাষে লাভবান হওয়ায় প্রতিবছর বাদাম চাষের পরিমাণ বাড়ছে। কৃষি বিভাগ বাদাম চাষিদের প্রতিবছর বিনামূল্যে বীজ দিয়ে সহায়তা করে থাকে।