আমেরিকা ও চীন-কে আজকাল খুব কমই কোনো বিষয়ে একমত হতে দেখা গেছে। তবে তাইওয়ান প্রসঙ্গে, তারা সহমত। স্ব-শাসিত তাইওয়ান দ্বীপের চারপাশের স্থিতাবস্থা বিপজ্জনক উপায়ে পরিবর্তিত হচ্ছে। একদিকে চীন তাইওয়ানকে নিজেদের বলে দাবি করছে এবং অন্যদিকে এর বিকাশমান গণতন্ত্রকে সমর্থন দিয়ে চলেছে আমেরিকা। তবে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে এখনই যুদ্ধ আসন্ন বলে মনে হচ্ছে না, কিন্তু একটা কথা ঠিক ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে যে শান্তি বিরাজ করতো তা ভঙ্গুর হবার পথে। প্রশ্ন উঠছে কে দোষী ?
আমেরিকার হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের মাধ্যমে এই মাসে প্রভূত সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর সফরকে কেন্দ্র করে দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে। ন্যান্সির সফর ঘিরে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষুব্ধ। পেলোসির পূর্বসূরিদের একজন ১৯৯৭ সালে দ্বীপটি পরিদর্শন করেছিলেন,এদিকে চীনের শীর্ষ কূটনীতিক দাবি করেছেন যে আমেরিকান “নাশকতাকারীরা” স্থিতাবস্থাকে ধ্বংস করেছে।তাইওয়ানকে শিক্ষা দিতে পেলোসি চলে যাওয়ার পরে, চীন দ্বীপের উপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার পাশাপাশি লাইভ-ফায়ার ড্রিলস সংঘটিত করে যুদ্ধের মহড়া হিসেবে। ১৯৯৫-৯৬ সালের পূর্ববর্তী স্থবিরতার পর থেকে আমেরিকা, চীন এবং তাইওয়ান সকলেই একটা অস্বস্তিকর দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
চীন, বিশেষ করে তার রক্তচক্ষু দেখতে শুরু করেছে। বিশ্বকে যদি যুদ্ধ এড়াতে হয়, তাহলে জরুরিভাবে একটি নতুন ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। আংশিকভাবে এটি গত অর্ধ শতাব্দীর শ্বাসরুদ্ধকর পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করে।তাইওয়ান সামরিক একনায়কত্ব ছেড়ে ২৪মিলিয়ন মানুষকে নিয়ে একটি সমৃদ্ধ, উদার গণতন্ত্রে পরিণত হয়েছে, যাদের প্রায় সবাই হান চীনা।এর নাগরিকরা মূল ভূখ-ের বাসিন্দাদের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি ধনী। তাদের সাফল্য হল চীনের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে কড়া জবাব। তাইওয়ানের রাষ্ট্রপতি, সাই ইং-ওয়েন, স্বাধীনতার দিকে কোনও আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেননি, তবে দ্বীপটি মূল ভূখ- থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। চীনের “এক দেশ, দুই ব্যবস্থা” প্রস্তাবটি হংকং-এর নাগরিক স্বাধীনতাকে চূর্ণ করেছে, তাদেরও একই চুক্তি দেয়া হয়েছিল । আবশ্যক আক্রমণকে ঠেকাতে আজ খুব কম তাইওয়ানিরা বলে যে তারা অবিলম্বে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা চায়।
আমেরিকাও বদলে গেছে। ১৯৫০-এর দশকে তাইওয়ানকে দুবার রক্ষা করার জন্য হস্তক্ষেপ করেছিল আমেরিকা। তখন তাদের মনে হয়েছিল তাইওয়ানকে রক্ষা করা কি আদৌ যুক্তিযুক্ত ছিল? কিন্তু সেই ধারণা বদলেছে। দ্বীপের গণতান্ত্রিক সাফল্য এবং সেমিকন্ডাক্টর তৈরির উৎস হিসাবে এর গুরুত্ব আমেরিকা উপলব্ধি করতে পেরেছে । আজ জাপানের মতো মিত্ররা তাইওয়ানের প্রতি দৃঢ় সমর্থনকে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাবশালী এবং নির্ভরযোগ্য শক্তি হিসেবে আমেরিকার অবস্থানের পরীক্ষা হিসেবে দেখে।আমেরিকা তাইওয়ানকে সরাসরি রক্ষা করার জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি দেয়নি, পরিবর্তে “কৌশলগত অস্পষ্টতার” নীতি গ্রহণ করেছে ।কিন্তু ক্রমবর্ধমান চীন-আমেরিকান প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে এবং ওয়াশিংটনের রাজনীতিবিদরা চীনের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার জন্য আজ তাইওয়ানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমেরিকা যে যোগ দেবে তাতে সন্দেহ নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সেকথা বারবার বলেছেন। যদিও প্রতিবার তার কর্মীরা এপ্রসঙ্গে মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছেন।
তবে স্থিতাবস্থা নষ্ট করার জন্য চীনের চেয়ে বেশি পদক্ষেপ কেউ করেনি । তাইওয়ানের শান্তি স্থায়ী হবে কিনা তা মূলত প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের উপর নির্ভর করে। চীন যেমন ধনী হয়েছে, তেমনি তিনি বিদেশী শক্তিকে ঠেকাতে একটি কুৎসিত, বিকারগ্রস্ত জাতীয়তাবাদকে লালন করেছেন। তিনি ২০৪৯ সালের মধ্যে “জাতীয় পুনরুজ্জীবন” এর লক্ষ্যে তাইওয়ানকে যুক্ত করতে চাইছেন ।চীনের সশস্ত্র বাহিনী জোর করে দ্বীপটি দখল করার ক্ষমতা তৈরি করছে; এর নৌবাহিনীতে এখন আমেরিকার চেয়ে বেশি জাহাজ রয়েছে। ওয়াশিংটনের কিছু জেনারেল মনে করেন আগামী দশকে একটি আক্রমণ ঘটতে পারে। সৌভাগ্যবশত, এই সংকটে চীনের কর্মকা- পেশীবহুল কিন্তু এখনো পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। চীন শক্তি প্রদর্শনের লক্ষ্যে বাহিনী মোতায়েন শুরু করেছে তবে এখনই যুদ্ধের পথে হাঁটছে না ।আমেরিকাও একই ধরনের সংকেত পাঠিয়েছে।তারা একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের নিয়মিত পরীক্ষা স্থগিত করেছে। শুধু তাই নয় পেলোসির বিমানটি দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা ঘাঁটির উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া এড়াতে বিকল্প পথের আশ্রয় নিয়েছিল। এখন বিপদ হল চীন দখলের জন্য নতুন সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাইওয়ানের আকাশসীমা এবং আঞ্চলিক জলসীমা বিবেচনা করে সংকট তৈরী করতে পারে । এটি বিশ্বের বাকি অংশের সাথে দ্বীপের লেনদেনে আরও কঠোর সীমা আরোপ করার চেষ্টা করতে পারে।
এটা ঘটতে দেয়া যায় না। আমেরিকা এবং তার মিত্রদের কাজ হল লড়াই না করে এই প্রচেষ্টাগুলিকে প্রতিহত করা। আমেরিকা সঙ্কটের আগে যে নিয়মগুলি ছিল তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে। অবিলম্বে তাইওয়ানের চারপাশে সামরিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে পারে আমেরিকা, উদাহরণস্বরূপ বলা যায় তাইওয়ান প্রণালী দিয়ে ট্রানজিট এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় অপারেশন যা চীন তার নিজের বলে দাবি করে। পাশাপাশি মিত্রদের সাথে সামরিক মহড়া সম্প্রসারণ চালিয়ে যেতে পারে আমেরিকা। চীন যখন তাইওয়ানের আশেপাশে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল তখন জাপান বিরক্ত হয়েছিল এবং ইঙ্গিত দিয়েছিল যে যুদ্ধ হলে তারা সেই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে পারে। উদ্দেশ্য হল চীনকে বোঝানো যে এই ধরনের আক্রমণ সঠিক নয়। তাইওয়ানকে আরও প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য এখন কংগ্রেসের সামনে তাইওয়ান নীতি আইন বা Taiwan Policy Act (tpa)বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু তাইওয়ানের দরকার ছোট, মোবাইল অস্ত্র ঠিক যেমন ইউক্রেনের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি। ইউক্রেনের মতো তাইওয়ানকেও আত্মরক্ষার জন্য আরও সদিচ্ছা দেখাতে হবে। এর সশস্ত্র বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি, অপচয় ও কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত।
কোনো কোনো দেশ চীনের পাশে দাঁড়িয়ে সমস্যা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। জি -৭ সামিটে জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ চীনের ক্ষেপণাস্ত্র-লবিংয়ের নিন্দা করলেও দক্ষিণ কোরিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো চীনের পাশে রয়েছে। এমনকি চীনের আগ্রাসনের নিন্দা করলেও, বাইডেন প্রশাসনের জোর দেওয়া উচিত যে তারা তাইওয়ানের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতাকে সমর্থন করে না। উত্তেজনা এড়াতে কংগ্রেসের প্রতীকী পদক্ষেপগুলি এড়ানো উচিত – যেমন ওয়াশিংটনে তাইওয়ানের প্রতিনিধি অফিসের নামপরিবর্তন করা। কেউ যুদ্ধ চায় না । মিঃ শির সমস্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য, তার অগ্রাধিকার হল ক্ষমতার উপর দখল রাখা। এখানে একটা বিষয় ভুলে গেলে চলবে না ইউক্রেনের আগ্রাসন শিক্ষা দিয়ে গেছে একটি সহজ জয়ও বড়োসড়ো সংগ্রামে পরিণত হতে পারে।
সূত্র : ইকোনোমিস্ট