প্রায় ৪৩ বছর আগের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস অপ্রতিরোধ্যভাবে পাশ করে ‘তাইওয়ান সম্পর্ক আইন’ (The Taiwan Relations Act)। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার সেই আইনে স্বাক্ষর করেন। এই আইনই এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। তাইওয়ান সম্পর্কে আইনটি গণতান্ত্রিক তাইওয়ানের প্রতি আমেরিকার প্রতিশ্রুতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই আইন একটি অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের কাঠামো তৈরি করেছে। এটি দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র-তাইওয়ান সম্পর্কের একটি মূল অংশীদারত্বে পরিণত হয়। দুই দেশের মধ্যে আইনটি গভীর বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে। এর মূলে রয়েছে কিছু অংশিদারত্বমূলক স্বার্থ ও মূল্যবোধ :স্বসংকল্প ও স্বশাসন, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা, মানব মর্যাদা ও মানবাধিকার। একই সঙ্গে এই আইন তাইওয়ানের প্রতিরক্ষাকে সমর্থন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি গৌরবময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেই প্রতিশ্রুতি হলো :‘শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাইওয়ানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের যে কোনো প্রচেষ্টা বিবেচনা করা … পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি ও গুরুতর উদ্বেগের বিষয়গুলো আমলে নেওয়া।’ আজ আমেরিকাকে সেই ব্রত অবশ্যই মনে রাখতে হবে। আমাদের অবশ্যই তাইওয়ানের পাশে দাঁড়াতে হবে। এটি একটি স্থিতিস্থাপক দ্বীপ। তাইওয়ান বিশ্বের এমন একটি নেতৃস্থানীয় দেশ, যারা বর্তমানে পরিবেশ সংরক্ষণ এবং কোভিড-১৯ মহামারি ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তাইওয়ান শান্তি, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক গতিশীলতার দিক থেকেও একটি নেতৃস্থানীয় দেশ। দেশটির উদ্যোক্তামূলক মনোভাব, উদ্ভাবনের সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য ঈর্ষণীয়। ফ্রিডম হাউজের স্বীকৃতি অনুযায়ী তাইওয়ান স্পন্দনশীল ও শক্তিশালী গণতন্ত্রিক একটি সমাজ। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা মুক্ত সমাজের মধ্যে একটি। অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে একজন নারী প্রেসিডেন্ট সেটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার নাম সাই ইং-ওয়েন। কিন্তু তার পরও তাইওয়ান বিরক্তিকরভাবে নিরাপত্তাগত হুমকির মুখে রয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেইজিং তাইওয়ানের সঙ্গে নাটকীয়ভাবে উত্তেজনা তীব্রতর করেছে। পিপলস রিপাবলিক অব চায়না (পিআরসি) তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা অঞ্চলের কাছাকাছি এবং এমনকি তার ওপরে বোমারু বিমান, যুদ্ধবিমান ও নজরদারি বিমানের টহল বাড়িয়েছে। এই পদক্ষেপের ফলে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, চীনের সেনাবাহিনী ‘সম্ভবত বল প্রয়োগ করে হলেও তাইওয়ানকে পিআরসির সঙ্গে একীভূত করতে একটি আকস্মিক পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ এছাড়া পিআরসি এটাকে সাইবার যুদ্ধের দিকেও টেনে নিয়ে গেছে। প্রতিদিন তাইওয়ানের সরকারি সংস্থাগুলোতে সাইবার আক্রমণ শুরু করেছে। একই সময়ে বেইজিং তাইওয়ানকে অর্থনৈতিকভাবে চাপ দিচ্ছে, দ্বীপের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য বিশ্বব্যাপী করপোরেশনগুলোকে চাপ দিচ্ছে, তাইওয়ানের সঙ্গে সহযোগিতাকারী দেশগুলোকে ভয় দেখাচ্ছে এবং পিআরসি থেকে পর্যটন বন্ধ করে দিচ্ছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) এই ত্বরান্বিত আগ্রাসনের মুখে, আমাদের কংগ্রেসের প্রতিনিধিদলের সফরকে একটি দ্ব্যর্থহীন বিবৃতি হিসেবে দেখা উচিত, যার মর্মার্থ হলো আমেরিকা আমাদের গণতান্ত্রিক অংশীদার তাইওয়ানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কারণ এটি তাইওয়ান ও তার স্বাধীনতাকে রক্ষা করে।
দ্বীপটিতে আমাদের কংগ্রেসের বেশ কয়েক জন প্রতিনিধির সফর কোনোভাবেই দীর্ঘস্থায়ী এক চীন নীতির বিরোধিতা করে না, যা ১৯৭৯ সালের তাইওয়ান সম্পর্ক আইন, ইউএস-চীন জয়েন্ট কমিউনিক এবং ছয়টি আশ্বাস দ্বারা পরিচালিত। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের একতরফা প্রচেষ্টার বিরোধিতা করে চলেছে।
আমাদের সফরটি ছিল প্রশান্ত মহাসাগরে বিস্তৃত সফরেরই অংশ। তাইওয়ানের পাশাপাশি আমাদের সফরে অন্তর্ভুক্ত ছিল সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। এই সফর পারস্পরিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব ও গণতান্ত্রিক শাসনের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। তাইওয়ানে অংশীদারদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা এই দ্বীপের প্রতি আমাদের সমর্থন পুনর্নিশ্চিত করেছে। এর মাধ্যমে একটি মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অগ্রগতিসহ আমাদের অংশিদারত্বমূলক স্বার্থের প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাইওয়ানের সঙ্গে আমেরিকার একাত্মতা আজ আগের চেয়ে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু এই দ্বীপের ২৩ মিলিয়ন মানুষের জন্য নয়, পিআরসি (পিপলস রিপাবলিক অব চায়না) দ্বারা নিপীড়িত ও হুমকির শিকার আরো লক্ষাধিক মানুষের জন্যও। ৩০ বছর আগে আমি একটি দ্বিদলীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে চীন সফর করেছিলাম। সে সময় তিয়ান আনমেন স্কোয়ারে আমরা একটি সাদা-কালো ব্যানার উড়িয়ে দিয়েছিলাম, যাতে লেখা ছিল, ‘যারা চীনে গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিয়েছে’। আমরা স্কয়ার থেকে বের হওয়ার সময় ইউনিফর্মধারী পুলিশ আমাদের পিছু নেয়। তারপর থেকে বেইজিংয়ের মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজিরবিহীন রেকর্ড অব্যাহত রয়েছে। তখন থেকে আইনের শাসনের প্রতি অব্যাহত রয়েছে বেইজিংয়ের অবজ্ঞা। কারণ রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং তার ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছেন।
হংকংয়ের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধে সিসিপির (চায়না কমিউনিস্ট পার্টি) নৃশংস হস্তক্ষেপ এমনকি ক্যাথলিক কার্ডিনাল জোসেফ জেনকে গ্রেপ্তার করা এ সবই ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ (One country, two system)-এর প্রতিশ্রুতিকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছে। সিসিপি তিব্বতে দীর্ঘদিন ধরে তিব্বতের জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও পরিচয় মুছে ফেলার প্রচারণা চালিয়ে আসছে। বেইজিং জিনজিয়াংয়ে মুসলিম উইঘুর ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে। এবং সমগ্র মূল ভূখ- জুড়ে সিসিপি গণতান্ত্রিক কর্মী, ধর্মীয় স্বাধীনতার নেতা এবং অন্যদের যারা শাসনকে অস্বীকার করার সাহস রাখেন, তাদের লক্ষ্যবস্তু ও গ্রেফতার করা অব্যাহত রেখেছে।
সিসিপি তাইওয়ান ও এর গণতন্ত্রকে হুমকি দেওয়ার জন্য আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি না। প্রকৃতপক্ষে, আমরা এই সফর এমন এক সময়ে করি, যখন বিশ্ব স্বৈরাচার ও গণতন্ত্রের মধ্যে কোনটি বেছে নেবে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। যেহেতু রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তার পূর্বপরিকল্পিত ও অবৈধ যুদ্ধ চালাচ্ছে, হাজার হাজার নিরপরাধ এমনকি শিশুকেও হত্যা করেছে, এজন্য আমেরিকা ও আমাদের মিত্রদের এটা স্পষ্ট করে দেওয়া অপরিহার্য যে, আমরা কখনই স্বৈরাচারীদের কাছে নতি স্বীকার করব না। গত এপ্রিল মাসে আমি ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। অবরুদ্ধ দেশটিতে এটিই ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের মার্কিন সফর। সে সময় আমি রাষষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কিকে জানিয়েছিলাম, ইউক্রেন ও তার জনগণ এবং বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের জন্য তাদের লড়াই-সংগ্রামের আমরা প্রশংসা করি। অতএব, এই তাইওয়ান সফরের মাধ্যমে আমরা গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের অঙ্গীকারকে সম্মান করেছি :তাইওয়ানের স্বাধীনতা এবং সমস্ত গণতন্ত্রাতিক দেশের প্রতি আমাদের যে অবশ্যই সম্মান প্রদর্শন করা উচিত, সেটা নিশ্চিত করেছি। ( দৈনিক ইত্তেফাকের সৌজন্যে) লেখক :যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের ৫২তম স্পিকার দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে অনুবাদ : ফাইজুল ইসলাম