মজুতদার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে চালের দাম। এ নিয়ে ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাত দেখালেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা। অফ সিজনে ধান-চালের রাজ্য বলে খ্যাত বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের ঘরে এখন ধান নেই। চলমান দর বৃদ্ধিতে মজুতদারদের পকেট ভারি হলেও বঞ্চিত হচ্ছেন চাষিরা। বাজারে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে সরু ও মোটা চালের কেজিপ্রতি বেড়েছে ৪-৫ টাকা। ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি ২০০-২৫০ টাকা বেড়েছে। এ অঞ্চলের কয়েক হাজার অটোমেটিক ও হাসকিং চাউল কলে উৎপাদিত লাখ লাখ মেট্রিক টন চাল সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। এখানকার মোকামে দাম বৃদ্ধি পেলে অস্থির হয়ে উঠে দেশের বাজার। ইতিমধ্যে পাইকারিতে দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় খুচরা বাজারেও। এদিকে চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন নি¤œআয়ের মানুষ। চাল কিনতেই পকেট ফাঁকা হচ্ছে তাদের। ২০২১-২০২২ বোরো মৌসুমে এ অঞ্চলের হাট-বাজারে ধানের ছড়াছড়ি হলেও সেসময় নতুন চালের তেমন একটা দেখা মেলেনি। পাইকারি মোকাম থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত সবখানেই বিক্রি হয়েছে পুরাতন চাল। ‘বোরো মৌসুমে উৎপাদিত লাখ লাখ মেট্রিক টন চাল গেলো কই’ প্রশ্নের উত্তরে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড় বড় চালকলের মালিক, প্রভাবশালী মজুতদার সিন্ডিকেট ও কর্পোরেটদের কালো থাবায় গুদাম ভর্তি হয়েছে এবারের অধিকাংশ ধান-চাল। তাই দিনদিন বাজার অস্থির হয়ে উঠছে। মিলগেটে চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। খুচরা ব্যবসায়ীদের দাবি- সংশ্লিষ্টরা মনিটরিং করলেও তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না। সিন্ডিকেটের কারণেই চালের বাজার ঊর্ধ্বোমুখী হচ্ছে বলেও দাবি তাদের। আর মিল মালিকরা বলছেন, সরবরাহ কম থাকায় বাজারে ধানের দাম বাড়তি। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে ধান-চাল পরিবহনে খরচ বেড়েছে। নতুন আমন ধান বাজারে আসতে প্রায় তিন মাস বাকি। পর্যাপ্ত পরিমাণে চাল আমদানি করা না গেলে আগামী তিন মাস চালের দাম কমার সম্ভাবনা দেখছেন না পাইকারি চাল ব্যবসায়ীরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের অন্যতম ধান উৎপাদনকারী জেলা নওগাঁর বাজারে মোটা স্বর্ণা-৫, ৫৪-৫৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। যা এক সপ্তাহ আগে ছিল কেজিতে ৫০ টাকা। এছাড়াও সরু চাল জিরাশাইল কেজিতে ৪-৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকা, কাটারি ৭২-৭৪ টাকা এবং বিআর-২৮, ৫৮-৬০ টাকা। রাজশাহীর বাজারে ৫০ কেজি ওজনের স্বর্ণা-৫ চালের বস্তা গেল সপ্তাহে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হলেও এ সপ্তাহে দাম বেড়ে তা ২ হাজার ৭০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। জিরাশাইলের দাম ৩ হাজার ৪০০ থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা, কাটারি ৩ হাজার ৪০০ থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৫৫০ টাকা। মিনিকেট ৫০ কেজির বস্তার দাম ৩ হাজার ২০০ টাকা থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৩৫০ টাকায় উঠে গেছে। আঠাশ দাম ২ হাজার ৯০০ থেকে বেড়ে ৩ হাজার ১০০ টাকা। পোলার চাল হিসাবে খ্যাত চিনিগুড়া (আতব) চাল ৫ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হলেও সপ্তাহে বেড়েছে ৭০০ টাকা; এখন বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার টাকায়। নওগাঁ ক্ষুদ্র চাল বাজারের সাধারণ সম্পাদক নূর-নবী বলেন, গত এক সপ্তাহে সরু চালের পাশাপাশি মোটা চালের দাম কেজিতে ৪-৫ টাকা বেড়েছে। নি¤œআয়ের পরিবারগুলো ভাতের পাশাপাশি আটা ব্যবহার করতেন। কিন্তু তারা সেই পরিমাণ আটা পাচ্ছে না। ফলে মোটা চালের উপর ঝুঁকেছেন নি¤œবিত্তরা। আর এ কারণেই মোটা চালের দামও বেড়েছে। রাজশাহীর সাহেববাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মো: বদিরুল আলম সুজন বলেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অতিরিক্ত দাম পাবার আশায় চাল মজুত করে রাখছেন মিল মালিকরা। দাম বাড়ানোর নেপথ্যে একটা অদৃশ্য সিন্ডিকেট কাজ করছে। জনগণকে জিম্মি করে এক শ্রেণীর অসাধু মিল মালিকরা মুনাফা করতে চায়। এখনও বোরো মৌসুমের নতুন চাল বাজারে আসেনি। এ কারণে দাম আরও বৃদ্ধি পাবে। মজুতদারদের কৈফিয়ৎ হিসেবে এখন জ্বলানি তেলের দাম বৃদ্ধি যোগ হয়েছে। যখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়েনি তখন কি কারণে চালের দাম বেড়েছে- মিল মালিকদের উদ্দেশ্যে এমন প্রশ্ন রাখেন এই বিক্রেতা। অপরদিকে এমন অভিযোগ মানতে নারাজ নওগাঁ ও রাজশাহীর মিল মালিকরা। তারা বলছেন, করোনায় অনেক মিল বন্ধ হয়ে গেছে। ধানের দাম অন্যান্য দু-পাঁচ বছরের চেয়ে বেশি। অবৈধভাবে মিলে চাল গুদামজাত করার সুযোগ নেই বলেও জানান তারা। ধান-চাল মজুদের কথা স্বীকার করেছেন খোদ খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। বোরো ২০২২ মৌসুমে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ ও বাজার মনিটরিং সংক্রান্ত অনলাইন মতবিনিময় সভায় খাদ্যমন্ত্রী বলেন, অধিকাংশ মিল মালিক বাজার থেকে ধান কিনলেও তারা উৎপাদনে যাচ্ছেন না। বাজারে নতুন চাল এখনও আসছে না। বাজারে যে চাল পাওয়া যাচ্ছে তা গত বছরের। নতুন ধান যাচ্ছে কোথায় বলে প্রশ্ন তোলেন সরকারের এই মন্ত্রী। নওগাঁর খুচরা বাজারে চাল কিনতে আসা আব্দুর রহমান, স্বপন কুমার ও মহাদেবপুর উপজেলা সদরের জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এযাবৎ কালের সর্বোচ্চ দামে চাল বিক্রি হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে চরম বিপাকে পড়েছেন। শুধু চাল কিনতেই তাদের পকেট খালি হয়ে যাচ্ছে তাদের। একই কথা বলেন আরও ৩০-৪০ জন নি¤œআয়ের মানুষ। জানতে চাইলে দেশের অন্যতম ধান উৎপাদনকারী জেলা নওগাঁর আব্দুর রহমান, ফরমান হোসেন ও তাহের আলীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের ৪০-৫০ জন ধান চাষি বলেন, অফ সিজনে কৃষকদের ঘরে এখন ধান নেই। মৌসুমের শুরুতেই কৃষকরা সার, সেচ, হালভাড়াসহ উৎপাদন খরচ মিটাতে ধান বিক্রি করে দিয়েছেন। চলমান ধান-চালের দর বৃদ্ধিতে মজুতদারদের পকেট ভারি হলেও চাষিরা বঞ্চিত। নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চাকলাদার বলেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে বোরো ধানের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় শুরু থেকেই এবার বাজারে ধানের দাম চড়া ছিল। এ কারণে ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়েছে। মৌসুমের শেষ দিকে এখন বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় ও মিলারদের মধ্যে কেনার প্রতিযোগিতা থাকায় বোরো ধানের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। যার কারণে চালের দাম বাড়াতে হয়েছে। এ ছাড়া ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি চালের দাম বাড়ার আরেকটি কারণ। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি তাতে বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে চাল আমদানি করা না গেলে তিন মাসের মধ্যে চালের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ আমন মৌসুমের ধান বাজারে উঠতে অন্তত তিন মাস সময় লাগবে। গত রোববার সচিবালয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, আগামী ১ সেপ্টেম্বরে থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে খোলা বাজারে (ওএমএস) সারাদেশে চাল বিক্রি শুরু করবে সরকার। একইসঙ্গে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি শুরু হবে। সেই সঙ্গে চালের বরাদ্দ দ্বিগুণ করা হয়েছে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ও ওএমএসের চাল বিক্রি শুরু হলে বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করেন তিনি।