৩১ জুলাই, ২০২২। কাবুলের সকাল, স্থানীয় সময় ভোর ৬টা ১৮ মিনিটে পরপর দু’টি ক্ষেপণাস্ত্র আয়মান আল জাওয়াহিরির বাড়ির বারান্দায় আঘাত করলে ৭১ বছর বয়সী আলকায়েদা প্রধান নিহত হন। ঘরের ভেতর তার স্ত্রী-কন্যা অক্ষত থাকে। তিনি তখন সকালের নামাজ সেরে বারান্দায় পায়চারি করছিলেন, বলা হচ্ছে- এটি তার নিয়মিত অভ্যাস। মিসাইল হামলা লক্ষচ্যুত হয়ে বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়া নিয়ে বহু সমালোচনার সম্মুখীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু এবার সুনির্দিষ্টভাবে হামলা করল। উল্লেøখ করা যেতে পারে, ইসরাইলি মোসাদ ইরানি বিজ্ঞানীদের হত্যার সময়ও কম্পিউটারাইজড গান ব্যবহার ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। সেসব হত্যাকা-ও নিখুঁত ছিল এবং ঘটনাস্থলে কোনো হত্যাকারীকে উপস্থিত দেখা যেত না। এ ক্ষেত্রে ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুধু নতুন ধরনের মিসাইল নয়, জাওয়াহিরির নিত্যকর্মের সময়সূচি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই এত সুচারুভাবে হামলা করতে সক্ষম হয় মার্কিনিরা, বিশ্লেষকরা এমনই বলছেন। সূক্ষ হামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্ষেপণাস্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রকে মার্কিন কর্মকর্তারা ড্রোন-চালিত হেলফায়ার বলে থাকেন। হেলফায়ারের বারবার ব্যবহারের অন্যতম কারণ হলো- এর নির্ভুলতা। হেলিকপ্টার, স্থলভিত্তিক যানবাহন, জাহাজ, এমনকি ফিক্সড উইং বিমানসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে ক্ষেপণাস্ত্রটি নিক্ষেপ করা যায়। জাওয়াহিরির ক্ষেত্রে মনুষ্যবিহীন একটি ড্রোন থেকে এই মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছে।
এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালের শুরুর দিকে বাগদাদে ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানি ও ২০১৫ সালে সিরিয়ায় জিহাদি জন নামে পরিচিত ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ইসলামিক স্টেটের সিনিয়র সদস্যকে হত্যা করার জন্য হেলফায়ার ব্যবহার করেছিল। জাওয়াহিরির বারান্দায় যাওয়ার অভ্যাস ট্র্যাক করেছিল মার্কিনিরা এবং জাওয়াহিরির দৈনন্দিন জীবনযাপনের খুঁটিনাটি অসংখ্য তথ্য ছিল মার্কিন গোয়েন্দাদের কাছে। মার্কিন গুপ্তচর ও স্থানীয় দোসররা দীর্ঘদিন ধরে বাড়িটি পর্যবেক্ষণে রেখেছিল। বিভিন্ন সিগন্যাল বা ইলেকট্রনিক বার্তা ট্র্যাক করার মতো সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সও ব্যবহৃত হয়েছিল। তা ছাড়া মার্কিন গোয়েন্দাদের কয়েক দশক ধরে আলকায়েদা নেতা ও অন্যান্য গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে পারার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বলা হয়, ২০ বছর ধরে মার্কিন গোয়েন্দারা এমন দক্ষতা অর্জন করেছে। মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান ছাড়ার পর এটি আলকায়েদা বা ইসলামিক স্টেটের ওপর পরিচালিত প্রথম হামলা।
অতীতে পাকিস্তান সীমান্তে ড্রোন হামলা আফগানিস্তান থেকে চালানো হতো। আবার সিরিয়ায় পরিচালিত হামলাগুলো ইরাকের মিত্র অঞ্চলগুলো থেকে হতো। কিন্তু কাবুলের ওই ঘটনায় আশপাশে কোনো মিত্রশক্তি ছিল না। সব মিলিয়ে পুরো পরিকল্পনাই অনেকটা জটিল। জাওয়াহিরি হত্যাকা-কে পেন্টাগন এক অসাধারণ বিজয় হিসেবে অভিহিত করেছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেন, ‘ন্যায়বিচার পাওয়া গেছে ও এই সন্ত্রাসী নেতা আর নেই’। আমেরিকান সংবাদপত্রের রিপোর্টগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, সন্ত্রাসবাদবিরোধী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক বৃদ্ধ ও অসুস্থ জাওয়াহিরির মৃত্যু আলকায়েদার ক্রিয়াকলাপে অবশিষ্টদের মধ্যে কোনো স্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করবে না। এখন অপেক্ষা করতে হবে প্রতিশোধের দংশন কত তীব্র ও যন্ত্রণাদায়ক হয়। যুদ্ধ শুরু হলে ময়দানে কমান্ডারের মৃত্যু তেমন পরিবর্তন আনে না। আলকায়েদার ক্ষেত্রেও তাই।
বলা হচ্ছে, এমন সব হত্যাকা- মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটি পথপ্রদর্শক নীতি। আলকায়েদাকে ল্যাবেল লাগানো হয়েছে সন্ত্রাসী, সন্ত্রাসবাদ, মানবতাবিরোধী, শান্তির পথে অন্তরায়- এ সব দিয়ে। এগুলো জনমানুষের মনমগজ ধোলাই করার পর তাদের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কেননা, আলকায়েদা আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির সমালোচক। তারা ইসরাইলিদের ফিলিস্তিনিদের ওপর অমানবিক আচরণের বিরোধিতা করেছে এবং পরাশক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। মার্টিন লুথার কিং যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় সহিংসতার ধারক’ বলেছিলেন। ড. কিং এ কথা বলার ঠিক এক বছর পর হত্যাকা-ের শিকার হয়েছিলেন। একই রকম কথা জাওয়াহিরিও বলেছিলেন, তাকে খুন করতে ২০ বছর প্রয়োজন হয়।
সন্ত্রাসী তারাই যাদের আমেরিকা তালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু অন্য কোনো দেশে কেউ সন্ত্রাসী কার্যক্রম করলে তাদের উল্টো সমর্থন দেয়া হয়েছে যেমন- তুরস্কের পিকেকে-কুর্দি গোষ্ঠী, হামাস, ইসলামিক জিহাদ ইত্যাদি। আবার অর্থের বিনিময়েও তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়া হয়। পুরো বিষয়টি পশ্চিমাদের রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, জাওয়াহিরি একজন ‘দূষিত অভিনেতা’য় পরিণত হয়েছিলেন। তাকে পেন্টাগন আলকায়েদার প্রধান অপারেটিং অফিসার হিসেবে চিহ্নিত করে। প্রধান নির্বাহী ও প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনের পরে দ্বিতীয়, যার উত্থান কেবল তার আপেক্ষিক ক্যারিশমা এবং তার অর্থ ও বিত্তের অ্যাক্সেসের ওপরও নির্ভর করেছে।
কাউকে হত্যা করার আগে আয়নায় নিজের মুখচ্ছবির বিম্ব নিরীক্ষা করা উচিত। পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে জাওয়াহিরিকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার জন্য একাধিক প্রচেষ্টা চালানো হয়। পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার পর জাওয়াহিরি উত্তরাধিকারী হিসেবে মঞ্চে আবির্ভূত হন। তবে একজন রাহবার বা পরিচালনাকারী তারকা হিসেবে তার কার্যকারিতা তেমন বেশি বিস্তৃত ছিল না। এরপরও তিনি হত্যা-তালিকাভুক্ত হয়েছেন। একজন মিসরীয় সালাফিস্ট হিসেবে তিনি আনোয়ার সাদাতকে হত্যার সম্ভাব্য ভূমিকার জন্য তার মাতৃভূমিতে গ্রেফতার হওয়ার আগে পাকিস্তান সফর করেছিলেন। নাসেরীয় ও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ইসলামী চিন্তাভাবনাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। জাওয়াহিরি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এবং তার কিছু সহকর্মীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার বাধ্যবাধকতা অনুভব করেছিলেন। এসব তার মতাদর্শকে কঠোরভাবে শানিত করে এবং তিনি মধ্যপন্থা থেকে চরমপন্থার দিকে ঝোঁকেন।
তার মুক্তির পর টেকনিক্যালি মিসর ত্যাগ করার কথা ছিল না, তবুও তিনি জেদ্দায়, পরে পেশোয়ারে ফিরে যান। জেদ্দায় তিনি বিন লাদেনের মুখোমুখি হয়েছিলেন কি না তা স্পষ্ট নয়, তবে উভয়ে পেশোয়ারে ঐক্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। জাওয়াহিরির মূল প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি ছিল সৌদি এই মিলিনেয়ারকে তার ফিলিস্তিনি পরামর্শদাতা আবদুল্লাহ আজামের প্রভাব থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া।
মৌলবাদীদের সংঘর্ষ শেষ পর্যন্ত জাওয়াহিরির পক্ষে কাজ করেছিল। ১৯৮৯ সালে পেশোয়ারে আজামের হত্যার পেছনে কে ছিল তা কখনো পরিষ্কার ছিল না।
তা সত্ত্বেও তিনি শেষ পর্যন্ত তার ইসলামী জিহাদকে আলকায়েদার সাথে একীভূত করতে পেরেছিলেন বা বাধ্য হয়েছিলেন। এর আগে, ১৯৯৫ সালে ইসলামাবাদে মিসরীয় দূতাবাসে হামলার পরিকল্পনাকারী ছিলেন বলে মনে করা হয়। এ জন্য পাকিস্তানও জাওয়াহিরির ওপর ক্ষিপ্ত। উল্লেখ্য, তার দাদা পাকিস্তানে মিসরীয় রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং জাওয়াহিরি বিখ্যাত লাল মসজিদ ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন। সেটি আরো একটি বিরাট উপাখ্যান। জানা যায়, জাওয়াহিরির কিছু আত্মীয়স্বজন পেশোয়ারে রয়েছে। এতে গোয়েন্দারা সহজে তাকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।
সুদান ও আফগানিস্তানে তিনি বসবাস করেন। মধ্য এশিয়ায়ও তিনি ঘোরাফেরা করেন। ১০ বছর আগে ওয়াজিরিস্তানে তাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার কয়েকটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। এতে পাকিস্তানি গোয়েন্দারা জড়িত ছিল কি না তার কোনো বিবরণ পাওয়া যায়নি। কাবুলে তিনি সিরাজউদ্দিন হাক্কানির সুরক্ষায় ছিলেন, হাক্কানি শক্তিশালী পাকিস্তানি সংযোগের, দীর্ঘ ইতিহাসের তালেবান অনুমোদিত নেটওয়ার্কের প্রধান ছিলেন, যা হাক্কানি নেটওয়ার্ক নামে পরিচিত। আমেরিকা নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার মূল স্থপতি হিসেবে জাওয়াহিরিকে তুলে ধরেছে। বলা হয়- সাফল্যের অনেক বাবা থাকে। অধ্যবসায়ী তরুণ ডাক্তার সালাফিবাদী উচ্চাকাক্সক্ষা নিজ জন্মভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়ে ‘জিহাদিবাদে’ বিকশিত হয়েছেন বলে মনে করা হয়।
আল-কায়েদা প্রধানকে ড্রোন দিয়ে হত্যা করার অনেক আগেই তার মাথার জন্য ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। হত্যার ঘটনায় সিআইএ কিভাবে ওই অভিযান চালিয়েছে তা নিয়ে জোরালো প্রশ্ন উঠেছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিদেশী বাহিনী প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে ও পাকিস্তানে সিআইএর ঘাঁটি নেই। মার্কিনবাহিনী কাবুল ত্যাগের পরপরই তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে নেয়।
সিআইএ হামলার মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া ও মার্কিন সেন্টকম প্রধানের মধ্যে টেলিফোনে কথোপকথন হয়। ওখান থেকেই ওই ড্রোন হামলায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার জল্পনা শুরু হয় এবং পাকিস্তান ও আফগান রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। সেনাপ্রধান জানান, ‘আয়মান আল-জাওয়াহিরিকে হত্যার বিষয়টি আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’ কিন্তু আলকায়েদা তো কোনো অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়।
বলা হচ্ছে, ড্রোনটি কোন স্থান থেকে উড্ডয়ন করেছে? পাকিস্তান থেকে উড়ে এসেছে নাকি পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করেছে? ড্রোনের উড্ডয়ন কেন্দ্র কোথায়, তা অনেকে চিন্তাভাবনা করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ড্রোনের রুট বা ফ্ল¬াইট রুট প্রকাশ করেনি, তাই একটি ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। বাইডেন প্রশাসন ওই অঞ্চলে ভবিষ্যতে সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানে ড্রোন ব্যবহারের জন্য সীমান্তে একটি বিমান ঘাঁটি স্থাপনের বিষয়ে পাকিস্তানের সাথে চুক্তি করতে চায়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মার্কিন গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি কখনোই যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের মাটি থেকে অন্য কোনো ভূখ-ে আক্রমণ চালানোর জন্য ঘাঁটি ব্যবহার করতে দেবেন না। যখন ইমরানকে জিজ্ঞাসা করা হয়, পাকিস্তান একটি ঘাঁটির জন্য মার্কিন অনুরোধ বিবেচনা করবে কি না, তখন তিনি শক্ত উত্তর দিয়েছিলেন- ‘একেবারেই না’। মার্কিন কর্মকর্তারা জোর দিয়েছিলেন, সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য দেশটির নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে চেয়েছিল। এদিকে, পাকিস্তান এখনো আলকায়েদাপ্রধানকে হত্যার বিষয়ে তেমন প্রতিক্রিয়া জানায়নি, যদিও সৌদি আরবসহ অন্যান্য অনেক দেশ এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে।
গত এপ্রিলে শাহবাজ শরিফ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ক্রমহ্রাসমান অর্থনীতির কারণে রুপির মূল্য প্রতি ডলারে ৩০ শতাংশ বা ৫৫ টাকা কমে গেছে, যা শরিফ প্রশাসনের অনভিজ্ঞতাকেও প্রকাশ করেছে। অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও রুপির অবমূল্যায়নের ফলে মুদ্রাস্ফীতি আকাশছোঁয়া হয়ে যাওয়ায়, দুর্দশা পাকিস্তানকে ঘিরে ধরেছে। সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া ওয়াশিংটনে গিয়ে আইএমএফকে অবিলম্বে প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করছেন। বিশ্বব্যাংক এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক থেকে আরো ১.৪ বিলিয়ন ডলারের তহবিলও আনলক করার প্রচেষ্টা চলছে। এই জরুরি বিষয়টি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বরাবরও পৌঁছেছে। বিদেশী প্রকাশনার খবরে বলা হয়, পাকিস্তানি সেনাপ্রধান মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরম্যানের সাথেও ফোনালাপ করেছেন। শাহবাজ শরিফ সরকার রাজনীতিতে ইমরান দলের বিপরীত। আমেরিকার স্বার্থ রক্ষিত না হওয়ায় ইমরানকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। ইমরান খান শরিফ সরকারকে ‘আমদানি করা সরকার’ বলে আমেরিকা ও শরিফ উভয়কে ব্যঙ্গ করেন। বাজওয়া ও শরিফ সরকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা প্রভাবিত কি না তা স্পষ্ট নয়। ওয়াজিরিস্তানে তেহরিক-ই-তালিবান (টিটিপি) দখলকৃত এলাকা স্বায়ত্তশাসনে দেয়ার জন্য বাজওয়া চীনও সফর করেন। যদি সরকার বা সেনাবাহিনী কোনো সমস্যায় পড়ে তখন যেন তালেবান, আলকায়েদা, আইএস ও তেহরিক-ই-তালেবান একই সাথে জোট না বাঁধতে পারে সে জন্য টিটিপি ইস্যু হজম করেছে বলে প্রতিভাত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু গণমাধ্যম সর্বশেষ দাবি করেছে, জাওয়াহিরিকে হত্যায় ব্যবহৃত ড্রোনটি কিরগিজস্তান থেকে উড়ে এসেছে। এর আগে ধারণা করা হয়েছিল, পাকিস্তান আকাশসীমা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোপন অভিযানের জন্য ব্যবহার করেছিল। মার্কিন গণমাধ্যম এখন বলছে, উত্তর কিরগিজস্তানের গানসি এয়ার বেজ থেকে ওই হামলা চালানো হয়েছে।
গানসি কিরগিজস্তানে বিশকেক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে পুরনো এক মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। বিমানঘাঁটিটি ২০১৪ সাল পর্যন্ত মার্কিন বিমানবাহিনী ব্যবহার করেছে, পরে এটি কিরগিজ সামরিক বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে, ড্রোনটি কোন পথে গিয়েছিল এবং এটি কোথা থেকে উড্ডয়ন করেছিল সে সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিস্তারিত কিছু জানায়নি।
জানা গেছে, মার্কিন ড্রোনটি জাওয়াহিরিকে আঘাত করার জন্য হেলফায়ার আর৯এক্স ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল। এটি ‘ওয়্যারহেডলেস’ মিসাইল যা সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে। এই অস্ত্র ২০১৭ সালের মার্চ মাসে আলকায়েদা নেতা আবুল আল খাইয়ার আল মাসরকে হত্যায় ব্যবহৃত হয়েছিল। এই ক্ষেপণাস্ত্রটিকে ‘উড়ন্ত জিনসু’ ও ‘নিনজা বোমা’ নামেও ডাকা হয়। নেতাদের হত্যা করার জন্য এটি যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। ২০১১ সালে আলকায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর থেকে বর্তমান অভিযানটি ছিল আলকায়েদার জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত। আলকায়েদা, এক সপ্তাহের মধ্যে ওসামা বিন লাদেনের হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত করলেও, তারা এখন পর্যন্ত জাওয়াহিরি সম্পর্কে নীরব। আফগানিস্তানে জাওয়াহিরির উপস্থিতি আফগান তালেবানদের স্বাক্ষরিত দোহা চুক্তির লঙ্ঘন বলে আগেই ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দোহা চুক্তিতে আফগান তালেবানরা আলকায়েদা ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে সম্মত হয়েছিল।
আফগানিস্তানের তালেবান সরকার ঘটনার ছয়দিন পর জানিয়েছে, জাওয়াহিরির মৃত্যুর কোনো তথ্যই তাদের কাছে নেই- এ সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ মেলেনি। বাড়িটির কোথাও বিস্ফোরণের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। জাওয়াহিরি মৃত নাকি জীবিত, তা নিয়ে নানা স্তরে শুরু হয়েছে দাবি-পাল্টা দাবি ও জল্পনা। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জন কার্বি ঘটনার একদিন পর জানান, জাওয়াহিরির মৃত্যুর সপক্ষে তার ডিএনএ সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ নেই। তালেবান সরকারের সাথে উগ্রবাদ-যোগ স্পষ্ট প্রমাণিত হলে আন্তর্জাতিক সাহায্য পাওয়ার প্রশ্নে আরো সঙ্কটে পড়বে আফগানিস্তান। সমালোচক ও বিশ্লেষকরা এখন অনেক কথাই বলছেন। জাওয়াহিরির বিরুদ্ধে অভিযোগ যতই দীর্ঘ হোক না কেন, বিশ্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যেন আন্তর্জাতিক দাবাবোর্ডে বিচারক, জুরি ও জল্লাদ খেলার জন্য মুক্ত করে দিয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের পরাশক্তিরও একটি চিহ্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশকে সন্ত্রাসবাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষক মনে করে। তবে এ বিবরণে ইসরাইলের নাম নেই। কোনো রাষ্ট্রই আলকায়েদা, আইএস, বোকোহারামের মতো সংগঠনগুলোর সংঘটিত অযৌক্তিকভাবে ঘৃণ্য সহিংসতাকে তাদের নিজেদের মারাত্মক বাড়াবাড়ির অজুহাত হিসেবে তুলে ধরতে পারে না। তাই আজ, জাওয়াহিরির জন্য কোনো অশ্রু নেই, তার হত্যাকারীদের জন্যও কোনো হাততালি নেই। লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার