পেটের দুপাশে ভারী বোঝা আর মরুভূমির তপ্ত সূর্যটাকে মাথায় নিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে উট। তার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পিঠে উপবিষ্ট হাদি বা রাখাল প্রতি পদক্ষেপে বুনছে গান। এক সুরের ও সরল গঠনের আরবি রজয ছন্দের সে গান চলবে গন্তব্যের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। হিদা নামে পরিচিত এ গান আরবের মরুসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কেউ জানে না, কখন এ গানের প্রচলন হয়েছিল। কিন্তু বালিময় সমুদ্র পেরিয়ে উট ও রাখালের নিঃসঙ্গতা দূরকারী এ সংগীত আজও টিকে আছে। রাখালের গুনগুন বোলের সঙ্গে আরবের মরুপথে তা ছড়িয়ে গেছে দূরকে দূর। বেদুইনের অনিশ্চিত গন্তব্যের সঙ্গী এ হিদা সংগীতের পদচিহ্ন ধরে আরবি সংগীত আরব উপদ্বীপ থেকে যাত্রা করে ইরাক, মিসর আর আন্দালুস পেরিয়ে স্বর্ণ আখরে নিজের নামটি লিখিয়েছে এসব রাজ্যের রাজপ্রাসাদে। এ কথা সত্য যে আরবের সংগীতের যে অনন্য উচ্চতা আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি তা মূলত শুরু হয়েছে উনিশ শতকের শেষ দিকে, আরব পুনর্জন্মের ভেতর দিয়ে। তখন থেকে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয়-চতুর্থাংশ পর্যন্ত এর অভিযাত্রা সদর্পে বহাল ছিল। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় তিন হাজার বছর আগে নীল নদের তীরে বাস করত এমন এক জাতির কথা আমরা জানতে পারি। সেখানে সংগীতে সমৃদ্ধ এক নগর ছিল। শোনা যায়, সে নগরে বাদ্যযন্ত্রের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল এবং ঘাত, শুষির ও তত প্রভৃতি শ্রেণীর বাদ্যযন্ত্র সেখানেই পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। মিসরীয় লোকেদের সংগীত যখন নীল নদের তীরকে আন্দোলিত করছিল তখন মেসোপটেমিয়া ও এর আশপাশে বাবেল ও আশুরের মতো সংগীতের লীলাভূমি আমরা দেখতে পাই। কানানি, ফিনিকি ও হিট্টিরাও এ লীলাভূমির অংশ যার ছায়া পশ্চিম এশিয়া পেরিয়ে সুদূর উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এসব অঞ্চলে বিদ্যমান জনগোষ্ঠীর পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে গভীর আত্মিক বন্ধন ছিল, যা থেকেই মূলত সাধারণ একক সাংগীতিক ঐতিহ্য রচিত হয়েছিল। যদিও সে ঐতিহ্যের রঙ-রূপ ও ভাষিক প্রজাতি ভিন্ন ভিন্ন ছিল। আশ্চর্যের বিষয় হলো উল্লিখিত অঞ্চলগুলোসহ সারা বিশ্বে সংগীত একই প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত হয়েছিল। পুরনো সভ্যতাগুলোতে সংগীত পূজা-অর্চনার অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গরূপে বিকাশ লাভ করেছিল। মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার অন্যতম দুই প্রধান অঞ্চল বাবেল ও সুমেরে অবস্থিত বিভিন্ন মন্দিরের আচারপ্রথার সঙ্গে সংগীতের অগ্রগতি ও উৎকর্ষ সম্পর্কিত ছিল যা রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে ধন্য হতো। এমনকি রোমকদের দেশেও সংগীতের এমন মাহাত্ম্য আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি। আরব উপদ্বীপের সভ্যতা সংগীত দ্বারা কী পরিমাণ প্রভাবিত ছিল তা আমরা জাহেলি যুগের কবিতা থেকেই বুঝতে পারি। এ উপদ্বীপের বাসিন্দাদের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী ইহুদি ও গ্রিক জনগোষ্ঠী এবং মেসোপটেমিয়ার বিভিন্ন জাতি-উপজাতির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সুতরাং আরব অঞ্চল সংগীতের সাধারণ ক্ষেত্রভূমিতেই বিরাজ করত।
জাহেলি যুগে আরব বেদুইনদের মধ্যে সাদাসিধে কিছু গান প্রচলিত ছিল। সঙ্গীহীন মরুজীবন তাদের ওপর যে প্রভাব বিস্তার করত তা থেকে এসব গানের জন্ম হতো, যার প্রতিটি স্তবক ও পঙিক্ততে অনুভূতির ভিন্নতা ছিল। দুই পঙিক্তর একটি গানও তারা গুনগুন করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত তখন। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লেশ থেকে তারা এভাবে নিজেদের চাঙ্গা করত। এই মরুগীতি হিদা নামে পরিচিতি পায়, যার নামকরণের পেছনে রয়েছে মজার একটি গল্প। নবি মুহাম্মদ (সা.)-এর সপ্তদশ পূর্বপুরুষ ছিলেন মুজার বিন নিজার। আরব ইতিহাসবিদ মাসউদির মুরুজুয যাহাব কেতাবে উল্লেখ আছে, একবার উট চরাতে গিয়ে তিনি হাত ভেঙে ফেলেন। হাতের ব্যথায় তিনি ‘ইয়া ইয়াদাহ্! ইয়া ইয়াদাহ্!’ বা হাত! হাত! বলে চিৎকার দিতে শুরু করেন। তার চিৎকার শুনতে পেয়ে উটগুলো তার পাশে এসে জড়ো হয়। ‘ইয়া ইয়াদাহ্!’ থেকেই হিদা নামের উদ্ভব বলে আরব ভাষাবিদদের অভিমত। উটের রাখালকে মাওয়াল বলা হয়ে থাকে। হিদা হলো এ মাওয়ালদের গান। সর্বজনস্বীকৃত যে বিষয়টি হিদা সম্পর্কে পাওয়া যায় তা হলো মরুভূমিতে মাওয়ালরা উটকে নিজের কাছে ডেকে আনতে এগুলো গাইত। এসব গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে উটের পাল রাখালের কাছে এসে জড়ো হতো। অর্থাৎ এ গানগুলো যোগাযোগের মাধ্যমও বটে। কারণ এর মাধ্যমে উট নিজের মনিবের ডাক চিনতে পারত এবং সে অনুসারে তার ডাকে সাড়া দিত। উট নিয়ে বহুদূর অতিক্রম করার সময়েও মাওয়ালরা হিদা গাইত। ভারী বোঝা নিয়ে ভ্রমণের কষ্ট থেকে উটকে এ গান কিছুটা স্বস্তিও হয়তো দিয়ে থাকবে। ইসহাক মুসলির মতে, জাহেলি যুগে আরবদের মধ্যে নসব, সানাদ ও হযজ নামে কিছু সংগীত প্রচলিত ছিল। নসব ছিল মৃতের জন্য শোকগান। সানাদ বিপুল আয়োজনে গাওয়া হতো। দফ ও মিজমারের বাদনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হযজ গাওয়া হতো। এ যুগে আরবে যেসব বাদ্যযন্ত্র পাওয়া যেত সেগুলোকে ঘাত ও শুষির এই দুই শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। ঘাতযন্ত্রের মধ্যে তবল, দফ, সান্জ্ (করতাল), জুলজুল এবং শুষিরযন্ত্রের মধ্যে মিজমার ব্যবহূত হতো। ফারাবি অবশ্য ততযন্ত্রের কথাও উল্লেখ করেছেন। উদ, তানবুর, মুয়াত্তির, বারবুত প্রভৃতি ততযন্ত্রের সঙ্গে মিজহার নামে একটি উদযন্ত্রের কথাও তিনি প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন। মিজহারের পেট চামড়া দিয়ে তৈরি করা হতো। এগুলোর বাদনের সঙ্গে কবিতা গানের মতো গীত হতো।
অতঃপর ইসলামের আবির্ভাবের সময় থেকে ফারসি, তুর্কি ও মিসরীয় সভ্যতা আরবের সুর-সংগীতে প্রভাব ফেলে। আর এ কারণেই এর সঙ্গে প্রাচ্য সংগীতের মেলবন্ধন রচিত হয়েছিল এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরস্পরের সম্পর্ক সুসমন্বিত ও গভীর হয়েছে। এ সময়ে আরবদের হাতে সুরের বিন্যাস বৈচিত্র্য লাভ করে এবং আরবি সংগীতের সুর ও স্বরের ভিত্তি মাকামাত প্রতিষ্ঠা পায়। তাদের কাছে সংগীতের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আমাদের মনে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ বিরাজ করলেও সংগীত যে আরব সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল তা অস্বীকার করার কোনো জো নেই। মুসলমান আলেম, বিজ্ঞানী, ফকিহ, ব্যাকরণবিদ ও দার্শনিকরা ভালোবেসে আপন মনের তাগিদে এ শাস্ত্র নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন এবং অন্য জ্ঞানের সঙ্গে এ সম্পর্কিত জ্ঞানের অধ্যয়ন চালিয়ে গেছেন। বলা যায়, তাদের গবেষণার ফলেই এটি স্বপ্রতিষ্ঠিত একটি শাস্ত্র হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে। তাদের অনেকেই আরব বীণা উদ বাজাতে পারতেন। এদের লেখায় ও সাহিত্যে আমরা সমৃদ্ধ সংগীত-ঐতিহ্যের ঝলক দেখতে পাই। এ সময়ে রাজপ্রাসাদ ও জনমানুষের উৎসবে সংগীত যেমন উপস্থিত ছিল তেমনি সংগীতের মাধ্যমে রোগের চিকিৎসা করার বিষয়ে তাদের চিন্তাভাবনা খুঁজে পাওয়া যায়।
সংগীতের ইতিহাসে আব্বাসী আমলকে স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। আব্বাসী যুগে আরবদের এ সংগীত-বিপ্লব সম্পর্কে ইবন খালদুন তার মুকাদ্দিমায় বলেন, ‘সংগীত শিল্প তখনো চর্চিত হতে থাকে এবং তা বনু আব্বাসের যুগে এসে পূর্ণতা পায়।’ আব্বাসী খেলাফতের শুরুতে যে বিপ্লব বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে তা পরের শতাব্দীগুলোতেও চলমান ছিল। ইতিহাসবিদ আবুল হাসান মাসউদি আব্বাসী খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আব্বাস সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছেন, ‘এ খলিফারা সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন বলেই এ শিল্প সমৃদ্ধি লাভ করেছে। তিনি নিজে যেমন ছিলেন শিল্প ও সুরের ভক্ত তেমনি তার ভাই আল-মনসুরও। তার হাতেই বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়।’
খলিফা আল-মামুনের রাজত্বকালে বাগদাদে ইসলামী সংগীতের উৎকর্ষ সাধিত হয়। কারণ তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানকে উৎসাহ প্রদান করার নিমিত্তে বাইতুল হিকমাহ প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যেমন অনুবাদ হতো, তেমনি সংগীতের জ্ঞানও প্রাধান্য লাভ করে। দর্শন, চিকিৎসা, ফালাক প্রভৃতির জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি মুসলিম বিদ্বানরা এখানে সুর ও স্বর নিয়ে গবেষণা করেন। হেনরি জর্জ ফার্মারের মতে, আব্বাসী খেলাফতের প্রথমাংশ সংগীতের স্বর্ণযুগ ছিল যার ধারা খলিফা মুতাসিম বিল্লাহর রাজত্বকালেও অব্যাহত ছিল। জাঁকজমক ও আভিজাত্যের দিক দিয়ে তার দরবার খলিফা হারুন আল রশিদের দরবারের সঙ্গে তুলনীয়। তার প্রাসাদ সর্বদা তার যুগের শ্রেষ্ঠ সংগীতকারদের দ্বারা পরিপূর্ণ থাকত। ইসহাক মুসলি ছিলেন তার দরবারের সংগীতকারদের অন্যতম যাকে ‘নাদিমুল খালিফাহ্’ উপাধি প্রদান করা হয়েছিল। এর পরের খলিফা ওয়াসিক বিল্লাহ নিজেই উদ বাজাতে পারতেন। হাম্মাদ বিন ইসহাক আল-মুসলি এ বিষয়ে প্রমাণ দাখিল করে বলেছেন, ‘উদ বাজানোর ব্যাপারে তার জুড়ি মেলা ভার ছিল।’ কিতাবুল আগানিতেও বিষয়টি এসেছে। এ বিষয়ে ফার্মারও তার মন্তব্যে বলেছেন, ‘শিল্প ও সংগীত তার দরবারে উৎসাহ ও বদান্যতা পেয়েছে, যা এর আগে আর দেখা যায়নি। এমনকি যারা তার দরবার পরিদর্শনে আসতেন তাদের কাছে মনে হতো ইব্রাহিম মুসলির নেতৃত্বে এ যেন সংগীত ইনস্টিটিউটে পরিণত হয়েছে।’ আব্বাসী খলিফাদের দরবার জ্ঞানীগুণী ও চিন্তক সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। এ সময়ে কোনো সংগীত উৎসবে অংশ নিতে বাগদাদের অলিগলিতে গায়ক দলের উপচে পড়া ভিড় হতো। অধিবাসীরা নিজেরাই এসব উৎসবে ও অনুষ্ঠানে গান গাইত। এই ঐতিহ্যটিই পরে ইউরোপের রাজদরবারে প্রবাহিত হয়, যখন এই মুসলিম গায়করা ফ্রান্স, উত্তর স্পেন, সিসিলি প্রভৃতি দেশের রাজদরবারে গিয়ে উপস্থিত হয়। এ যুগের খলিফা ওয়াসিক বিল্লাহ গান ও সংগীতের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেন।
তিনি নিজেও সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। সংগীতের বিভিন্ন নিয়মকানুন নিয়ে রচিত বিভিন্ন বইও এ সময়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফারাবি রচিত আল-মুসিকা আল-কাবির ও আবুল ফরজ আল-ইসফাহানি রচিত কিতাবুল আগানি এ সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা। আন্দালুসে মুওয়াশশাহর আবির্ভাবের ফলে ভিন্ন রকমের এক সংগীতের উত্থান ঘটে। নবম শতকে শিল্পের প্রয়োজনে এবং একই সঙ্গে সামাজিক প্রপঞ্চ হিসেবে সেখানে মুওয়াশশাহর আগমন ঘটে। মূলত কবিতা লেখার কড়াকড়ি নিয়ম থেকে ও কবিতার ছন্দ থেকে মুক্তির প্রচেষ্টায় এর উদ্ভব ঘটে। এ কবিতাগুলো পাঁচটি স্তবকে সজ্জিত হতো এবং গান হিসেবে ব্যবহূত হতো। এতে সংগীত বিকশিত হয়, গান গাওয়া বেশ জনপ্রিয় হয় এবং আরবি ঐতিহ্যের সঙ্গে হিস্পান ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ঘটে। ছন্দ ও অন্ত্যমিলের কড়াকড়ি নিয়মকে অগ্রাহ্য করে যে মুওয়াশশাহ রচিত হয় তাতে কবিতা নয় বরং একেবারে শুরু থেকেই গানের প্রাধান্য ছিল। সংগীতের প্রতি আন্দালুসিদের অনুরাগ ছিল অবিশ্বাস্য এবং গান গাওয়ায় হামেশা তাদের ডাক পড়ত। এমনকি জরইয়াবের সেখানে আগমন ও তার সংগীত আন্দালুসে ছড়িয়ে পড়ার পরও তাদের গান গাইতে ডাকা হতো। এভাবে গান ও সংগীত সংমিশ্রিত হয়ে কবিতাকে প্রভাবিত করে। এর পরের যুগে গীতিকাব্যে যজল নামে আরেকটি ধারা সংযুক্ত হয়, যাতে লাহজাহ বা আরবি উপভাষা প্রাধান্য লাভ করে। এমন গানে ভিনদেশী শব্দও যুক্ত করা হতো। ইবন কুজমান এ ধারার প্রবক্তা বলে প্রশংসিত হন।
হিস্পানি প্রাচ্যতাত্ত্বিক হুলিয়ান রিবেরা হিস্পানি সংগীত ও তার ইতিহাস নিয়ে বেশ কয়েকটি বই রচনা করেছেন। এসব বইয়ে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করেছেন যে মধ্যযুগের হিস্পানি সংগীতের মূল প্রোথিত রয়েছে আরবে। আরবরা সেখানে প্রবেশের আগে হিস্পানের সংগীত ছিল গ্রিসের গির্জার সংগীত দ্বারা প্রভাবিত। হিস্পানে আরবের প্রবেশ এবং সেখানে আন্দালুস নগরের প্রতিষ্ঠা এ অঞ্চলের সংগীতকে উন্নতির চরম শিখবে পৌঁছে দিয়েছে। আন্দালুসকে বলা যায় সভ্যতার করিডোর, যা দিয়ে পূর্বের সংগীত পশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছে। এর মাধ্যমে মধ্যযুগে প্রাচ্য ইউরোপকে অধিকার করেছে। শুধু তাই নয়, উদ নামক আরব বীণা সপ্তদশ শতকেও ইউরোপে বাজানো হতো। কুর্ট জাকসের মতো বেশকিছু গবেষক বাদ্যযন্ত্রের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাদের অধিকাংশের মতে, পাশ্চাত্যের বেশির ভাগ বাদ্যযন্ত্রের উৎপত্তিস্থল হলো পূর্ব। যেমন সারা বিশ্বে পিয়ানোকে একটি বিশুদ্ধ ইউরোপীয় বাদ্যযন্ত্র মনে করা হয়। কিন্তু কুর্ট জাকসের মতে, এটি আন্দালুসি আরবি বাদ্যযন্ত্র। তিনি একে জিরিয়াবের সময়ের মনে করেন। যন্ত্রটির জন্য হিস্পানি, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় সবচেয়ে প্রাচীন যে শব্দটি পাওয়া যায় তা হলো ঊপযরয়ঁরবৎ (এশিকিয়ের)। অর্থাৎ আরবে শাকির নামে যে বাদ্যযন্ত্র ছিল তা হলো পিয়ানোর পূর্বপুরুষ। শাকির ছিল ছোট একটি যন্ত্র, যার চাবিগুলো সাদা ও কালো রঙের হতো। চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত এটি আরবে পাওয়া যেত। সুতরাং আরবরা যখন আন্দালুসে প্রবেশ করল তখন তারা জ্ঞান ও দর্শনের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রও সেখানে নিয়ে গেল। একাধিক তারের পলিফোনিক সুর সম্পর্কে তখনো পশ্চিমের জানাশোনা ছিল না। আন্দালুসি ইমারতের তৃতীয় খলিফার রাজত্বকালে (৭৯৬-৮২২) এ শিল্প সেখানে উৎকর্ষ লাভ করে। আব্বাসীদের মতো তারাও শিল্পী ও জ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। দ্বিতীয় আবদুর রহমানের সময় পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল। অনদালুসের রাজদরবারের প্রথম সারির সংগীতজ্ঞ জিরিয়াবের জীবন থেকে সেখানে সংগীতের গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারি। তিনি সুলতানের নাদিম বা বন্ধু ছিলেন এবং তিনি তার সঙ্গে একই পাত্র থেকে খাবার খেতেন। তিনিই আন্দালুসের প্রথম মিউজিক স্কুল তৈরি করেছিলেন। এজন্য তাকে ‘মিউজিকার আল-আন্দালুস’ নামে অভিহিত করা হয়। আন্দালুসের পতন অবধি এ স্কুল চালু ছিল। সংগীতে জিরিয়াবের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। তিনিই উদের পঞ্চম তারটি সংযুক্ত করেন এবং বাগদাদ থেকে আন্দালুসে সংগীতের দুটো রীতিকে নিয়ে গিয়েছেন যেগুলো হলো: ১. নুবা অঞ্চলের গায়কি ও ২. কবিতার তালের সঙ্গে সংগীতের তালের প্রয়োগ ঘটানো। তার হাত দিয়েই উদ, কানুন ও রাবাবের মতো বাদ্যযন্ত্র আন্দালুসে প্রবেশ করে। ইরাক থেকে জিরিয়াবের আন্দালুসে গমন এবং সংগীতজ্ঞানে নিজের প্রভাব স্থাপন করায় ইরাকি ঘরানা থেকে তার হাতে আন্দালুসি ঘরানার উদ্ভব ঘটে। এ সময়ে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে সংগীত পরিবেশন করা হিস্পানির লোকেদের কাছে জনপ্রিয় হয়। এ প্রসঙ্গে প্রাচ্যবিদ হুলিয়ান রিবেরির মন্তব্য হলো এভাবে আন্দালুসের আনাচেকানাচে সংগীত ছড়িয়ে পড়ায় শহরের অধিকাংশ লোকেদের ঘরে সংগীতযন্ত্র প্রবেশ করে। দোকানে দোকানেও সংগীত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। গ্রানাডার বিষয়ে শোনা যায়, সেখানে সংগীতের এত প্রাচুর্য ছিল যে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও মাকহাগুলোতে সংগীতের বহুল চর্চা হতো। সংগীতকে বলা হয়ে থাকে হূদয়ের ভাষা, পরম সত্যের ভাষা যা শ্রবণেন্দ্রিয়কে অতিক্রম করে সরাসরি পৌঁছে যায় মর্মমূলে। মানুষের এ শিল্প প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বহমান এবং তা পুরো বিশ্বের অভিব্যক্তিকে মাত্র একটি সাংগীতিক নোটের মধ্যে ধারণ করতে সক্ষম। আরবদের সংগীতের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। (সূত্র: বণিকবার্তা সিল্ক রোড) ইসফানদিয়র আরিওন: লেখক ও অনুবাদক