শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৭ অপরাহ্ন

পাক-মার্কিন সম্পর্কের নতুন অধ্যায়

মাসুম খলিলী :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২২

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে বলে একটি আলোচনা ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলয়ে এখন দেখা যাচ্ছে। তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে থাকা পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক পুনর্র্নিমাণের একটি সক্রিয় উদ্যোগ দেশটিতে শাসন পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হবার পর থেকে লক্ষ করা যাচ্ছে। ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতির মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়ার একটি পর্ব পার হয়েছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার নানা ঘটনার মধ্যেও পাক-মার্কিন সম্পর্ক পুনর্র্নিমাণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলে মনে হয়। এর ধারাবাহিকতায় ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির সাথে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের আলোচনা হয়েছে। এ সময়টাতে পাকিস্তানে এফ-১৬ জঙ্গি বিমানের ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের আপগ্রেডেশনের একটি প্রকল্পে সহযোগিতা নিয়ে দু’পক্ষের সমঝোতার বিষয় প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের এ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য এবং হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র নেড প্রাইসের জবাবের মধ্যে পাকিস্তান ও ভারতের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক সম্পর্কের পুনঃনির্মাণের একটি বিষয় স্পষ্ট হয়। সহযোগিতার এই প্যাকেজের ব্যাপারে ভারতের বিরোধিতার পরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের মন্তব্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন যে, ‘আমাদের আলোচনায়, আমরা ভারতের সাথে একটি দায়িত্বশীল সম্পর্ক পরিচালনার গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলেছি।’ অন্য দিকে এফ-১৬ চুক্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের সাথে আমাদের যে সম্পর্ক রয়েছে তা তার নিজস্ব অবস্থানে রয়েছে; পাকিস্তানের সাথে আমাদের সম্পর্কটিও তার নিজস্ব অবস্থানে রয়েছে। এই প্রতিবেশীদের একে অপরের সাথে সম্পর্ক যতটা সম্ভব গঠনমূলক যেন হয়, তা দেখার জন্য আমরা সবকিছু করতে চাই।’
নেড প্রাইসের মন্তব্যে একটি নীতি বিবৃতির সব উপাদান রয়েছে। সবচেয়ে সুস্পষ্ট যা দাঁড়িয়েছে তা হল যে, স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ভারত ও পাকিস্তানের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্ককে ‘ডি-হাইফেনেট’ করার জন্য প্রাইস মার্কিন নীতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আর পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে একটি স্বাভাবিক সম্পর্কের প্রচারও করেছেন। প্রাইস উল্লেখ করেছেন যে, দু’টি সম্পর্কের ‘প্রত্যেকটিতে আলাদা আলাদা পয়েন্ট রয়েছে’।
মজার বিষয় হলো, প্রাইস ভারতকে পাকিস্তানের সাথে অংশীদার দেশ হিসাবে সমতুল্য করেছে, যার সাথে সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘অনেক ক্ষেত্রে শেয়ার করা মূল্যবোধ’ এবং ‘অনেক ক্ষেত্রে শেয়ার করা স্বার্থ রয়েছে’ মর্মে উল্লেখ করা বিষয়টি সঠিকভাবে বোঝা দরকার। এখন স্পষ্ট যে, অতীতে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন আঞ্চলিক নীতিতে ভারতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে পাকিস্তানের আপত্তির কথা ওয়াশিংটন নোট করেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো দু’দেশের সম্পর্ককে একই সমান্তরালে নিয়ে আসতে চাইছে।
বার্তাটি কেন গুরুত্বপূর্ণ: রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধের পর বৃহৎ শক্তিগুলোর বৈশ্বিক সম্পর্কের অনেক হিসাব নিকাশে পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। আর এ ব্যাপারে দু’টি নির্ণায়ক বিষয়ের একটি হলো আফগানিস্তান। ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানের আলোকে পাকিস্তানের সাথে অংশীদারিত্বের পুনর্মূল্যায়ন করার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। আফগান যুদ্ধ সম্পর্কে কংগ্রেসের এক প্রশ্নের জবাবে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তখন বলেছিলেন, ‘এটি এমন একটি বিষয় যা আমরা সামনের দিন এবং সপ্তাহগুলোতে দেখব। গত ২০ বছরে পাকিস্তান যে ভূমিকা পালন করেছে, সেই সাথে আমরা আগামীতে যে ভূমিকা পালন করতে চায়, তা আমরা দেখতে চাই?’
এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্লিঙ্কেনের নতুন মন্তব্য নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। এটি ঠিক যে, আফগানিস্তান ২০০১ সাল থেকে পাক-মার্কিন সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে। এমনিতেই পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্কগুলো বোঝা সহজ নয়, এটিকে আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অদ্ভুত জোড়ার অস্বস্তিকর বিবাহ হিসাবে অনেকে বর্ণনা করেন। আফগানিস্তান বিষয়গুলোকে আরো জটিল করে তোলে। পাকিস্তান একটি পরাশক্তিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে আবার এর পাশাপাশি তার অপরিহার্য স্বার্থও রক্ষা করতে চায়। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেশটিতে একটি অস্থির মিত্র হিসাবে দেখা হয়।
উইলসন সেন্টারের কূটনীতিক এবং ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত পাকিস্তানে রাষ্ট্রদূত ডেভিড হেল বলেছেন, ‘পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই তাদের দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম। এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হলো, উভয়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস। পাকিস্তানে সময়ের সাথে সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি শত্রুতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও পাকিস্তানকে বিশ্বাস করে না। পাকিস্তানে আমেরিকা বিরোধিতার একটি প্রধান কারণ পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি, তবে সামগ্রিকভাবে মুসলিম বিশ্বের প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রবণতা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন বজায় রাখার জন্য আমেরিকাবিরোধী মনোভাবের ওপর নির্ভর করেছে। পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে শোষক এবং কর্তৃত্ববাদী উভয় হিসাবে দেখা হয়।’
তার মতে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাকিস্তানের ক্রমাগত নির্ভরতা তার বিকল্পগুলোকে এমনভাবে হ্রাস করেছে যে, এটি তার দুর্দশা থেকে রক্ষা পেতে অক্ষম। তা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের অভাব রয়েছে পাকিস্তানের। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, এটি সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সব ফ্রন্টে পাকিস্তানের অভিজাতদের পছন্দসই পক্ষ। নানা অসুবিধা সত্ত্বেও, পাকিস্তান চরমপন্থী মতাদর্শীদের সাথে তার প্রেম-ঘৃণামূলক সম্পর্কের ভালো ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চালচলনের জায়গা করে নেয়ার জন্য সম্ভব করেছে।’
পাকিস্তানের সামনে তৃতীয় কৌশলগত বিকল্প হলো হেজ বা সমন্বয় করা। বৈশ্বিক ক্ষমতার চলমান পরিবর্তনের ফলে হেজিং কৌশলটি সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করার বিকল্পটি মধ্যম শক্তির কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। নতুন বাস্তবতার কারণে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই বাস্তবতা হলো, চীনের উত্থান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপেক্ষিক পতন, রাশিয়া-চীন সম্পর্ক, রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান শক্তিমত্তা প্রদর্শন প্রভৃতি। অন্য দিকে, ভারত এখন এমন একটি দেশের পাঠ্যপুস্তকের উদাহরণ হয়ে উঠেছে যে, তার বিদেশ নীতিতে কঠোর হেজিং ব্যবহার করে চলেছে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের নামে। ভারত ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আর সে সাথে মস্কোর সাথে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চাবাহার উদ্যোগের পুনরুজ্জীবনও করেছেন; অথচ কোয়াড উদ্যোগের প্রধান অংশীদার দেশটি। প্রাক্তন পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত জমির আকরামের মতে, ‘নয়াদিল্লি আসলে তার কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য ওয়াশিংটন এবং মস্কো উভয়ের সাথে সম্পর্ক নির্মাণে প্রভাব খাটাচ্ছে।’
তবে এখন মনে হচ্ছে, ভারতের এই কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন নীতি পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। তবে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জটি হলো চীনের সাথে সম্পর্ক রেখে কতটা ঘনিষ্ঠ হতে পারবে যুক্তরাষ্ট্রের। আশ্চর্যজনকভাবে, ভূ-কৌশলগত চ্যালেঞ্জগুলি তীব্রতর হলেও পাকিস্তান তার বৈদেশিক নীতিকে একটি ভূ-অর্থনৈতিক শক্তির জন্য প্রস্তুত করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে চাপের বিষয় হলো আফগানিস্তানের পরিস্থিতি, তারপরে মোদি সরকারের আগ্রাসী কাশ্মীর নীতি এবং চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের কৌশলগত সারিবদ্ধতা। এই কারণগুলোর কারণে পরিবর্তন বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এই অবস্থায় অবশ্য ভারতীয় বিশ্লেষকদের অনেকে পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্মাণে প্রতিক্রিয়া না দেখানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। ভারতের সাবেক কূটনীতিক ভদ্রকুমারের মতে, ‘মার্কিন-পাকিস্তান জোটের পুনরুজ্জীবন নিয়ে ভারতের বিরক্ত করা উচিত নয়। ইমরান খানের উৎখাত এবং পাকিস্তানে যে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন হয় তা যদি তার যৌক্তিক উপসংহারে নিয়ে যেতে হয়, তবে এর একটি অনিবার্যতা রয়েছে। এটা কল্পনা করা নিছক নির্বুদ্ধিতা যে, পাকিস্তানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিকীকরণ রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার প্রতি তার ‘উষ্ণ’ মনোভাবের জন্য ভারতকে শাস্তি দেয়ার একটি উপায়।’
ভদ্রকুমার মনে করেন, ‘পাকিস্তানের সাথে মার্কিন অংশীদারিত্বের পুনরুজ্জীবন একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল যা গভীর ভূ-রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার জন্য প্রয়োজন- তালেবান শাসন থেকে শুরু করে পাকিস্তানে চীনের বিশাল উপস্থিতি, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, রাশিয়া ও ইরানের সাথে আমেরিকার প্রতিকূল সম্পর্ক, ইন্দো-প্যাসিফিকের দিকে ন্যাটোর অগ্রগতি এবং আরো কিছু- এই বাধ্যতামূলক বাস্তবতার অংশ। এ ছাড়াও পাকিস্তান যে, একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি এবং এই অঞ্চলে আমেরিকান কৌশলগুলো ইসলামাবাদের সহযোগিতা এবং অংশীদারিত্ব ছাড়া সর্বোত্তম হতে পারে না সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে।’
চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধুমাত্র তার স্বার্থে কাজ করে। আর প্রাইসও অকপটে স্বীকার করেছেন যে, ভারত ও পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেকটির আগ্রহের ভিন্ন বিষয় রয়েছে। সোজা কথায়, পাকিস্তান ও ভারতের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাদা ব্যবহার রয়েছে। বলা হয়েছে, কিছুটা হতাশাও থাকতে হবে যে, ভারত ভালো পারফর্ম করছে না।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক বাস্তবতা: পাকিস্তানের এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি হলো ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পিটিআই দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুন খোয়ার মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশে তাদের সরকার রয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আলভিও পিটিআইয়ের মনোনীত ছিলেন। অন্য দিকে ফেডারেল সরকারে রয়েছে মুসলিম লীগ নওয়াজ, পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সমন্বিত একটি জোট। কেন্দ্র ও প্রদেশের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার ভাগাভাগিতে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ক্ষমতা এস্টাবলিশমেন্ট হিসাবে পরিচিত সামরিক প্রতিষ্ঠানের হাতে রয়েছে বলে মনে করা হয়।
এই সামরিক প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক ক্ষমতার চর্চার ব্যাপারে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নেতারা মনে করেন, নওয়াজ শরিফের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হওয়ার বিষয়টি এস্টাবলিশমেন্টের কারণেই ঘটেছে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুদ-াদেশ সামরিক সরকারের সময়েই কার্যকর হয়েছে। এমনকি বেনজির ভুট্টোর হত্যাকা-ের ঘটনার সময় জেনারেল পারভেজ মোশাররফ প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন। অনেকেই তার ভূমিকাকে হত্যাকা-ের জন্য দায়ীও করে থাকেন। সর্বশেষ, ইমরান খান ও তার দলের অনেকেই পিটিআইকে ক্ষমতা থেকে বিদায়ের জন্য প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে এস্টাবলিশমেন্টকে দায়ী করছেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুযায়ী ক্ষমতাসীন দলগুলোর জোট এস্টাবলিশমেন্টের পৃষ্ঠপোষকতায় সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করা হয় যদিও তাদের ভেতরে রাজনীতিতে সামরিক প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। সামরিক বান্ধব হিসাবে ক্ষমতায় যাওয়া পিটিআইও এখন এস্টাবলিশমেন্টের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিপক্ষ ধারায় কার্যত যুক্ত হয়েছে বলে মনে হয়।
প্রশ্ন হলো পাকিস্তানের বর্তমান রাজনীতি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি কি দেশটির সর্বভৌমত্ব ও অখ-তার জন্য ইতিবাচক বিষয়? রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে যত বিতর্কই সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নিয়ে উত্থাপন করা হোক না কেন এখনো পাকিস্তানের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সামরিক প্রতিষ্ঠানকে দেশটির অখ-তা রক্ষার সর্বশেষ অবলম্বন হিসাবে দেখেন। সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদের পক্ষে প্রতিবেশী ভারত ও দূরবর্তী কিছু শক্তির যে ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করা হয় তা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সামরিক প্রতিষ্ঠানের কোনো বিকল্প নেই। পাকিস্তানি তালেবানের সর্বাত্মক বিদ্রোহ আর বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে সেনাবাহিনীর বিপুল রক্ত ঝরেছে। আফগানিস্তানের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে চলে যাবার পরিস্থিতিতে তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণের পেছনে সামরিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আর আফগান তালেবানদের সাথে পাকিস্তান সরকারের সম্পর্ক যতই অম্লমধুর হোক না কেন দেশটির নিরাপত্তা বিঘিœত করার কোনো তৎপরতায় তাদের ভূমিকা থাকবে না বলেই ধারণা করা হয়।
জাতীয় নিরাপত্তা ছাড়াও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি হুমকির মুখে পড়লেও এস্টাবলিশমেন্টের ভূমিকা মুখ্য হয়ে ওঠে। ইমরান খান সরকারের যখন পতন ঘটে তখন পাকিস্তানের সাথে পশ্চিমা রাজনৈতিক শক্তির সম্পর্ক এমন এক তলানিতে গিয়ে ঠেকে যে, পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে বড় রকমের বিধিনিষেধ বা অবরোধের মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একেবারেই নিচে নেমে আসে। আমদানি বিল মেটানো এবং বিদেশী দায় পরিশোধে খেলাপি হবার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় পাকিস্তানের। এই অবস্থায় এগিয়ে আসে এস্টাবলিশমেন্ট।
যে কারণেই হোক, ইমরান সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র বলয়ের সম্পর্ক পুনর্র্নিমাণের পর্যায়ে না থাকায় তার সরকারকে বিদায় নিতে হয়েছে। ইমরান এ ক্ষেত্রে একটি অন্তবর্তী সরকারকে ক্ষমতায় চেয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত তার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে সাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতায়নের মাধ্যমে দৃশ্যত গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে চেয়েছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি হলো, ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতির পর তিনি রাজনৈতিক পরিবর্তনে বিদেশী তথা আমেরিকান হস্তক্ষেপের কথা বলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। এ সময়ে যেকোনো নির্বাচন হলে তিনি যে আবারো ক্ষমতায় ফিরে আসবেন সেটি অনেকটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় বিগত পাঞ্জাব উপনির্বাচনের ফলাফল দেখে। অন্য দিকে মার্কিন বিরোধী ঢেউ তুলে জনপ্রিয় হবার পর ক্ষমতায় আসার অর্থ হবে পশ্চিমা শক্তির সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক আবারো অচলাবস্থায় চলে যাওয়া।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দুটি উপায় থাকতে পারে। প্রথমত, ইমরান খানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি করা, যাতে পিটিআই সরকার গঠনের পরও স্নায়ুযুদ্ধকালে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সমান্তরাল কৌশলগত সম্পর্কের অধ্যায় আবার ফিরিয়ে আনা যায়; উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে একটি ভারসাম্য নিয়ে আসা সম্ভব হয়। দ্বিতীয় পথটি হলো পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইমরানের অবস্থানকে বিপন্ন করে তোলা যে চেষ্টা অবিরত ক্ষমতাসীন জোট করে যাচ্ছে।
তবে ইমরানের এখন জনপ্রিয়তা যে স্তরে চলে এসেছে তাতে এ ধরনের প্রচেষ্টায় এস্টাবলিশমেন্ট সমর্থন দিলে দেশটির জনমত সামরিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানি গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে যে, নওয়াজ শরিফ রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে অভিন্ন অবস্থান তৈরির জন্য ইমরানের কাছে গোপন প্রস্তাব দিয়েছেন। এ ধরনের একটি বিষয় সামনে চলে এলে তাতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তি শুধু যুক্ত হবে; তাই নয় একই সাথে এর পেছনে ভারত ইসরাইল এমনকি আমেরিকার কোনো কোনো লবিরও সমর্থন এসে যেতে পারে। পাকিস্তানকে চার টুকরো করার যে একটি পরিকল্পনা ২০০৬ সালে প্রকাশ করা হয়েছিল তা বাস্তবায়নে প্রধান বাধাই হলো সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের এক ধরনের নিয়ন্ত্রক প্রভাব। এই প্রভাবকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তির সহায়তায় ভেঙে দেয়া সম্ভব হলে দেশটির অখন্ডতা বিপন্ন করা তথা বেলুচিস্তান বা খাইবার পাখতুন খোয়াকে আলাদা করা অথবা আজাদ কাশ্মির ও গিলগিট-বাল্টিস্তানকে নিয়ে নেয়া বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের জন্য খুব বেশি কঠিন হবে না। এই বাস্তবতার কারণে পাকিস্তানকে চীনের সাথে নিরাপত্তা ও অখ-তা বজায় রাখতে সম্পর্ক দৃঢ়ভাবে যেমন সংরক্ষণ করতে হবে তেমনিভাবে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য বলয়ের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এ ধরনের একটি সমীকরণ দেশটির রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে এককভাবে করা সম্ভব হবে না। এজন্য সামরিক প্রতিষ্ঠানের শক্তিকে কোনোভাবে সঙ্কুচিত করা যাবে না। বিপন্ন করা যাবে না গভীর ক্ষমতা বলয়ের প্রভাবের টুলসগুলোকে।
mrkmmb@gmail.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com