শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২০ পূর্বাহ্ন

বাগদাদ থেকে ফরিদপুরে এসেছিলেন যে সুফি কবি

আলমগীর জয়
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২২

দরবেশ, অলি-আউলিয়া, পীর, গাউস, কুতুব, ফকির, সাধু, সন্ন্যাসীÍঅনেক পবিত্র পুরুষের স্মৃতিধন্য বৃহত্তর ফরিদপুরের মাটি। সাধারণ মানুষকে ধর্ম, আধ্যাত্মিক ভাবনা ও নৈতিকতার পথ দেখানো এমন অনেক পথপ্রদর্শকের কারো জন্ম, কিংবা কারো কর্মভূমি ফরিদপুর জেলা।
ফরিদপুরের মাটিতে যে সুফিদের আগমন ঘটেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম শাহ আব্দুর রহমান গঞ্জেরাজ বোগদাদি এবাদোল্লাহেস সালেহীন। তাকে নিয়ে সরেজমিন তথ্যানুসন্ধান থেকে তৈরি হয়েছে এ রচনা। ‘ইংরেজি ১২০০ সালের আগে বাগদাদ নগরী থেকে ফরিদপুরে আসেন শাহ আব্দুর রহমান গঞ্জেরাজ বোগদাদি এবাদোল্লাহেস সালেহীন।’১ ‘নিজ বিবি, আপন বোনের ছেলে (ভাগ্নে) আব্দুর রহমান দানিশমান্দ ও বেশ কয়েকজন সঙ্গী সাথীসহ আগমন করেন।’২ তবে তার বংশধরদের দাবি ‘১১ শত বছর পূর্বে (অর্থাৎ ৯০০ খ্রিস্টাব্দের আগে) আব্দুর রহমান গঞ্জেরাজ বোগদাদি ফরিদপুরে আগমন করেন।’৩ তিনি আব্দুর রহমান গঞ্জেরাজ নামেই বিখ্যাত। ফরিদপুরে এসে আব্দুর রহমান গঞ্জেরাজ খাবাসপুরে তাঁবু গাড়েন এবং এখানেই ইসলামের বাণী-আদর্শ প্রচার ও আগ্রহীদের দীক্ষা দিতে শুরু করেন। তৎসময়ে ফরিদপুরে জনবসতি ছিল বিরল। তদুপরি যারা বাস করছিলেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন বহিরাগত। আব্দুর রহমানের ব্যবহার-চিন্তা-চেতনা-আদর্শ তৎকালীন বাসিন্দাদের আকর্ষণ করে। ক্রমে তার ভক্ত-অনুরাগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
স্থানীয় শাসকের কানে পৌঁছে যায় আব্দুর রহমানের কেরামতির কথা। খুশি হয়ে তার বসতি পরগনা তাকে বিনামূল্যে প্রদান করেন। ‘পরগনার বাসিন্দাদের থেকে তিনি (আব্দুর রহমান) কোনো ধরনের কোনো খাজনা বা কর আদায় করতেন না, স্বেচ্ছায় দিলেও গ্রহণ করতেন না।’৪ তার ঘরের কাছেই একটি সুন্দর কারুকার্যময় মসজিদ নির্মাণ করেন। ‘মসজিদের গাঁথুনিতে ব্যবহূত প্রত্যেকটি ইটের গায়ে কলেমা তৈয়বা লিখিত ছিল।’৫ মসজিদটি তৎকালীন মুসল্লিদের সংখ্যা অনুপাতে আয়তন-প্রস্থে যথাযথ হলেও গত শতাব্দীর ৯০ দশকের পর থেকে সেখানে স্থানাভাব দেখা দেয়। এ সময় ধীরে ধীরে মসজিদের সম্প্রসারণ করা হয়। ‘২০০০ সালের পরে পুরাতন ও সম্প্রসারিতসহ সব স্থাপনা ভেঙে নতুন করে মসজিদ নির্মাণ করা হয়।’৬
শাহ আব্দুর রহমান গঞ্জেরাজ বোগদাদি এবাদোল্লাহেস সালেহীন একজন সুলেখক ছিলেন, তিনি ছিলেন কবিও। তার লেখালেখির ভাষা ছিল ফারসি। ‘তৎকালীন সময়ের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় অবস্থা উল্লেখসহ নানাবিধ ঐতিহাসিক উপাদানসমূহ নিয়ে ফারসি ভাষায় সুন্দর হস্তাক্ষরে বই লিখে রাখেন। এছাড়া তিনি গুরুর ক্রমধারা, নিজের বংশপরম্পরা, নীতি আদর্শ নিয়েও বই রচনা করেন। তার লিখিত মোট বইয়ের সংখ্যা ৪টি। বইগুলো খ্রিস্টীয় ১২০০ সালের দিকে লেখা।’৭ তৎকালীন ফারসি ভাষায় লিখিত একটি বইয়ে খাবাসপুরকে প্রাধান্য দিয়ে ফরিদপুর নিয়ে লেখা। ‘তখন এ অঞ্চলকে খাবাসপুর বলা হতো।’৮ বইগুলো ওনার পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যরা মাটির হাঁড়িতে যতœসহকারে সংরক্ষণ করলেও কাউকে পড়ার বা দর্শনের অনুমতি দেয়া হয় না। বিশেষ অনুরোধে অধম লেখকের সৌভাগ্য হয়েছিল বইগুলো দেখার।
শাহ আব্দুর রহমান গঞ্জেরাজ বোগদাদি এবাদোল্লাহেস সালেহীনের জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তার ইন্তেকালের পরে নিবাসসংলগ্ন স্থানে দাফন করা হয়। তার সঙ্গী ও বোনের ছেলে আব্দুর রহমান দানিশমান্দ। ‘দানিশমান্দ ফারসি শব্দ, অর্থ অতিশয় জ্ঞানী। তুরস্কে দানিশমান্দ পরিবার আছে। ইউরোপীয় তুরস্ক ম্যাসিডোনিয়ায় অবস্থিত অ্যাসটোরিয়ায় দ্বাদশ শতাব্দীতে দানিশমান্দ আমিরগণ প্রভুত্ব বিস্তার করে। তথা হইতে হযরত দানিশমান্দের আগমন হইয়াছে বলিয়া ধারণা করা হয়।’৯ এছাড়া তার লিখিত বই ‘পাঠকারী’১০ আগমনকাল ১২০০ খ্রিস্টাব্দের আগে উল্লেখ করেন। তাই ফরিদপুরে তার আগমন সময় সম্পর্কে খ্রিস্টীয় ১২০০ সালের আগের সময়টি অভিনিবেশযোগ্য।
বর্তমান ফরিদপুর জেলা শহরের ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়কের পূর্বপাশে পশ্চিম খাবাসপুরস্থ শাহ আব্দুর রহমান গঞ্জেরাজের তৎকালীন নিবাস ছিল। তার বংশধর খন্দকার আবুল ফজল গং প্রায় শত বছর আগে ১৫১ শতাংশ জমি ওয়াকফ করে শাহ আব্দুর রহমান গঞ্জেরাজ (রহ.) ওয়াকফ এস্টেট করেন। কুমার নদের তীরে এস্টেট প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৯ সালে এখানে একটি কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়।
শাহ আব্দুর রহমান গঞ্জেরাজ বোগদাদি এবাদোল্লাহেস সালেহীনের বংশধররা ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তৎসময় থেকেই বিভিন্ন স্থানে গমন করেন। বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল, মানিকগঞ্জ, পাবনা জেলা এবং ফরিদপুর জেলার ফরিদপুর সদর, নগরকান্দা ও বোয়ালমারীতে তার বংশধরদের আবাস রয়েছে।
সহজিয়া সুফি ভাবধারার ভক্তরা অনেক কাল আগে থেকেই ‘তার মাজারে মানতসহ বিভিন্ন ধরনের লোকাচার করতেন। দেড়শ থেকে পৌনে দুইশ বছর আগে এসব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে মাজার জিয়ারতের সুযোগ রয়েছে।’১১ বর্তমানে ফুলে ফুলে শোভিত মাজারটি শাহ আব্দুর রহমান গঞ্জেরাজ বোগদাদি এবাদোল্লাহেস সালেহীনের প্রত্যক্ষ চিহ্ন হিসেবে রয়ে গেছে।
এদিকে প্রখ্যাত সুফি সাধক শেখ ফরিদের নামানুসারে সর্বময় পরিচিত ফরিদপুর জেলা সুদূর অতীত থেকেই ঐতিহাসিক নিদর্শন ও পুরাকীর্তির এক অমূল্য ভা-ার। ‘শহরের প্রাণকেন্দ্র জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের উত্তর পূর্ব কোণে শেখ ফরিদের দরগাহ ভূমির অবস্থান। বর্তমানে এখানে দরগাহর কোনো অস্তিত্ব নেই; রয়েছে সুবিশাল গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। খ্রিস্টীয় ১৩০০ সালের দিকে নির্মিত দরগাহর অস্তিত্ব আজ না থাকলেও শেখ ফরিদের প্রতি মানতের সিন্নি-তবারক এখনো মাঝে মাঝেই তার ভক্তগণ বিতরণ করেন। এছাড়া মুরগি, মোরগ, ছাগলসহ তার প্রতি মানত দ্রব্য এখানে ভক্তদের পক্ষ থেকে বিতরণ করা হয়।’১২ শহরতলির গেরদায় ১০১৩ হিজরিতে (১৬০৪ খ্রিস্টাব্দ)’ দরবেশ শাহ আলী তার তিনজন সাথী শাহ হুসায়নি, হাজী সাদুদ উদ্দিন এবং শাহ্ মোহাম্মদ গোরাজকে নিয়ে নির্মাণ করেন গেরদা মসজিদ। সর্বশেষ ৭ এপ্রিল ১৯৭৮ সালে মসজিদটি বর্তমান রূপ পায়। এ মসজিদে দুষ্প্রাপ্য প্রত্নবস্তুর অবশিষ্টাংশ রয়েছে।১৩
‘শহরের ওয়ারলেস পাড়া কুমার নদের তীরে হাজী মো. দুদু শাহ্-এর ভালোবাসা আর মনুষ্যত্ব নীতির প্রচারস্থলটিই শাহ সাহেবের মাজার হিসেবে পরিচিত। বাংলা ১৩১০ সালে হাজী মো. দুদু শাহ্ এ স্থানে আসেন। তখন স্থানটি অনেকটা জঙ্গলময় ছিল। হাজী মো. দুদু শাহ্ একজন আধ্যাত্মিক রহস্য পুরুষ হিসেবে সুপরিচিত। ফরিদপুরের ওয়ারলেস পাড়া জঙ্গলে আস্তানা গড়ার আগে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া ভাগ্যের বিলে, মুকসুদপুরে, ফরিদপুরের বোয়ালমারীর ধোপাডাঙ্গা চাঁদপুর-কাদিরদী, রাজবাড়ীর আহলাদীপুর, ফরিদপুরের ঝিলটুলীতে বিভিন্ন সময়ে অবস্থান করেছেন। ওয়ারলেস পাড়া জঙ্গলে আস্তানার শুরুতে প্রথমে টিনের ছাপরা ঘরে থাকতেন। বর্তমানে এখানে নির্দিষ্ট সময়ে জিকির মাহফিল, আল্লাহ রাসুলের শানে কাওয়ালি-মুর্শিদী পরিবেশন, বড় পীর সাহেবের স্মরণে ১১ শরিফ, শব-ই-রবাত অনুষ্ঠান ও ফাতেহা ই ইয়াজদাহাম শরিফ অনুষ্ঠিত হয়।’১৪
তথ্যসূত্র: ০১, ০৭, ০৮, ১০: শাহ সুফি মওলানা মোবারক আলী (১৯০৯-২০১৩), ইমাম, শাহ আব্দুর রহমান গঞ্জেরাজ বোগদাদি জামে মসজিদ, পশ্চিম খাবাসপুর, ফরিদপুর। ২০০৭ সালে লেখকের সঙ্গে কথোপকথনে শাহ আব্দুর রহমান গঞ্জেরাজ বোগদাদি (রহ.) লিখিত বইয়ের তথ্যানুসারে তিনি এ তথ্য জানান। উল্লেখ্য, ইমাম সাহেব বৃহত্তর কুমিল্লার বর্তমানে চাঁদপুর জেলার বাসিন্দা ছিলেন। পুরাতন ফারসি ভাষায় তিনি পারদর্শী ছিলেন। তিনি বোগদাদি (রহ.) লিখিত বই অধ্যয়ন করেছিলেন।
০২, ০৩, ০৪, ০৫, ০৬, ১১: খন্দকার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর (কেএম জাহাঙ্গীর), ফরিদপুর। তিনি শাহ আব্দুর রহমান গঞ্জেরাজ বোগদাদির বংশধর। ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ তারিখে তার সঙ্গে লেখকের কথোপকথন। ০৯. লস্কারদিয়া হযরত শাহ্ আবদুর রহমান দানিশমান্দের (রহ.) বংশচরিত ও বংশলতিকা, বদিউজ্জামান চৌধুরী ভাদু, ফরিদপুর: ইতিহাস ঐতিহ্য, অষ্টম সংখ্যা, জানুয়ারি, ২০১১।
১২, ১৩: ফরিদপুরের প্রত্ন সম্পদ (২০২০), ড. মো. শওকত আলী মোল্লা, পারিজাত প্রকাশনী।
১৪. ইসমাইল হোসেন, খাদেম, শাহ্ সাহেবের মাজার, ওয়ারলেস পাড়া, ফরিদপুর; ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ তারিখে তার সঙ্গে লেখকের কথোপকথন। আলমগীর জয়: নির্বাহী সম্পাদক, প্রশাসন প্রবাহ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, ফরিদপুর




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com