কোনো প্রেসিডেন্টের মুখে ‘সত্য-মিথ্যার লড়াইয়ের চূড়ান্ত ফলাফল’ নিয়ে আলোচনা নিছক স্বাভাবিক বিষয় নয়। বিশেষ করে, ভালো ও খারাপের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের করুণ পরিণতি সম্পর্কে ক্যামেরার সামনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের খোলামেলা কথা বলার ঘটনা অস্বাভাবিকতার স্পষ্ট ইঙ্গিত।
ইউক্রেন যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিপর্যয়কর পরিণতি সম্পর্কে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আবারও সতর্ক করতে গত মঙ্গলবার সিএনএনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সাক্ষাৎকারে জ্যাক ট্যাপার বাইডেনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি কি কখনো ভেবেছিলেন যে তিনিই প্রথম প্রেসিডেন্ট, যাকে সত্যিকার অর্থে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ঠেকাতে, যিনি কিনা ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন যে, যুদ্ধে জিততে সব কয়টি বিকল্প ব্যবহার করবেন তিনি; এমনকি যুদ্ধে হেরে যাওয়ার প্রশ্নে, হতাশা থেকেই হোক বা ইচ্ছাকৃতভাবেই, বিশ্বের সবচেয়ে জঘন্য অস্ত্র তথা রাশিয়ার অস্ত্রাগারে মজুত বিপুল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতেও প্রস্তুত তিনিÍপারমাণবিক হিসাব-নিকাশ কষতে হবে, তাকে ঠেকাতে পারমাণবিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিষয়ে ভাবতে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তরে বাইডেন বলেছেন, ‘আমি মনে করি না সে (পুতিন) এই পথে (পারমাণবিক) হাঁটবে।’ তবে সপ্তাহখানেক আগে নিউ ইয়র্কে একটি তহবিল সংগ্রহের সময় এ বিষয় নিয়েই বেশ কড়া কথা শুনিয়েছিলেন বাইডেন। তিনি পুতিনের কাছে জনসাধারণের বার্তা পাঠিয়ে তার উদ্দেশে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘কৌশলগত পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করার পর তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখানোর চিন্তা করলে তা পুতিন ও রাশিয়া উভয়ের জন্যই ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে।’
বাইডেন বলেছিলেন, ‘আমি মূলত পুতিনের কথা বলছি। তিনি কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে তার দায় এড়িয়ে যেতে পারবেন না কোনোভাবেই। এটি করা তার কাছে যুক্তিসংগত বিষয় মনে হতে পারে, তবে এজাতীয় পদক্ষেপের বিপজ্জনক পরিণতি সম্পর্কে তাকে সতর্ক হতে হবে।’
‘ভুল কিছু ঘটতে পারে, গণনায় ভুল হতে পারে, কেউ কল্পনাও করতে পারবে না যে বাস্তবে কী ঘটবে এবং ভয়ংকর-চূড়ান্ত পরিণতির মধ্য দিয়ে সত্য-মিথ্যার লড়াই শেষ হতে পারে।’ জোর দিয়ে বলেছিলেন বাইডেন। তিনি এ-ও বলেছিলেন, ‘পারমাণবিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে হাজার হাজার মানুষ হত্যার শিকারে পরিণত হবে, তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং এর জবাবে যা করা হবে তা যে কারো আন্দাজের বাইরে।’ ‘পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করা হলে পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে প্রতিশোধের ঘটনা ঘটতে পারে’ বলে আশঙ্কা করা বিভিন্ন কৌশলবিদের ভয়ের বিষয়েও কথা বলেছেন বাইডেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া অবশ্যই প্রচলিত সামরিক পদক্ষেপের চেয়ে বেশি হবে না।’
‘পুতিনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর রেড লাইন তথা ইউক্রেনের মাটিতে পারমাণবিক বোমা ফেললে কিংবা কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করলে ওয়াশিংটন কী ব্যবস্থা নেবে’Íসিএনএনের পক্ষ থেকে এমন প্রশ্ন করা হলে বাইডেনের কৌশলী জবাব ছিল, ‘আমরা কী করব বা কী করব না, সে সম্পর্কে আগেভাগে কথা বলাটা আমার জন্য দায়িত্বজ্ঞানহীন হবে।’
বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ ও কৌশলবিদের অনুমান, পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার না করার অনেক কারণ রয়েছে। তাদের মতে, উল্লেখযোগ্য কারণ হলো, তেজস্ক্রিয় স্বল্পতার সম্ভাব্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে রাশিয়া। মোটাদাগে আরেকটি কারণ দেখানো যেতে পারে, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বাস্তবিক অর্থে এই যুদ্ধে বুদ্ধিমান, কার্যকর কৌশলগত না-ও হতে পারে। কিন্তু ক্রিমিয়া ব্রিজের বিস্ফোরণের পর এ সপ্তাহে ইউক্রেনের শহরগুলোতে পুতিনের নির্মম গোলাবর্ষণ ও আক্রমণ প্রত্যক্ষ করে এই যুক্তি মেনে নেওয়া কঠিন। বরং খেপাটে পুতিনের মুহুর্মুহু বোমা বিস্ফোরণ এটা স্পষ্ট করে যে, হাজার হাজার বেসামরিক মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করার মধ্য দিয়ে পুতিন নিজেকে বিবেকহীনতার এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, তার হাত ধরে কোনো মানবিক নজির স্থাপন হওয়ার সম্ভাবনা নিতান্তই ক্ষীণ। সাক্ষাৎকারে বাইডেন বলেছেন, ‘আমার বিশ্বাস ছিল, পুতিন একজন “যুক্তিবাদী নেতা”, কিন্তু পরে আমি দেখলাম যে আমার গণনা ভুল! তার উদ্দেশ্যগুলো আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়।’ এসব কারণেই বাইডেন ও বিশেষজ্ঞরা, যারা পারমাণবিকের মহাসর্বনাশ বন্ধ করার জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন বলে থাকেন, মনে করেনÍ‘পুতিন পারমাণবিকের রাস্তা ধরতে পারেন’ এমন সম্ভাবনাকে অবশ্যই গুরুত্বসহকারে নেওয়া উচিত। এমনকি সম্ভাবনা খুব কম থাকলেও তাকে খাটো করে দেখাটা বোকামি হবে। পারমাণবিক বিশেষজ্ঞ জোসেফ সিরিনসিওন সিএনএনের এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘পুতিনের পারমাণবিকের পথে হাঁটার সম্ভাবনা কম। কিন্তু তিনি যদি কোনোভাবে সেই পথে হাঁটেন, তবে তা পৃথিবীর জন্য খুব বাজে ফলাফল বয়ে আনবে। তিনি যদি শুধু একটি পারমাণবিক অস্ত্রও ব্যবহার করেন, তাহলেও তা আমাদের এমন এক পৃথিবীতে নিয়ে যাবে, যা হবে এক বিশাল ধ্বংসস্তূপ।’ এর পরিপ্রেক্ষিতে সিরিনসিওন মন্তব্য করে বলেছেন, ‘পশ্চিমকে ভয় দেখানোর জন্য পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে পুতিনের রাজনৈতিক হুমকিকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া যাবে না।’
সিরিনসিওন মনে করেন, ‘তার কাছে যুক্তি আছে। তার কাছে এমন সব যুক্তি রয়েছে, যা তাকে এই পথে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এমনকি এতে তার বিশেষ উদ্দেশ্যও আছেÍএই যুদ্ধে তিনি হেরে যাচ্ছেন। হতাশার মধ্যে যুদ্ধের মোড় নিজের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করার জন্য তাকে তো কিছু একটা করতেই হবে। ঠিক এমন একটা অবস্থায় তিনি পারমাণবিক অস্ত্রের দিকে যেতে পারেন।’ যদিও কিছু সমালোচক খোলামেলাভাবে কথা বলার জন্য বাইডেনকে দায়ী করছেন; কিন্তু মনে রাখতে হবে, দুই প্রেসিডেন্টের লক্ষ্য দুই ধরনেরÍরুশ প্রেসিডেন্ট বিশ্বকে ভয় দেখানোর জন্য পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে হুংকার দিচ্ছেন; বিপরীতে দুর্যোগের সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে তা এড়াতে প্রকাশ্যে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে থামাতে চাইছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
ইউক্রেনের যুদ্ধ এত বিপজ্জনক হয়ে ওঠার একটি বড় কারণ হলো, প্রায় আট মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত এমন কোনো কার্যকর কূটনৈতিক প্রক্রিয়া গ্রহণ করা যায়নি কিংবা তার কোনো সম্ভাবনাও নেই, যা এই সংঘাতকে থামাতে উল্লেযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। বরং এই যুদ্ধে প্রতিনিয়ত ঘটছে নতুন নতুন ঘটনা; ফলে সামনে আসছে নতুন নতুন ইস্যু। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অস্ত্র ব্যবহার করে ইউক্রেন বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করছে এবং রুশ বাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণ প্রতিহত করার মাধ্যমে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকা- ঠেকাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, স্বৈরাচারী শাসন আঁকড়ে থাকা পুতিন ব্যাপক হারে ব্যক্তিগত কৌশল-প্রতিপত্তি প্রয়োগ করে চলেছেন। এমনকি এখন পর্যন্ত বিশাল পরিমাণে রক্ত ঝরিয়েও চূড়ান্ত বিজয়ের পাল্লা নিজের দিকে ঘোরাতে পারছেন না তিনি।
সাক্ষাৎকারে বাইডেন ইঙ্গিত দিয়েছেন, পুতিনের সঙ্গে দেখা করার কোনো বাস্তব যুক্তি খুঁজে পান তিনি। তবে উভয় নেতাই আগামী মাসে ইন্দোনেশিয়ায় জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ান নেতার জন্য একটি আশার দ্বার উন্মুক্ত হতে পারে বৈকি। বাইডেন বলেছেন, পুতিন যদি মার্কিন বাস্কেটবল তারকা ব্রিটনি গ্রিনারের, যাকে মাদক চোরাচালানের দায়ে অভিযুক্ত ও দোষী সাব্যস্ত করে গত আগস্টে ৯ বছরের কারাদ- দিয়েছে রাশিয়া, বিষয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছুক হন, তবে তিনি তার সঙ্গে বসবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, গ্রিনার এবং আরেক মার্কিন নাগরিককেÍসাবেক মার্কিন মেরিন পল হুইলানÍঅন্যায়ভাবে আটক করেছে রাশিয়া। এ দুই মার্কিন নাগরিককে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে আটক রাশিয়ান অস্ত্র পাচারকারী ভিক্টর বাউটের সঙ্গে অদলবদল করার প্রস্তাব দিয়েছে ওয়াশিংটন। বাইডেনকে বলতে শোনা গেছে, ‘দেখুন, তার সঙ্গে দেখা করার কোনো ধরনের ইচ্ছা নেই আমার; কিন্তু জি-২০ সম্মেলনে তিনি যদি আমার কাছে আসেন এবং বলেন, আমি গ্রিনারের মুক্তির বিষয়ে কথা বলতে চাই, আমি তার সঙ্গে দেখা করব, তবে এটি নির্ভর করবে পরিস্থিতির ওপর।’ এ কথা বলার পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট বাইডেন এমন কথাও বলেছেন, যাকে কোনোভাবেই সরল-সাধারণ মনে হবে না; বাইডেনের মন্তব্য ছিল এ রকম, ‘তিনি (পুতিন) অত্যন্ত নৃশংস কাজ করেছেন; আমি মনে করি, তিনি যুদ্ধাপরাধ করেছেন এবং এ কারণে আমি এখন তার সঙ্গে দেখা করার কোনো যুক্তি দেখতে পাচ্ছি না।’
অর্থাৎ, সব মিলিয়ে বলতে হয়, ক্ষণে ক্ষণে নতুন রূপ নেওয়া ইউক্রেন যুদ্ধ ঠিক কোন পথে গড়াচ্ছে, তা নিশ্চিত করে বলাটা বেশ মুশকিল। বিভিন্ন সমীকরণ ও নানা জটিল হিসাবনিকাশের দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছে ইউক্রেনের চলমান সংঘাত। ( ইত্তেফাকের সৌজন্যে) লেখক :সিএনএনের হোয়াইট হাউজ প্রতিবেদক সিএনএন থেকে ভাষান্তর :সুমৃৎ খান সুজন