শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৪ অপরাহ্ন

আইএমএফ খেলাপি ঋণ কমাতে পদক্ষেপগুলো জানতে চায়

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় সোমবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২২

খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, সে বিষয়েও জানতে চেয়েছে বহুজাতিক এই সংস্থাটি। রবিবার (৩০ অক্টোবর) বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। সরকার আইএমএফের কাছে বাজেট সহায়তা হিসেবে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটির একটি প্রতিনিধি দল আলোচনার জন্য বাংলাদেশ সফর করছে। এরই অংশ হিসেবে আইএমএফের মিশন প্রধান রাহুল আনান্দের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর ও প্রধান অর্থনীতিবিদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের মতো বৈঠক করে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, খেলাপি ঋণ ছাড়াও মুদ্রানীতি, বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি, ঋণের সুদ ও মুদ্রার বিনিময় হার, স য়পত্রের সুদ হার, বন্ড ব্যবস্থাপনাসহ বেশ কিছু বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এসব আলোচনায় আইএমএফের বিভিন্ন প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের খেলাপি ঋণ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইএমএফের প্রতিনিধি দল। বর্তমানে খেলাপি ঋণ সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তারা খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে। পাশাপাশি ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ ও পুনর্গঠন সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের মাস্টার সার্কুলার প্রসঙ্গেও জানতে চেয়েছে আইএমএফ।
এদিকে খেলাপি ঋণের তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে আইএমএফসহ বিভিন্ন তরফ থেকে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞাকে আইএমএফ আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করেছে। তা না হলে ব্যাংকিং খাত নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের সঠিক তথ্য প্রকাশের কথাও বলেছে সংস্থাটি। তাদের মতে, খেলাপি ঋণের হার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি।
আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ পর্যন্ত সহনীয় বলে ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই হার প্রায় ৯ শতাংশ। সরকারি ব্যাংকে এই হার ২০ শতাংশের বেশি। এ বিষয়েও নানা প্রশ্ন তুলেছে আইএমএফ। একই সঙ্গে সন্দেহজনক লেনদেন ও অর্থপাচার নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়া সুশাসনের ঘাটতির কারণে আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকা বেনামি ঋণও নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করবে বলে মনে করছে তারা।
আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা হচ্ছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ঋণের বিষয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যেই নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে জানানো হয়।
বৈঠক প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, আগের দিনের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রবিবারও আইএমএফের সঙ্গে ফলপ্রসূ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আইএমএফ মিশনের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের আলোচনা আরও কয়েক দিন চলবে। তিনি বলেন, এক্সটেন্ডেন্ট ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি, র‌্যাপিড ফাইন্যান্সিং ইনস্ট্রুমেন্ট ও র‌্যাপিড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি— এই তিনটি স্কিমের আওতায় দেড় বিলিয়ন করে মোট সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ চাওয়া হয়েছে আইএমএফের কাছে। ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক আশাবাদী।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ জানতে চেয়েছে আইএমএফ। এর আগে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কয়েকটি সেশনে বৈঠক করে আইএমএফের প্রতিনিধি দল। প্রথম প‌র্বের বৈঠ‌কে বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণসহ আর্থিক খাতের সংস্কার, নীতি ও ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা হ‌য়। এরপর ওই দিন বিকেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ এবং অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে বসে প্রতিনিধি দল। এ সময় রিজার্ভসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা এবং বাজেট সহায়তা হিসেবে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে চাচ্ছে সরকার। এক্সটেনডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ), এক্সটেনডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) ও রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাস্টেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) কর্মসূচির আওতায় তিন কিস্তিতে দেড় বিলিয়ন করে এই ঋণ পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী সরকার। ঋণের বিষয়ে আলোচনা করতে গত বুধবার ১৫ দিনের সফরে ঢাকায় আসে আইএমএফের মিশন প্রধান রাহুল আনান্দের নেতৃত্বাধীন উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল।
এর আগের বৈঠকে আইএমএফ মিশনের কার্যক্রম ও পরিকল্পনা নিয়ে ৩০ মিনিটের একটি উপস্থাপনা তুলে ধরা হয়, যেখানে আইএমএফের ঋণের বিষয়টিও উঠে আসে। এ সময় রিজার্ভ সাশ্রয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া পদক্ষেপ এবং রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি পরিবর্তনের অগ্রগতি জানতে চায় প্রতিনিধি দলটি। এ ছাড়া সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ, বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন, স য়পত্র খাতের সংস্কার, ঋণের সুদের হারসহ মুদ্রানীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়।
আইএমএফের পক্ষ থেকে বলা হয়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার কয়েক দফা কমানোর পরও ঋণের সুদের সীমা দিয়ে রাখার কোনও যৌক্তিকতা নেই। এতে প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। তাই অর্থনীতির স্বার্থেই নীতি সুদহার তুলে দেওয়ার পরামর্শ দেয় দলটি। এ ছাড়া বৈঠকে টানা ডলার বিক্রির কারণে অব্যাহতভাবে দেশের রিজার্ভ কমে যাওয়া নিয়েও সংস্থাটির পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
আইএমএফ বলছে, এভাবে রিজার্ভ কমতে থাকলে তা দেশের অর্থনীতিকে বড় ধরনের চাপের মুখে ফেলতে পারে। আরেক বৈঠকে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য ও বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। এ ছাড়া বহিঃখাতের ঋণপ্রবাহ ও আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং রপ্তানি খাত ও বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ পরিস্থিতিও জানতে চাওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আইএমএফের প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়, তাদের ম্যানুয়াল অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাবপদ্ধতি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, রিজার্ভের হিসাবপদ্ধতি নিয়ে আগে থেকেই আপত্তি রয়েছে আইএমএফের। সংস্থাটির ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী, কোনও দায় রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হবে না। বিশেষ করে রিজার্ভের অর্থে গঠিত ইডিএফসহ বিভিন্ন ঋণ তহবিল, যা নন-লিকুইড সম্পদ, তা রিজার্ভ থেকে বাদ দিয়ে হিসাব করার কথা বলে আসছে আইএমএফ।
বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী হিসাব করলে এটি কমে দাঁড়াবে ২৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলার হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে মাত্র সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে বাংলাদেশ।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠকে রাজস্ব আদায় ও করের আওতা সম্প্রসারণে বিশেষ পদক্ষেপ চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। পাশাপাশি কর ফাঁকি বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ ও রাজস্ব আদায়ের কৌশল সম্পর্কে জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি।
রবিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সম্মেলন কেন্দ্রে রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি দল সংস্থাটির পক্ষে উপস্থিত ছিলেন। এনবিআরের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটি চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম ও আয়কর, ভ্যাট ও শুল্কনীতির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা বলেন, বৈঠকে আইএমএফের পক্ষ থেকে কর হার বাড়ানো হবে কি না বা কারও কারও ক্ষেত্রে যে কর আদায়ের সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সেসব সুবিধা তুলে নেওয়া হবে কি না, তা জানাতে চাওয়া হয়। যার জবাবে এনবিআর জানিয়েছে, বিদ্যমান মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে কর হার বাড়ানোর পক্ষপাতি নয়। এটা করলে করদাতাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে। তাই সেটা না করে করদাতারা যাতে সহজে ও কনফিডেন্সের সঙ্গে কর দিতে পারে, সেই পরিবেশ তৈরি করতে চায় এনবিআর। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই কর আদায় বাড়বে।
জানা গেছে, নতুন করে যে করের আওতা বাড়ানো হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে মার্জিনাল ট্যাক্স পেয়ারদের (প্রান্তিক করদাতা) কাছ থেকে বেশি পরিমাণ কর আদায় করা হবে কি না, জানতে চেয়েছে আইএমএফ। জবাবে রাজস্ব বোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে মুদ্রাস্ফীতির এ অবস্থা বিবেচনা করে প্রান্তিক কর প্রদানকারীদের ওপর করের হার বাড়ানো হবে না। সে ক্ষেত্রে আইএমএফের পক্ষ থেকে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির কৌশল জানতে চাওয়া হয়। এ সময় রাজস্ব বোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সেক্টরে যারা কর ফাঁকি দিচ্ছে, সেটা যথাসম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রাখা হবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com