আগামীকাল ২ নভেম্বর প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সিনিয়র নায়েবে আমীর সাবেক পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) শামসুর রহমানের ১৪তম মৃত্যু বার্ষিকী। তিনি বিগত ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন। মরহুম শামসুর রহমান উপমহাদেশের রাজনীতিতে ছিলেন একটি উজ্জলতম নক্ষত্র। অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন যাপনকারী, ইসলামী আন্দোলনের অকুতোভয় অগ্রসৈনিক অত্যন্ত স্পষ্টভাষী সাবেক এমএনএ (জাতীয় পরিষদ সদস্য) শামসুর রহমান আর কোনদিন আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই আদর্শের প্রতিক ১৯১৫ সালের ৫ মে খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের মঠবাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৃত কফিল উদ্দিন সরদার ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। মাতা মৃত শরিফাতুন্নেসা।
তার শিক্ষা জীবনটা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে সুদুর খুলনা মহকুমার প্রত্যন্ত গ্রাম মঠবাটি থেকে কপোতাক্ষের বুক চিরে নৌকা যোগে কলকাতা শহরে যেতেন। প্রায় ৬ মাস পর আবার নৌকা যোগে বাড়ি আসতেন। এভাবে তিনি কলকাতায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। ঐ সময়ে হাতে গোনা যে স্নাতক ডিগ্রিধারী লোক পূর্ববঙ্গে মুসলিম সমাজে ছিল, তার মধ্যে তিনি অন্যতম।
১৯৪৯ সাল থেকে তিনি সাংবাদিকতা পেশায় কাজ শুরু করেন। ৫০ এর দশকে তিনি নগরীর আলতাপোল লেন থেকে তাওহীদ পত্রিকা প্রকাশ করতেন। এরপর তিনি সাপ্তাহিক তাওহীদ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ইসলামের বিরুদ্ধে যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন। ঐ সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে একটি রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ায়, তৎকালীন সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ মাঠে নামে। গোয়েন্দা বিভাগ জানতে পারে যে, ঐ পত্রিকাটির সাথে শামসুর রহমান সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। তখন প্রশাসন তাকে বিভিন্ন অজুহাতে হয়রানি করে। তারপরেও বেশ কিছুদিন পত্রিকাটির প্রকাশনা অব্যাহত রাখেন। ২০০৩ সালে খুলনা প্রেসক্লাবে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি তার জীবনের এমন একটি ঘটনা প্রকাশ করে বলেন, সাংবাদিকতায় রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতা যুগে যুগে ছিল, এখনও আছে এবং থাকবে, তারপরেও কলমযোদ্ধারা সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এগিয়ে যাবে। সরকারী নিপীড়ন থেকে তিনি রক্ষা পাননি। তার ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রেসটি ও তৎকালীন সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন বাধ্য হয়ে তিনি পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় যোগ দেন। একজন সুলেখক হিসেবে তিনি যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করেন। অবজারভার এবং এসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি)র সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৮ আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের পর ১৯৫৯ সালে তার নেতৃত্বে খুলনা প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন শহরের মির্জাপুরস্থ জহুরুল হক সরদারের (মৃত্যু ১১ আগষ্ট ১৯৯০) বাড়ীতে শামসুর রহমানকে সভাপতি ও জহুরুল হক সরদারকে সেক্রেটারী করে খুলনা প্রেসক্লাবের প্রথম কমিটি গঠন করা হয়। ঐ কমিটিতে ছিলেন এমন দু’জনের নাম জানা গেছে, তারা হলেন এম এস ওয়ার্সী ও সৈয়দ সা’দ আলী। ক্লাবের সূচনালগ্নে শামসুর রহমান দৈনিক ইত্তেহাদ, জহুরুল হক সরদার সংবাদ সংস্থা ইউপিপি, সৈয়দ সা’দ আলী আজাদ, এম এস ওয়ার্সী মর্নিং নিউজের খুলনা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। শামসুর রহমান খুলনা প্রেসক্লাবের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাবিবুর রহমান ৫৯ সালে খুলনা সফরে আসেন। তার সফরসূচিতে প্রেসক্লাব পরিদর্শন অন্তর্ভূক্ত ছিল। কিন্তু খুলনাতে তখন কোন প্রেসক্লাব না থাকায় সাংবাদিকরা জহুরুল হকের বাড়িতে এক সভায় মিলিত হন এবং প্রেসক্লাব গঠন করেন। তবে প্রেসক্লাব গঠনের সঠিক মাস ও তারিখ জানা না গেলেও ঐ বছরের মধ্যবর্তী সময়ে প্রেসক্লাব গঠন করেন। তবে প্রেসক্লাব গঠনের সঠিক মাস ও তারিখ জানা না গেলেও ঐ বছরের মাধ্যবর্তী সময়ে প্রেসক্লাব গঠন করা হয়েছিল বলে প্রথম সভাপতি শামসুর রহমান নিশ্চিত করেছিলেন। জহুরুল হক সরদারের বাড়ির একটি কক্ষে প্রেসক্লাবের প্রথম কার্যালয়ের কাজ শুরু হয় বলেও তিনি ওই সময় জানিয়েছিলেন। যে কারনে বর্তমান প্রজন্মের সাংবাদিকরা মনে করেন খুলনার সাংবাদিকতা ও প্রেসক্লাবের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে শামসুর রহমানের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ শামসুর রহমান সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে খুলনার প্রবীণ সাংবাদিক ও খুলনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মনিরুল হুদা বলেন, তিনি একটি রাজনৈতিক আদর্শের বিশ্বাসী হলেও তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের মাঝে। সাংবাদিকতা পেশা ছেড়ে ফুল টাইম রাজনীতিবিদ হয়েও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাংবাদিকদের সাথে ছিল তার গভীর সম্পর্ক। যে কারণে খুলনার সাংবাদিক সমাজ তাকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
তিনি বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর দৈনিক পত্রিকা “দৈনিক সংগ্রাম” এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সুদীর্ঘ ২২ বছর তিনি দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সফলতার সাথে পালন করেন।