‘হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস/দম ফুরাইলেই ঠুস।/তবুতো ভাই কারোরই নাই/ একটুখানি হুঁশ ।’ সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হকের গীত রচনায় চির সবুজ গায়ক এন্ড্্রু কিশোরের কণ্ঠে, সংগীত গুরু আলম খানের সংগীতায়োজনে এবং নায়করাজ রাজ্জাকের ঠোঁটে এই গানটি বাঙালি দর্শক শ্রোতার জন্য একটি কালজয়ী অনবদ্য সৃষ্টি। এই গানের কলিগুলো শুনে মনের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার মাধুর্যে আপ্লুত হয়নি এমন শ্রোতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে, গানের দ্বিতীয় পঙ্ক্তিখানি যতটা কাব্যিক তার চেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক। সত্যিকার অর্থে মানুষের জীবন-যাপন শেষে যখন কবির ভাষায় ‘ঠুস’ বা নিঃশেষ হয়ে যায় তখন তার শেষ বর্ণনা একটিই- ‘শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন’। তাই জীবন চলমান রাখার জন্য, জীবনকে সুস্থ রাখার জন্য, জীবনকে উদ্যাপনের জন্য চাই সুস্থ ফুসফুস, সুস্থ নিঃশ্বাস আর সুস্থ বাতাস।
একটি সুস্থ ফুসফুসের গুরুত্ব যে কত ব্যাপক সেই বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রতি বছর ২৫শে সেপ্টেম্বর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে পালিত হয় ‘বিশ্ব ফুসফুস দিবস’। ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ, ফুসফুসের যতœ, বিভিন্ন ধরনের রোগ থেকে ফুসফুসকে রক্ষা করার উপায়, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও ফুসফুসের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে সবাইকে বিস্তারিতভাবে জানানো এবং নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে এই বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলার জন্য এই দিবসটি পালিত হয়।
ফুসফুসের যতেœর শুরু মাতৃজঠরে থাকায় সময় হতেই। গর্ভাবস্থায় মায়ের অপুষ্টি, বিভিন্ন সংক্রামক রোগের সংক্রমণ, সময়ের পূর্বে অপরিণত অবস্থায় স্বল্প ওজনের শিশুর জন্মগ্রহণ শিশুর ফুসফুসের বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। আবার জন্মের পর মাতৃদুগ্ধ পান নিউমোনিয়া, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ কমায়। তাই হবু মা এবং নতুন মায়ের যতœ শিশুর সুস্থ ফুসফুসের পূর্বশর্ত। অন্যদিকে ধূমপায়ী বাবা শুধুমাত্র তার পরিবারের সদস্যদের জন্যই নয়, এমনকি যে শিশুটি এখনও ভূমিষ্ঠ হয়নি তার জন্যও হুমকি। ধূমপায়ী মায়েদের জন্য এ কথাটি আরও বেশি সত্য। প্রকৃতপক্ষে, ধূমপান এমন একটি সামাজিক ব্যাধি যা শুধু ফুসফুসের মারাত্মক রোগ যেমন- সিওপিডি, ক্যান্সার ইত্যাদিরই প্রধান কারণ নয় বরং ধূমপানের জন্য হৃদরোগ, মস্তিষ্কে স্ট্রোক, উচ্চরক্তচাপসহ আরও বহুরোগের সৃষ্টি হয়। তাই সামাজিকভাবে ধূমপান বিরোধী আন্দোলনকে আরও বেগবান করা এবং ধূমপান বিরোধী আইনের কার্যকরী প্রয়োগ এখন অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফুসফুস বিভিন্ন সংক্রামক জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হবার একটি প্রধান অঙ্গ। করোনা মহামারী আমাদেরকে এই সত্যের সম্যকভাবে সম্মুখীন করেছে। সারা পৃথিবী এই ছোট্ট করোনাভাইরাসের কাছে অসহায় হয়ে স্তব্ধ অবস্থায় ছিল। একই ভাবে নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, ইনফ্লুয়েঞ্জা এমনকি বিভিন্ন ছত্রাকজনিত রোগেরও আকর এই ফুসফুস। আশ্চর্য হলেও সত্য; সামান্য স্বাস্থ্যবিধি যেমন- নিয়মিত হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার ইত্যাদির মাধ্যমে এই রোগগুলো অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। অন্যদিকে এই রোগগুলোর যে কোনোটি, যেমন- ‘যক্ষ্মা’ রোগ আক্রান্ত হলে রোগটির পূর্ণচিকিৎসা পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করতে হবে। নতুবা এই রোগগুলো শুধু জটিলতর হয়ে ওঠে তাই নয় বরং সঠিক মাত্রায় জীবাণুবিরোধী ওষুধ পূর্ণসময় পর্যন্ত গ্রহণ না করলে এই ওষুধগুলোর রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়, ফলে ওষুধগুলো ওই রোগের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর হয়ে পড়ে। বর্তমান সময়ে পরিবেশ দূষণ এবং বায়ুদূষণ একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। বায়ুদূষণের সরাসরি আঘাত হয় ফুসফুসে। অ্যাজমা, সিওপিডি সহ বিভিন্ন ফুসফুসের শ্বাসনালীর বাধাজনিত রোগের সৃষ্টি এই বায়ুদূষণের জন্য। অতএব পৃথিবীর সজীব নির্মল বায়ু নিশ্চিতকরণের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা ফুসফুসের যতেœর একটি অংশ।
জীবিকার প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের পেশা আমরা বেছে নেই। তার মধ্যে এমন কিছু পেশা আছে যা ফুসফুসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন- পাথর ভাঙা, জাহাজ ভাঙা, ওয়েলডিং, আঁশ ও তুষ জাতীয় উপাদানের সংস্পর্শে থাকা ইত্যাদি। এই পেশার কারণে তৈরি ছোট ছোট ধূলিকণা বা সূক্ষ্ণ তন্তু আমাদের ফুসফুসে আটকে বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি করতে পারে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে- কাজের সময় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করলে এই বিপর্যয় হতে রক্ষা পাওয়া সম্ভব- যে ব্যাপারে আমরা মোটেও সচেতন নই। তাই ‘অকুপেশনাল হেলথ্’ বা জীবিকা সংক্রান্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের আরও মনোযোগী হতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে, শ্বাস নিয়েই জীবনের শুরু আর নিঃশ্বাস ত্যাগেই জীবনের সমাপ্তি। মধ্যবর্তী সময়ের এই জীবনকালকে সুস্থ-সুন্দরভাবে সাজানো আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য। এজন্য শুধুমাত্র নিজের জন্য নয়, দেশ ও দশের জন্য আমাদের সময়, শ্রম, মেধা ব্যয় করা উচিত। ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপে সম্মিলিতভাবে সকলে উপকৃত হতে পারে। বিশেষত সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ফুসফুসের তথা সঠিক স্বাস্থ্য রক্ষায় আরও মনোযোগী হতে হবে। শুধু চিকিৎসা নয়, প্রতিরোধে উদ্যোগী হওয়ার এখনই সময়। করোনা মহামারি আমাদের সেই শিক্ষাটাই দিয়েছে। ২০২২ সালের বিশ্ব ফুসফুস দিবসে তাই আমাদের প্রত্যাশা। ‘লাং হেল্থ ফর অল’- সবার জন্য সুস্থ ফুসফুস। আর এজন্য চাই সংবেদনশীল, সমাজ সচেতন, প্রকৃতিপ্রেমী, পরিবেশবাদী, স্বাস্থ্য সচেতন, সুশৃঙ্খল একটি সমৃদ্ধ সমাজ। এই স্বপ্ন অবশ্যই পূরণ হওয়া সম্ভব; এই স্বপ্ন আমাদের পূরণ করতে হবেই।
লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ ও কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।