করোনা ভাইরাস পরবর্তী সময়ে বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে কতটুকু আশঙ্কার বিষয়, তা এখনই পুরোদমে পরিমাপ করা সম্ভব। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রতি বছর আশ্বিন-কার্তিক মাসে মঙ্গার প্রকোপ ব্যাপকভাবে টের পাওয়া যায়। কিছুদিন আগেই গিয়েছিলাম নিজ জন্মভূমি কুড়িগ্রামের গোড়াই রঘুরায় গমবাড়ী গ্রামে। গ্রামের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে আর্থিক সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলাম। চিরাচরিত কাল থেকেই ঐসব অঞ্চলে কার্তিক মাসে তেমন কোনো কাজ থাকে না, আয় রোজগারের পথ থাকে একেবারেই বন্ধ। তখন ঐসব অঞ্চলের বেশির ভাগ নি¤œবিত্ত পরিবারের মানুষের সংসার চলে সুদের ওপর টাকা নিয়ে কিংবা ইটভাটা সরদারের কাছ থেকে কাজ করার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে টাকা নিয়ে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক মহামন্দা-পরবর্তী বিশ্বে এই প্রথম আবারও আমরা আরেকটি মহামন্দার সম্মুখীন হতে যাচ্ছি। শুধু বাংলাদেশ পরিম-লে নয়, বহির্বিশ্বকে অত্যন্ত কঠিন এক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যদিয়ে যেতে হবে। গর্ব করার বিষয়, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে কৃষিপণ্যের দাম প্রতিনিয়তই বাড়ছে। যার কারণে বাংলাদেশের নি¤œবিত্ত শ্রেণির কৃষকরা সারসহ অনেক কৃষি উপকরণ কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। একদিকে, খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধসামগ্রীর দাম বেশ চড়া হওয়ায় কৃষকরা কৃষি উপকরণসামগ্রী কিনতে আগ্রহ হারাচ্ছেন। ফলে ফসলের ব্লাস্টসহ খোলপচা রোগ ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তা-বে গ্রামাঞ্চলের আমনখেতের ব্যাপক ফসলহানি ঘটেছে। সেজন্য আগামী আমন মৌসুমে ৩৫ লক্ষ্য টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তা ১৫-১৮ লক্ষ্য টন আমন উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা করেছেন কৃষিবিদরা। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, প্রাচীন বাংলার এই জনপদ অনেকবার দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছিল। বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল বাংলা সন ১১৭৬-এ (১৭৭০ খ্রি.) যেটি ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে ব্যাপক পরিচিত ছিল। মূলত আঠারো শতকের চলমান চরম অর্থনৈতিক মন্দার ঐ বছরে অতিবৃষ্টি-বন্যায় ব্যাপক ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা, খাদ্যবাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের ফলে সার্বিক অবস্থার অপরিসীম অবনতি ঘটে।
উল্লেখ্য, দুর্ভিক্ষ কেবল প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্টি হয় না, অনেক সময় মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষও মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। চীনা সমাজতন্ত্র দুর্ভিক্ষ ডেকে এনেছিল চীনা সমাজতাত্ত্বিক গুরু মাও সে তুং-এর গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড প্রজেক্টের কারণে। চীনা নেতা মাও সে তুং কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য একবার এক ফরমান জারি করলেন যে, চড়ুই পাখি অনেক ধান খেয়ে ফেলে। ফলে ধানের উৎপাদন কমে যায়। তাই তিনি চীন থেকে সমস্ত চড়ুই পাখি হত্যার নির্দেশ দেন এবং লোকজন তার আদেশ অনুযায়ী চড়ুই হত্যায় মেতে ওঠে। এমনকি মশা, মাছি, ও ইঁদুর পর্যন্ত রেহাই পায়নি। চড়ুই পাখি ও মশা-মাছি না থাকায় পতঙ্গপালের আক্রমণ বেড়ে যায় এবং ফসলের আবাদ সামগ্রিকভাবে বিনষ্ট হয়। ফলে ১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে খরা, প্রতিকূল আবহাওয়া ও চীন কমিউনিস্ট পার্টির নীতির কারণে চীনে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়, যা ইতিহাসে ‘সম্মুখগামী মহালম্ফ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। সরকারি পরিসংখ্যান মতে, উল্লেখ্য সময়ের মধ্যে ১ কোটি ৫০ লাখ লোকের মৃত্যু হলেও, অপ্রাতিষ্ঠানিক সূত্রে দুর্ভিক্ষপীড়িতের সংখ্যা ২ কোটি থেকে ৪ কোটি ৫০ লাখ হতে পারে।
এবার বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলার উঁচু জমিগুলোতে ইঁদুরের উৎপাত বেড়েছে। কৃষকরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু পেরে উঠছেন না। এ ব্যাপারে স্থানীয় কৃষি অফিসারদের অবহিত করলেও সরকারি যথোপযুক্ত কোনো প্রতিকার দৃশ্যত হচ্ছে না। সরকারের তরফ থেকে শুধু ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবকেই দায়ী করা হলেও আসন্ন দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় কৃষির বৈচিত্র্যময়তা বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না, অথচ দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় কৃষির অবদানই সর্বাধিক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি সব প্রোগ্রামেই উৎপাদন বাড়ানোর ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করছেনÍআলু, শস্যবীজ, সরিষা, শীতকালীন সবজি, ভে-ির তেল উৎপাদনের কথা প্রতিনিয়তই শোনা যাচ্ছে, ১ ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না রাখতে তাগিদ দিচ্ছেন, এসব কিছু দেশের স্বার্থেই অনুধাবন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ফসলের আবাদকে চাঙ্গা রাখতে মাঠ পর্যায়ে কৃষি অফিসারদের কেন নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে না যাতে গ্রামীণ পর্যায়ে শস্যসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য বেশি উৎপাদন করতে পারে কৃষক? গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে মহিলাদের অবদান বহুলাংশে সমাদৃত। কিন্তু কেন স্থানীয় কৃষি অফিসাররা মাঠপর্যায়ে গিয়ে মহিলাদের বিনা মূল্যে শস্যবীজ দিয়ে চাষাবাদে অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন না? গ্রামাঞ্চলে এই শুকনো মৌসুমে অনেক জলাধারসহ বিভিন্ন বিলে কেন সরকারিভাবে মৎস্য চাষ হচ্ছে না? অনেক গ্রামের সাধারণ লোকজন কেন প্রতিনিয়ত চাষাবাদ বিমুখ হচ্ছেন? কেন বাড়ির উঠোন/আঙিনা এখনো অনাবাদি?
বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়েছে বিশ্বের অন্তত ৭০ শতাংশ দেশে। বাংলাদেশে নতুন করে ২ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে এসেছে। করোনা মহামারির বিভিন্ন অর্থনৈতিক কৌশলগত কারণসহ মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণে বিশ্বের ৫৮ শতাংশ উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখন ৬ শতাংশের ওপরে। সেইসঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আমরা কিছুটা শঙ্কিত। খাদ্য মজুতের যতটুকু ক্ষমতা সরকারের আছে সেটা কোনোভাবেই বাজারকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। তার ওপরে মজুত আছে অর্ধেকের মতো। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা এবং দাম নিয়ে অস্থিরতা শুরু হয়ে গেলে মুহূর্তে সুযোগ নেবেন চাল ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন আড়তদাররা। সেই সময়ে সরকার যদি বাজারে বিভিন্ন রকম খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমাণ চাল ছাড়তে না পারে তাহলে বাজার ব্যবস্থা ভয়ংকর আকার ধারণ করবে।
তাই সরকারের উচিত, এই রকম পরিস্থিতি ঠেকানোর জন্য বাজারের সমস্ত সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে সরকারের হাতে যথেষ্ট খাদ্য মজুত রাখা। উপরোক্ত বিষয়াদির সমাধানকল্পে এখন পর্যন্ত সরকারের দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। ফলে আসন্ন দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় আমরা এক ‘অপ্রস্তুত ও অপ্রতিভ বাংলাদেশ’কে দেখতে পাচ্ছি। লেখক :শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।