আগেই বলা হইয়াছে যে শেখ সিকান্দরের প্রত্যাগমনের সুযোগে লাউড়-রাজ আবার নিজ রাজ্য পুনর্দখল করিয়া নিয়াছিলেন। কিন্তু গৌড় গোবিন্দের প্রভাবাধীন হইয়া পড়িয়াছিলেন। অনুচরদের মাধ্যমে হযরত শাহ জালাল (র.) ও ৩৬০ আউলিয়াসহ শেখ সিকান্দরের পুনরাভিযানের খবর জানিতে পারিয়া লাউড়-রাজ গোবিন্দের পরামর্শ মতে ব্রহ্মপুত্র নদীর নৌকা ইত্যাদি পারাপারের যাবতীয় ব্যবস্থা বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু ইহাতে কোনো ফল হয় নাই। মুসলিম বাহিনীসহ শাহ জালাল (র.) হরিণ চর্ম নির্মিত জায়নামাযে করিয়া নদী অতিক্রম করিতে সক্ষম হন।
ডা. এম আবদুল কাদের এবং জনাব এ জেড এম শামসুল আলম নদী পারাপারের নি¤েœাক্ত ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন। তাহারা বলেন, এতদঞ্চলে বাঁশ ও কলা গাছের দুর্ভিক্ষ কোনো দিনই ছিল না। কাজেই নৌকা চলাচল বন্ধ করিলেও পর্যাপ্ত সংখ্যক বাঁশঝাড় কাটিয়া ভেলা বানাইয়া অভিযানকারীরা ভেলাতে করিয়া নদী অতিক্রম করিতে সক্ষম হন। আরামের জন্য ভেলার উপর হযরত শাহ জালাল (র.)-এর হরিণ চর্মের জায়নামায বিছাইয়া রাখা হইয়াছিল বলিয়া তাহারা মনে করেন।
মুসলিম বাহিনী কর্তৃক ব্রহ্মপুত্র নদ এইভাবে অতিক্রমের সংবাদ পাইয়া লাউড়-রাজ ভাবিলেন এইবার আর রক্ষা নাই। তিনি সেখ সিকান্দরের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া মুসলিম বাহিনীর শক্তি পরীক্ষা করিয়াছিলেন যাহা ইতোপূর্বে বর্ণিত হইয়াছে। সুতরাং অনর্থক লোক ক্ষয় করিতে তিনি আর প্রস্তুত হইলেন না। পূর্বের মতো লাউড়ের অন্যতম রাজধানী সদরঘাট পরিত্যাগ করত লাউড়ের পাহাড়ে আবার সম্পূর্ণ রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে কোনো চুক্তির ফলেও এইরূপ হইয়া থাকিতে পারে। সিলেট বিজয়ের পরেও লাউড়-রাজ নির্বিবাদে রাজত্ব পরিচালনা করিতে পারিয়াছিলেন। তখন দীনারপুর তাহার রাজ্যভুক্ত হইয়া না থাকিলেও সেই অঞ্চলের তৎকালীন শাসকের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। দীনারপুর তখন স্বাধীন কোনো সামন্ত রাজার অধীনে ছিল, না লাউড় বা অন্য কোনো রাজ্যের অধীন ছিল এই বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন।
ইতিহাসের ধারায় ইহা সহজেই প্রতীয়মান হয় যে মুসলিম বাহিনী প্রথমত দীনারপুর পর্যন্ত মুসলমানদের অধিকারে আনিয়াছিলেন এবং সম্ভবত এই স্থানকে কেন্দ্র করিয়াই দ্বিতীয় পর্যায়ে গৌড় অভিযান পরিচালিত হইয়াছিল। প্রখ্যাত গবেষক জনাব এ জেড এম শামসুল আলম ইহার নি¤œরূপ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন। হযরত শাহ জালালের নির্দেশে একটি পূর্ণাঙ্গ তীরন্দাজ বহিনী নিয়োগ করা হয়। ‘সিলেট বিজয়ের পূর্বে বাংলার সুলতানের নিয়মিত তীরন্দাজ বাহিনী ছিল না। রাজা গোবিন্দের বিরুদ্ধে অভিযানকালে মুসলিমগণ তীরন্দাজ বাহিনীর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি অনুধাবন করিয়াছিলেন। সমকালীন ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানী সুলতান সামসুদ্দিন শাহের তীরন্দাজ বাহিনীর উল্লেখ করিয়াছিলেন। মুসলিমদের মশালধারী তীরবাহিনী এই যুদ্ধে সর্বাধিক সহায়ক ছিল। নিজস্ব অগ্নিতীর বাহিনীর আড়াল হইতে গোবিন্দের পদাতিক বাহিনী অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করিল, কিন্তু মুসলিম সেনাদলের নিক্ষিপ্ত মশালতীর তাহাদের সেই প্রচেষ্টা ব্যাহত করিয়া দিল। গোবিন্দ বাহিনী পূর্বেই শায়খ জালালের অলৌকিক শক্তির বিষয় অবগত ছিল। যখন ঝাঁকে ঝাঁকে মুসলিম নিক্ষিপ্ত তীর গোবিন্দের সেনাদলের উপর পড়িতে লাগিল তাহারা মনে করিল যে তাহাদেরই নিক্ষিপ্ত তীর শায়খ জালালের অলৌকিক শক্তির প্রভাবে তাহাদেরই দিকে ফিরিয়া আসিয়াছে। অল্প সময়ের মধ্যে গোবিন্দের সমস্ত সেনাদলে এই অলৌকিক কা-ের খবর প্রচার হইয়া গিয়াছিল। এই অপ্রত্যাশিত বিপদে রাজা গোবিন্দের সেনাদল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া গিয়াছিল। অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন ফকির চালিত সেনাদলের সঙ্গে যুদ্ধ করা অনেকেরই মতে নিরর্থক মনে হইয়াছিল। গোবিন্দ সেনাদলে যখন এইরূপ হতাশা এবং অনিশ্চয়তার ভাব বিরাজ করিতেছিল, মুসলিম পদাতিক বাহিনী, অশ্বারোহী বাহিনী তখন তীব্রবেগে আক্রমণ চালাইয়া যাইতেছিল। রাজা গোবিন্দের সেনাদলের শৃঙ্খলা এবং আত্মবিশ্বাস সমস্ত নষ্ট হইয়া গিয়াছিল। মুসলিম বাহিনী এই যুদ্ধে অধিক সুসজ্জিত ছিল। পরাজয়ের গ্লানি ধাড়রফ করার জন্য সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় সতর্কতা সিকান্দর শাহ করিয়াছিলেন। সেনাদলে শায়খ জালালের ন্যায় পরম ধর্মপরায়ণ সংসারত্যাগী ফকিরের উপস্থিতি তাহাদেরকে দিয়াছিল অপূর্ব আত্মবিশ্বাস। তাহাদের বিশ্বাস ছিল শায়খ জালালের (র.) উপস্থিতিতে রাজা গোবিন্দের যাদুবিদ্যা কার্যকরী হইতে পারিবে না। সিলেট বিভাগের প্রায় সমস্ত লোকই বিশ্বাস করেন যে, রাজা গোবিন্দের সেনাবাহিনী নিক্ষিপ্ত তীরই হযরত শায়খ জালালের (র.) অলৌকিক শক্তির প্রভাবে প্রত্যাবর্তিত হইয়া গোবিন্দের সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করিয়া দিয়াছিল। হযরত শায়খ জালালের জীবনী লেখকগণ প্রায় প্রত্যেকেই এই অলৌকিক কাহিনীর বিবরণ চিত্তাকর্ষকভাবে দিয়াছেন। এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী জয়লাভ করেন।’
উল্লেখিত যুদ্ধে গৌড় গোবিন্দের পরাস্ত হওয়ার বিবরণ ‘হযরত শাহ জালাল’ নামক পুস্তকে নি¤œরূপ বর্ণিত হইয়াছে।
কবির ভাষায়:
ইহা পরে শ্রীহট্টের চৌকী দিনারপুর
উপনীত হলে পরে গোবিন্দ চতুর
অলক্ষ্যেতে তাহাদের করি অবস্থান
শূন্যবোহে নিক্ষিপিল বহু অগ্নিবাণ
কিন্তু তাহা বিধাতার মহিমার গুণেতে
স্বীয় সৈন্যদলে গিয়া লাগিল পড়িতে
দেখিয়া গোবিন্দ এই কা- চমৎকার
বিস্মিত ত্রাসিত হইয়া সেইস্থান ছাড়িয়া
করিলেন পলায়ন রণভঙ্গ দিয়া।
বিজয়ী মুসলিম বাহিনী দিবাবসানে বাহাদুরপুর বা সতরসতি পরগণার অন্তর্গত ফতেপুর নামক স্থানে রাত্রি যাপন করেন। শায়খ জালালের দোয়া ও পরিচালনায় বিজয়ী হইয়া মুসলিম বাহিনী সিলেট অভিমুখে অগ্রসর হইতে থাকেন।
ডা. কুদরত উল্লাহ সাহেবের ভাষায়Í
এগিয়ে চলে রণ কাফেলা
না আছে সংশয়
আল্লাহ যাদের সাথে আছে
কিসের তাদের ভয়।
পূর্বের মতো তাঁহারা ক্রমে যখন সুরমা নদীর তীরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন তখন গোবিন্দ বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, আর রক্ষা নাই। তবুও তিনি নিজ ভাগ্য পরীক্ষার জন্য এক উপায় উদ্ভাবন করিলেন। তাঁহার অস্ত্রাগারে অতি প্রাচীন একটা লৌহ ধনুক ছিল। এইরূপ প্রবাদ ছিল যে, যে ব্যক্তি সেই ধনুকে গুণ যোজনা করিতে পারিবেন কেবলমাত্র সেই ব্যক্তিই গৌড় রাজ্যার্জনে সমর্থ হইবেন।
গৌড় গোবিন্দের বিশ্বাস ছিল কেহই ইহাতে গুণ যোজনা করিতে পারিবে না। তাই তিনি হযরতের কাছে উহা পাঠাইয়া জানাইলেন যে তাহার মধ্যে কেহ যদি ইহাতে গুণ আরোপ করিতে পারেন তবে তিনি বিনা যুদ্ধেই রাজ্য ছাড়িয়া যাইবেন। শাহ জালালের নিকট তাহা অবহিত করা হইলে তিনি তাহার অনুসঙ্গীদিগকে ডাকিয়া বলিলেন, যে ব্যক্তি কোনো দিন আসরের বা ফজরের নামাজ কাজা করেন নাই তিনিই এই কার্যসাধনে সক্ষম হইবেন। সকলের মধ্যে সৈয়দ নাসিরউদ্দিন (রঃ) এই কার্যের উপযুক্ত বিবেচিত হওয়াতে হযরত শাহ জালাল (র.) তাঁহাকে উক্ত ধনুকে গুণ যোজনা করিতে বলিলেন।
আশরাফ হোসেন সাহিত্যরতœ সাহেব কবিতার ভাষায় ইহার আকর্ষণীয় বর্ণনা দিয়াছেন, যাহা নি¤œরূপ:
উঠহে সৈয়দজাদা হিম্মত করিয়া
খামটাতে চড়াও চিল্লা বিছমিল্লা বলিয়া।
আল্লাহ পাকের হুকুমে নাসিরউদ্দিন (র.) সহজেই কৃতকার্য হইলেন। এই কথা জানিতে পারিয়া গোবিন্দ পলায়নের কথা চিন্তা করিতে লাগিলেন। পলায়নের পূর্বে একবার শাহ জালালকে দেখিবার আশায় গোবিন্দ এক সাপুড়িয়ার ঝুড়ির মধ্যে লুকাইয়া শাহ জালালের সামনে হাজির হইলেন। গোবিন্দ সাপুড়িয়াকে বলিয়া দিয়াছিলেন যে, যেই ঝুড়িতে সাপ থাকিবে শুধু সেই ঝুড়িটি খুলিতে। কিন্তু অপর ঝুঁড়িটি (যেখানে গোবিন্দ ছিল) তাহা না খুলিতে। সাপের খেলা দেখার আগ্রহ শাহ জালালের ছিল না।
কিন্তু এই চাতুরী খেলার বিষয় দিব্য চক্ষে অনুধাবন করিতে পারিয়া তিনি কোনো ভূমিকা না করিয়াই বলিলেন ‘গোবিন্দ, বাহির হইয়া আস!’ গোবিন্দ দেখিলেন এইবার আর রক্ষা নাই। তাঁহার চক্রান্ত শাহ জালাল (র.) ধরিয়া ফেলিয়াছেন। উপায়ান্তর না দেখিয়া গোবিন্দ ঝুড়ি হইতে বাহির হইয়া হযরত শাহ জালালের নিকট আত্মসমর্পণ করিলে, হযরত শাহ জালাল (র.) বলিলেন ‘গোবিন্দ তোমার অতীত ইতিহাস তালাশ করিয়া দেখ, উহা কলঙ্কের কালিমায় পরিপূর্ণ। তুমি ছিলে দেশের রাজা, আপামর জনসাধারণের সর্বপ্রধান নায়ক। তোমার কর্তব্য ছিল, ন্যায়নীতি ও ন্যায়বিচার করিয়া দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সেই পথ অবলম্বন না করিয়া তুমি প্রজাদলন নীতি অবলম্বন করিয়াছিলে। তোমার অত্যাচারে দেশবাসী ক্ষুব্ধ। মুসলমানদের প্রতি তুমি যে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাইয়াছ, তাহার নজির ইতিহাসের কোথাও নাই। তোমার শাস্তি হওয়া উচিত।’ গোবিন্দ এবারে নিজকৃত সকল অপরাধের কথা স্বীকার করিলেন এবং তাঁহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া জীবন ভিক্ষা চাহিলেন। হযরত শাহ জালাল (র.) তাহাকে ক্ষমা করিলেন। ক্ষমা করাই যে খোদা প্রেমিকের ধর্ম। ক্ষমাপ্রাপ্ত হইয়া রাজ্যের মোহ ত্যাগ করিয়া গোবিন্দ অতঃপর সিলেট শহর হইতে পলায়ন করেন।
কবি বলিয়াছেন:
রাজ্য ছাড়ি গেল রাজা পর্বত ভিতর
এর পর কি হইল তার না জানি খবর।
এইভাবে অত্যাচারী রাজার রাজত্ব খতম হইল।
গোবিন্দের পতনের বিষয়টি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকেও বিবেচনা করা যাইতে পারে। একাদশ শতাব্দীতে নিজামুল মুলক (১০১৭-১০২৯ খ্রি.) রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধীয় তদীয় সিয়াসতনামায় লিখিয়াছেন, ‘ধর্মহীন রাজ্য চলিতে পারে কিন্তু অত্যাচারীর রাজ্য চলিতে পারে না।’ ‘আত্তিবরুল মসবুক’ নামক গ্রন্থে ইমাম গাজ্জালী (র.)-ও এইরূপ বক্তব্য রাখিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, নবী (সা.) এরশাদ ফরমাইয়াছেন: কাফেরদের রাজত্ব স্থায়ী হইতে পারে কিন্তু অত্যাচারীর রাজত্ব কোনো দিন স্থায়ী হইতে পারে না। ইতিহাসে আছে এই জগতে অগ্নিপূজকদের রাজত্ব চার হাজার বৎসর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। তাহাদের রাজত্ব ন্যায় ও সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাহারা তাহাদের ধর্মের নির্দেশানুযায়ী অন্যায় অত্যাচারকে বৈধ বলিয়া ঘোষণা করিত না। তাহারা ন্যায় এবং সুনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শহর সমূহকে আবাদ করিয়াছিল। গোবিন্দ অত্যাচারী রাজা ছিলেন! এই জন্যই রাষ্ট্রনীতির সাধারণ নীতি অনুসারেই তাহার পতন অবশ্যম্ভাবী ছিল। বস্তুত হইয়াছেও তাই। কিন্তু প্রখ্যাত লেখক যদুনাথ সরকার তাহার History of Bengal নামক গ্রন্থে কতিপয় অবাঞ্ছিত ও বক্রোক্তি করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন These Saints Surrounded by a horde of less Scrupulous followers used to enter the territory of Hindu Rajas as sqautters on some pretexts or other, G. wU. †`‡ei Awfav‡b Squatter এর বাংলা প্রতিশব্দ লিখা হইয়াছে ‘জবরদখলকারী’। এইভাবে উক্ত গ্রন্থের ৮৯/৯০ পৃষ্ঠায়ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে আপত্তিকর বক্রোক্তি করা হইয়াছে। তিনি বলেন, ‘বেচারী গাভীকে সিলেট বিজয়ের জন্য দায়ী করা উচিত নয়।’ উপনিবেশবাদ সম্বন্ধে ইসলাম ধর্মের উপর বক্তব্য রাখিতে গিয়া অন্যান্য ধর্মের আবরণে তিনি যেসব বক্তব্য রাখিয়াছেন তাহার প্রতিও এখানে ইঙ্গিত করা হইয়াছে। মনে রাখা উচিত যে দেশ জয়ের জন্য বা দেশ বিজয়ের জন্য হযরত শাহ জালাল (র.) এই দেশে আসেন নাই। তিনি আসিয়াছিলেন ইসলামের শাশ্বত বাণী প্রচার করিতে। তিনি আসিয়াছিলেন গোমরাহ মানুষকে আল্লাহর পথে দ্বীনের দাওয়াত দিতে। তিনি আসিয়াছিলেন তাবলীগের তথা দ্বীনের দাওয়াতের মাধ্যমে এবং নিজ চরিত্র প্রভাবে মানুষকে ফিতরতের ধর্ম ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় দিতে। ইয়ামনের শাহযাদার রাজ্য ইয়ামন হাতের মুঠোয় পাইয়াও হযরত শাহ জালাল (র.) ইয়ামনে অবস্থান করেন নাই। এমনকি ইয়ামনের শাহযাদা নিজেও প্রতিষ্ঠিত পিতৃরাজ্যের মসনদ ত্যাগ করিয়া পরবর্তীকালে দরবেশ শাহ জালালের (র.) অনুসঙ্গী হইয়া সিলেটে আগমন করিয়াছিলেন। ইহাতেই প্রমাণিত হয় যে, এই সকল দরবেশদের পররাজ্য দখলের কোনো মোহ ছিল না। প্রকৃতপক্ষে ফকির দরবেশগণ ইহা হইতে বহু বহু ঊর্ধ্বে। এই বিষয়টি অনুধাবন করা উচিত নয় কি? গৌড় গোবিন্দের পলায়নের পর হযরত শাহ জালাল (র.) মুসলিম বাহিনীসহ সুরমা নদীর তীরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
কবির ভাষায়:
যখনে পৌছিলা তিনি নদীর কিনার,
নৌকা বিনা সেই নদীও হইলেন পার।
বর্তমান সিলেটের শেখঘাটের নিকট দিয়া সুরমা নদী অতিক্রম করিয়া মুসলিম বাহিনী সিলেট শহরে প্রবেশ করেন। আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে সিলেটের আকাশ বাতাস মুখরিত হইয়া উঠে। ডা. কুদরত উল্লাহ সাহেবের ভাষায়:
আকাশে বাতাসে আওয়াজ আল্লাহু আকবর
প্রতিধ্বনিতে গুজরে উঠে সেই একই স্বর
মায়ামন্ত্রে মুগ্ধ আসাম বাঙ্গাল
কণ্ঠে কণ্ঠে রব জয় শাহ জালাল।
হযরত শাহ জালালের (র.) আদেশে তিন দিবস পর্যন্ত আল্লাহর শোকর গুজারী করা হইল। অতঃপর তাঁহারই আদেশে হযরত নূরউল্লাহ বা শাহ চট্ (র.) সিলেটে প্রকাশ্যে আযান দিলেন। ইহার ফলে গোবিন্দের সাধের সাততলা পৌত্তলিক প্রাসাদ ভাঙ্গিয়া চুরমার হইয়া পড়িল। সিলেট বিজয়ের পর সিলেটে ইসলামের ধ্বজা উড্ডীন হওয়ায় বুরহান উদ্দিনের মনের সকল দুঃখ বিদূরিত হইয়া গেল। সিলেট বিজয়ের পর হযরত শাহ জালাল (র.) সিকান্দর গাজীর হস্তে সিলেটের শাসনভার অর্পণ করিয়া ধর্ম সাধনায় নিমগ্ন হন। সিকান্দর গাজীর পরবর্তী শাসনকর্তার নাম নূরুল হুদা গাজী। নুজহাতুল আরওয়াহ নামক গ্রন্থের লেখক শেখ আলী সের তদীয় বংশধর ছিলেন। ইহা গোলজারে আব্রার নামক গ্রন্থে উল্লেখিত হইয়াছে। অন্যান্য প্রসঙ্গ গোলজার লেখকের নিজস্ব বক্তব্য বলিয়া অনুমিত হয়। সিলেট বিজিত হওয়ার পর হযরত শাহ জালাল (র.) কঠোর রেয়াযত সাধনায় জীবন যাপন করেন। তাহাকে দ্বীনের দাওয়াতের জন্য বা তাবলীগের জন্য লোক নির্বাচন, নির্বাচিত লোকদের তালিম প্রদান, চতুর্দিক হইতে আগত লোকদের দর্শন দান, ভক্ত মুরিদবৃন্দের কার্যকলাপ নিরীক্ষণ, তাহাদিগকে মারেফতের সর্বোচ্চ দরজায় পৌঁছাবার জন্য ফয়েজ দান, নিয়োজিত শাসনকর্তাদের পরামর্শ দান ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাহাকে খেয়াল রাখিতে হইত। তাহারই প্রচেষ্টায় সিলেটে সর্বপ্রথম ইসলামি হুকমত কায়েম হয়।
হজরত শাহজালাল (র.)-এর ভাষণ: (১) যুবরাজ শেখ আলীর প্রতি: ‘প্রজাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করিও, তাহাদের প্রতি যুলুম করিও না। তাহাদের ন্যায্য দাবিগুলি মানিয়া লইও। ন্যায়বিচার করিও, সকল কাজে আল্লাহর আইনকে প্রাধান্য দিও।’
(২) গৌড় গোবিন্দের প্রতি: ‘তোমার অতীত ইতিহাস তালাশ করিয়া দেখ, উহা কলংকের কালিমায় পরিপূর্ণ। তুমি ছিলে দেশের রাজা। আপামর জনসাধারণের সর্বপ্রধান নায়ক। তোমার কর্তব্য ছিল ন্যায়নীতি ও ন্যায়বিচার করিয়া দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সে পথ অবলম্বন না করিয়া তুমি প্রজাদলন নীতি অবলম্বন করিয়াছিলে, তোমার অত্যাচারে দেশবাসী ক্ষুব্ধ, মুসলমানদের প্রতি তুমি যে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাইয়াছ তাহার নজির ইতিহাসের কোথাও নাই।’ রাজা গোবিন্দ নিজকৃত সকল অপরাধের কথা স্বীকার করিলেন ও তাঁহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া জীবন ভিক্ষা চাহিলেন। শাহ জালাল (র.) বলিলেনÍক্ষমা করাই খোদা প্রেমিকের ধর্ম। ক্ষমার সমান মহত্ত্ব আর কিছুই নাই। তবে তোমার যদি সুবুদ্ধি জাগিয়া থাকে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে নিজ অতীত কার্যকলাপ লক্ষ্য করিয়া থাক তবে উহার অনুশোচনা তোমাকে তিলে তিলে দগ্ধীভূত করিবে। সেই দহন জ্বালার হাত হইতে তোমাকে কেহই নিষ্কৃতি দিতে পারিবে না। যাও! তুমি মুক্ত। কোনো মুসলিম সেনা তোমাকে কিছুই বলিবে না।’৮
দুঃখের বিষয় ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার এই দিকটি বেমালুম চাপিয়া গিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, ‘the poor cow need not be blamed for this.’ কেহই তাহা করিবে না। আমাদের আলোচনায় দেখা যাইবে যে কেন মুসলিম শাসক গোবিন্দের যালেম শাহীকে খতম করার জন্য মুসলিম বাহিনী পাঠাইয়াছিলেন এবং কেনই বা ইয়ামনের হযরত শাহ জালাল (র.) ৩৬০ আউলিয়াসহ সিলেট অভিযান পরিচালনা করিয়াছিলেনÍযার ফলে সিলেট বিজিত হইয়াছিল। কাহারও রাজ্য অন্যায়ভাবে খামোকা জোরপূর্বক দখল করা বা সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য সিলেট বিজিত হয় নাই।
(৩) বোন্দালিশের অধিবাসীদের প্রতি: ‘তোমরা আল্লাহের পথে আস, তাহার দ্বীনকে মজবুত করিয়া ধর। যাহারা আল্লাহতালাকে নিজেদের মাবুদ বরহকরূপে গ্রহণ করে আল্লাহতালা তাহাদের প্রতি সদয় হন। তাহাদের অভাব অভিযোগ দূর করিয়া দেন। পক্ষান্তরে যাহারা আল্লাহর দ্বীনকে পরিত্যাগ করিয়া শয়তানের অনুগামী হয় আল্লাহতায়ালা তাহাদিগকে শয়তানের হাতেই সোপর্দ করেন। অতঃপর শয়তান তাহাদের সহিত যেমন ইচ্ছা ব্যবহার করে ও তাহাদিগকে দোজখের পথে নিয়া যায়। তোমরা যদি আমার আহ্বানে সাড়া দাও এবং আল্লাহর পথে ফিরিয়া আস, তবে অচিরেই দেখিতে পাইবে তোমাদের সকল কষ্ট দূর হইয়া গিয়াছে। শয়তান তোমাদের উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারিবে না। তোমরা সুখে শান্তিতে ও নিরাপদে বাস করিতে পারিবে।’
সিলেটের সামাজিক জীবনে হযরত শাহ জালালের (র.) প্রভাব: হযরত শায়খ জালালের ধার্মিকতা, সরল জীবনযাত্রার প্রভাব সিলেটের সামাজিক জীবনে অত্যন্ত গভীর। সিলেট জেলার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ অত্যন্ত সহজ সরল জীবনযাপন করিয়া থাকেন। প্রাচীন পরিবারগুলির জীবনযাত্রা এখনও সরল অনাড়ম্বর ও নৈতিকতাকেন্দ্রিক। সিলেটবাসীদের সরল জীবনযাত্রার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। এখানকার শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত লোকদের সাদা কাপড়ের টুপি (কিস্তি টুপি) পরিধান করিতে দেখা যায়। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য জেলায় সাধারণ অশিক্ষিত ও দরিদ্রগণই কিস্তি টুপি পরিধান করিয়া থাকেন। কিন্তু সিলেট জেলার অত্যধিক সমৃদ্ধিশালী ইংরেজি শিক্ষিত মার্জিত রুচিসম্পন্ন শরিফ লোকদেরকেও অফিস আদালতে, ঘরে-বাইরে সর্বত্র একটা অতি পরিষ্কার ধবধবে সাদা কাপড়ের টুপি পরিধান করিয়া চলাফেরা করিতে দেখা যায়, অত্যধিক ধর্মপরায়ণ লোক কমবেশি প্রত্যেক জেলায়ই আছে। পূর্ব বাংলার মানুষ ধর্মমুখী। আমাদের বিশ্বাস সিলেটবাসীগণ সাধারণভাবে অন্যান্য জেলার অধিবাসীগণ অপেক্ষা সম্ভবত অধিক ধর্মপরায়ণ। আমাদের দেশে সামাজিক মর্যাদা এবং আভিজাত্য নির্ভর করে বিত্ত সম্পদ এবং তথাকথিত বনেদি ঘরের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কের উপর। যদি কোনো ব্যক্তি বিত্তশালী হইয়া উঠে এবং বাড়িঘর আসবাবপত্র খানিকটা জৌলুসপূর্ণ করিয়া তোলে, সে সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হইয়া যায় যদিও তাহার জীবনকালে সে বনেদি হইতে পারে না, কিন্তু তাহার তৃতীয় বা চতুর্থ অধঃস্তন বংশধরগণ বনেদি বলিয়া সমাজে স্বীকৃতি পাইবে। যাহাদের অর্থ সম্পদ আছে তাহাদের হাতেই থাকে সামাজিক নেতৃত্ব। তাহারা ধার্মিক হইতেও পারে, নাও হইতে পারে।
হযরত শায়খ জালালের (র.) শিষ্যগণের বংশধরগণ এবং তাঁহাদের মাযারের খাদেমগণ শরিফ বা খান্দানি বলিয়া সর্ববাদী স্বীকৃত ছিলেন। যাহারা সেই হিসাবে আভিজাত্য দাবি করিবেন নৈতিক বিশৃঙ্খলা তাহাদের দাবির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ছিল। তাই সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর মধ্যে সৃষ্টি হয় ধর্মপরায়ণতার ঐতিহ্য। পরবর্তীকালে যাহারা সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর কোটায় পদার্পণ করেন তাঁহারাও বাধ্য হইয়াই নৈতিকতার ঐতিহ্য বজায় রাখেন। সিলেটের সামাজিক জীবনে হযরত শায়খ জালালের (র.) অন্যতম প্রভাব হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির ক্ষেত্রে। ইহা অবশ্যই সত্য যে শাহ জালাল (র.) হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দকে পরাজিত করিয়া সিলেটে মুসলিম আধিপত্য স্থাপন করেন। কিন্তু হিন্দুদের প্রতি তাঁহার কোনোরূপ ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছিল না। রাজা গৌবিন্দ খুব অত্যাচারী রাজা ছিলেন। তাহার অত্যাচারের শিকার শুধু বুরহানউদ্দিনের ন্যায় মুসলিমগণই ছিল না বরং হিন্দুরাই ছিল সংখ্যায় অধিক। গৌড় গোবিন্দের পরাজয়ে অধিকাংশ হিন্দুই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। হযরত শায়খ জালাল (র.) হিন্দুদের ধর্মে আঘাত দেন নাই, তিনি কোনো হিন্দুকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করেন নাই। তাহার কাছে হিন্দু মুসলমান সকলেই ছিল আদম সন্তান। দীনকান্ত চক্রবর্তী সাহিত্য সিন্ধু মাসিক শ্রীভূমিতে (ভাদ্র ১৩২২ বাং : পৃষ্ঠা ৩১১-৩১২) লিখিয়াছেন, ‘পীর শাহ জালালের গুণগানে বিমোহিত হইয়া বহু হিন্দু ইসলামের আশ্রয় গ্রহণ করিল। গোবিন্দ দেবের আত্মীয়স্বজনও স্বধর্ম পরিত্যাগ করিল। এমনকি লাউড়ের ব্রাহ্মণ রাজপরিবার ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হইয়া অতঃপর রাজা স্থলে রেজা উপাধিতে সম্মানিত হইলেন।
সুরেন্দ্র কুমার দাস চৌধুরী তাঁহার শাহ জালালের মাটি পুস্তকে (পৃষ্ঠা ৩৩) লিখিয়াছেন, ‘হযরত শাহ জালাল (র.) এবং তদীয় অনুসঙ্গীগণের মধ্যে কেহ কখনও কোনো অবস্থায় হিন্দু দেবদেবীর প্রতি কোনোরূপ অন্যায় ব্যবহার করিয়াছিলেন বলিয়া শোনা যায় নাই। শ্রীহট্ট বিজয় অসির সাহায্যে সম্পন্ন হয় নাই। পাশবিক বল প্রয়োগের কোনো নিদর্শন কোথাও নাই। হযরতের অনুসঙ্গীরা প্রায় সব নির্জন বনভূমিতে বাস করিয়াই ইষ্ট নাম জপ করত কালাতিপাত করিয়াছিলেন। তাঁহারা নিজ তপঃসিদ্ধির প্রভাবে শত্রু হূদয় জয় করিয়া বিনা রণে বিনা রক্তপাতে শ্রীহট্টে ইসলামের বিজয় বৈজন্তী উড্ডীয়মান করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।’ এইসব ঐতিহাসিক সত্যকে উপেক্ষা করত যদুনাথ সরকার তাঁহার ‘হিস্টরি অব বেঙ্গল’ নামক গ্রন্থে কতিপয় বক্রোক্তি করিয়াছেন। এই জন্য উক্ত গ্রন্থ অনেকের নিকট সুখপাঠ্য হয় নাই। একইভাবে অমলেন্দু দে তদীয় বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ গ্রন্থে (পৃ. ১২১) লিখিয়াছেন যে তরবারির সাহায্যে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শ্রীহট্টসহ এতদঞ্চলে বাঙালি জাতিকে [?] ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হয়। এই বক্তব্য যে মিথ্যা তাহা পূর্বোক্ত বৃত্তান্তে প্রমাণিত হইয়াছে। (দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী প্রণীত জালালাবাদের কথা (১৯৮৩) গ্রন্থ থেকে সংকলিত)