শাসক, অনুচর ও স্তাবক ত্রিভুজের তিনটি বাহুর মতো অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তিনটি বিষয়। শাসক থাকলে তার কিছু অনুচর ও সমর্থক থাকবেই। আর থাকবে কিছু স্তাবক বা মোসাহেব এবং তাদেরকে ঘিরে দুর্নীতির চক্র। সমস্যা হলো, কে নিষ্ঠাবান, সৎ অনুচর আর কে মতলববাজ-দুর্নীতিবাজ স্তাবক, তা নানা কারণে সচরাচর শনাক্ত করা যায় না। খোদ শাসকগণই অনুচর ও স্তাবকদের চক্করে আবর্তিত হয়ে অনুচরের আনুগত্য ও স্তাবকের স্তাবকতা-দুর্নীতি ধরতে পারেন না কিংবা সেই জালে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে আটকে পড়েন। ফলে তারা বিভ্রান্ত হন ও ভুল করেন। এমন ভুলের কারণে শাসকের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পায়। এই সমস্যা ইতিহাসের পদে পদে বহু শাসককে বিপদগ্রস্ত করেছে এবং এখনও করছে। আনুগত্য মনে করে স্তাবকতার জালে ফেঁসে গেছেন শাসক। বিষয়টি উপমহাদেশের প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ জহরলাল নেহরুর দৃষ্টি এড়ায় নি। এ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন তিনি।
ঔপনিবেশিক বৃটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কারণে নেহরু তখন উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ শহরে নৈনি জেলে কারারুদ্ধ। তিনি জেল থেকে একগুচ্ছ চিঠি লেখেন বালিকা-কন্যা ইন্দিরাকে। সেটা ছিল ১৯২৯ সাল। বৃটিশ শাসন থেকে ভারতের মুক্তির দাবি জানানোর অপরাধে বন্দি নেহরু গল্পচ্ছলে লিখছেন, আধুনিক মানুষের সভ্যতা কী ভাবে শ্রমবণ্টন ব্যবস্থা চালু করে ‘লিডার’ তৈরি করে, যে পরে ভৌগোলিক সীমা নির্দিষ্ট করে শাসক হয় এবং সেই সঙ্গে তৈরি হয় তার কিছু অনুচর ও স্তাবক। এই স্তাবকেরা একে অন্যের থেকে কিছু বেশি সুবিধে পেতে শাসককে ঘুষ দিতে শুরু করে, দুর্নীতির যাবতীয় সূত্রপাত সেখান থেকেই, এটাই নেহরুর মত, যা পরবর্তীতে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে সংযোজিত হয়। উল্লেখ্য, নেহরুর কিছু ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বন্ধু চিঠিগুলোর বৈশিষ্ট্য দেখে সেগুলোকে বৃহত্তর পাঠকের সামনে তুলে ধরার পরামর্শ দেন । ফলে তিনি ৩১টি চিঠি সংকলিত করে ১১৯ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন, যার নাম ‘‘Letters from a father to his daughter’। বিখ্যাত হিন্দি ঔপন্যাসিক মুন্সি প্রেমচাঁদ এই বই হিন্দিতে অনুবাদ করেন ‘পিতা কে পত্র পুত্রীকে নাম’। ‘কল্যানীয়াসু ইন্দু’ শিরোনামে বাংলাও অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল বইটির।
জীবনের নানা পর্যায়ে কারাগারে থেকে নেহরু আরও লেখালেখি ও পড়াশোনা করেন। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৩৩ সালের আগস্ট এই তিন বছরের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন কারাগারে তিনি আরেক বিখ্যাত গ্রন্থ Glimpses of World history রচনা করেন। যদিও এই কারাজীবন নেহরুর কাছে ছিল ‘অবকাশ ও নির্লিপ্তর সুযোগ গ্রহণ’, তথাপি তা কাজে লাগান। বিশেষ করে, যে দীর্ঘ সময় তিনি কারাগারে ছিলেন, সে সময় একমাত্র কন্যার শিক্ষার তত্ত্বাবধান করার সরাসরি সুযোগ তাঁর ছিল না। তিনি তাই চিঠির মাধ্যমে সে সুযোগ তৈরি করেন। যে চিঠিগুলো পরবর্তীতে কন্যা ইন্দিরাকে সুদক্ষ শাসকে পরিণত করার পাশাপাশি বিখ্যাত গ্রন্থে পরিণত হয়।
ইতিহাসের গবেষণায় সরকারি চিঠিপত্রের পাশাপাশি ইতিহাস চর্চায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ব্যক্তিগত চিঠিপত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকাতে প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ চিঠি লেখা হয়েছিল। এগুলো বেশিরভাগ যুদ্ধরত সৈনিক ও তার পরিবারের মধ্যে লেখা। ঐ চিঠিগুলেতে ধরা পড়ে যুদ্ধপরিস্থিতি, মানবিক যন্ত্রণা, সমকালীন সমাজের ইচ্ছে-অনিচ্ছা, চাওয়া পাওয়ার প্রতিফলন। আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যোগদানকারী ভারতীয় সৈনিকদের চিঠি থেকে পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় সৈনিকদের অসহায়তা ও কষ্ট, এমনকি প্রতিবাদের কথাও জানা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস চর্চায়ও ব্যক্তিগত চিঠিপত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বলা বাহুল্য, তখন ব্যক্তিগত যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল চিঠিপত্র । ভারতীয় নেতৃবৃন্দ পরস্পরকে যে চিঠিপত্র লিখেছিলেন যেখানে সমসাময়িক ঘটনা, রাজনীতির কথা যেমন আছে, তেমনি বিভিন্ন ঘটনার বিশ্লেষণ এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিচ্ছুরণও রয়েছে। নেহরু ছাড়াও জিন্নাহ, গান্ধি, সুভাষচন্দ্র বসু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, বল্লভ ভাই প্যাটেলের চিঠিপত্রের উদাহরণ সর্বজনবিদিত।
এই ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের ক্ষেত্রে অনন্য নজির হলো কন্যা ইন্দিরাকে লেখা পিতা জহরলাল নেহরুর চিঠির সংকলন । নেহরু যখন জাতীয় রাজনীতিতে ব্যস্ত কিংবা কারাগারে বন্দি থাকতেন, তখন তাঁর একমাত্র কন্যা দশ বছরের ইন্দিরা নিঃসঙ্গ শৈশব কাটাচ্ছিলেন। চিঠির মাধ্যমে মেয়েকে কিছুটা সহচর্য ও সঙ্গ দেওয়ার পাশাপাশি জীবজগৎ ও মানুষ সম্বন্ধে নিজের উপলব্ধিকে মেয়ের কাছে তুলে ধরার জন্য তিনি কিছু চিঠি লেখেন, যা পরিণত হয় ইতিহাসের অংশে এবং উচ্চতর সাহিত্যে। নেহরু তাঁর বই এর ভূমিকায় লেখেন, আশা করি তাদের মধ্যে যারা এগুলো পড়বে তারা আস্তে আস্তে আমাদের এই পৃথিবীকে বিভিন্ন জাতি দিয়ে তৈরি একটি বৃহৎ পরিবার হিসেবে ভাবতে শুরু করবে এবং কিছু সংশয় থাকলেও এও আশা করি যে চিঠিগুলো লেখার সময় যে আনন্দ পেয়েছি এগুলো পড়ে তারাও কিছুটা আনন্দ পাবে। প্রাচীন মহাকবি ও অন্ধ লেখক হোমারের মহাকাব্যেও অনেক বিষয়ের পাশাপাশি শাসক, অনুচর ও স্তাবকের প্রসঙ্গ এসেছে। সেখানে, সেই আমলেও সাধারণ মানুষ থেকে দেবতাদের পর্যন্ত ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার কথা আছে। ছল-চাতুরি-কপটতার বর্ণনা রামায়ণ ও মহাভারত-এও প্রচুর। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে অপরাধীকে হত্যার সময় যাতে কষ্ট কম দেওয়া হয়, সে কারণে জল্লাদকে ঘুষ দেওয়ার প্রচলন ছিল। হাজার হাজার বছর ধরে সারা পৃথিবীতে শাসককে সন্তুষ্ট রাখতে এবং অন্যের থেকে কিছু বেশি সুবিধে পেতে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে ঘুষ, দুর্নীতি ও স্তাবকতা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারি কর ব্যবস্থায় দু’রকমের কর আছে, প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ করের হিসাব সরাসরি, আয় থেকে মুষ্টিমেয় লোক দেয়। কিন্তু পরোক্ষ করের আওতায় দেশের প্রত্যেকটি মানুষ আসে, জিনিস কিনলেই তার জন্য কর দিতে হয়। করের মতোই দুর্নীতিও দু’রকমের, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। দুর্নীতির মধ্যে দুটো ক্ষেত্র খুব সংবেদনশীল- ঘুষ বা চুরি, এবং যৌনতা সংক্রান্ত ব্যাপারস্যাপার যেমন পরকীয়া, ধর্ষণ ইত্যাদি, বিশেষ করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা ‘সেলেব্রিটি’ যদি জড়িয়ে থাকে। ছোটখাটো দুর্নীতির ঘটনায় আদালতে বিচার ও শাস্তি হয়। কিন্তু রাজনীতিক ও সেলেব্রিটিদের দুর্নীতির ঘটনার অনুসন্ধান দুর্নীতি-সন্ধান এজেন্সি দ্বারা শুরু হলেই ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-ও শুরু হয়ে যায়, জনগণ প্রভাবিত হয়, পক্ষে বা বিপক্ষে। তখন, বিচারের আগেই মিডিয়ায় ও চায়ের কাপে তর্ক-বিতর্কের ঝড় শুরু হয়। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার, প্রবল আলোচনা হলেও প্রায় কোনও ঘটনারই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় না।
ফলে প্রকৃত বিচারের বদলে চলে আসে নি¤œরুচির রাজনৈতিক অভিসন্ধি ও প্রতিশোধের ভাবনা। এই সুযোগ কাজে লাগায় স্তাবক গোষ্ঠী। আসল ঘটনাকে ঘোলা জলে ভাসিয়ে দেয় তারা। সাধারণ মানুষ তখন চরমভাবে বিভ্রান্ত হয়। তারা বুঝতে পারে না যে, কত কোটি টাকা চুরি হলে সেটাকে চুরি বলে সাব্যস্ত করা যাবে? স্তাবকদের হট্টগোলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চুরির মধ্যেও তালগোল পাকিয়ে ফেলে আমজনতা। সাধারণভাবে এটা সকলেরই জানা যে, প্রত্যক্ষ চুরির মধ্যে রয়েছে ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, লুট, সরাসরি ঘুষ নেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু পরোক্ষ চুরির রূপ অনেক। টাকা ছাড়াও আরও কত কী চুরি করা যায়, তার ইয়ত্তা নেই। আসলে, শাসন ও প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কত রকমের চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে প্রচুর মানুষ যুক্ত, অথচ সেগুলো এতই স্বাভাবিক যে, তাকে চুরি বলে মনেই হয় না। কারণ এখানে সরাসরি টাকা চুরি হচ্ছে না, কিন্তু ঘুরপথে নানা সুবিধা নেওয়া হচ্ছে যার হিসাব হয় টাকায়। যেমন, যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানা দায়িত্বে থেকে কর্তব্যকর্ম করে না, নিয়মিত দেরিতে অফিস যায় বা আগে বেরিয়ে আসে, কাজে ফাঁকি মারে, ছুটির দরখাস্ত ছাড়াই গরহাজির, টুরে না গিয়ে বা গিয়েও কম সময় থেকে বিল জমা দেয়, বিভাগের স্টোরে জিনিস কেনার সময় অর্থ বা দ্রব্যের বিনিময়ে কমিশন নেয়, অফিস পলিটিক্স করে কাজের পরিবেশ নষ্ট করে ইত্যাদি। তারাও আসলে টাকা-ই চুরি করছে। এ ভাবে একটা লোক সারা জীবনের চাকরিতে কত লক্ষ টাকা চুরি করল, তার হিসাব কে জানবে? আবার সে লোকই শাসক বা কর্তার স্তাবকতা করে বহাল তবিয়তে থাকছে। বৃটিশ আমল থেকেই সরকারি বা বেসরকারি কাজে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্যে ঘুষের প্রচলন ছিল, যা পরে প্রচলিত হয় ‘কুইক-সার্ভিস মানি’ এবং ‘স্পিড মানি’ নামে। আগেও যেমন, এখনও তেমনি সাধারণ মানুষ ঘুষ দিতে বাধ্য হন, নইলে কাজ হবে না। যারা দেন না তারা ভুগেন। থানা, হাসপাতালে কাতরানি শোনা যায় তাদের। ভূমি অফিসে চক্কর দেন। আগে সিগারেটের প্যাকেটে বা মিষ্টির প্যাকেটে টাকা দেওয়ার এক প্রকার অঘোষিত বাধ্যবাধকতা ছিল, যা এখন ওপেন সিক্রেটে দরদাম করেই করা হয়। রোগীর জন্য বেড পেতে কত টাকা, মামলা থেকে বাঁচতে কত টাকা, অফিসের কাজ বা ফাইল দ্রুত করতে কত টাকা, তা এক প্রকারে নির্ধারিত হয়ে আছে নানা দপ্তরের পরিপ্রেক্ষিতে। বিশাল অঙ্কের টাকা ডোনেশন দিয়ে স্কুল বা ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি পড়ার প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার প্রবণতা পরোক্ষ ঘুষ বা দুর্নীতি হলেও তা সবার নাকের ডগায় চলছে। সেই প্রমাণহীন ‘ডোনেশন’-এর কোনও হিসাবও থাকে না। কার টাকা কার পকেটে যায়, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। তা-ও মানুষ মেনে নিয়েছে। টাকা দিতে বাধ্য হচ্ছে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত স্তাবকদের বড় বড় কথাবার্তাও মানুষ বাধ্য হয়ে শুনছে।
মানুষের রিপুগুলো আসলেই খুব বিচিত্র, শক্তিশালী ও সক্রিয়, যার একদিকে লোভ, লাভ ও লালসা আর অন্য দিকে আছে সংযম ও শুভবুদ্ধি জাগিয়ে তোলা মন। এই দুই বিপরীত স্বভাবের মধ্যে চলে অবিরাম যুদ্ধ। অশুভ শক্তিকে দমিয়ে রাখাটাই সভ্যতার মাপকাঠি। যে নেতা, ব্যক্তি, সমাজ, শাসক, প্রতিষ্ঠান যত বেশি সংযমের পরিচয় বহন করে, সে বা তারা তত সভ্য। কিন্তু দুর্নীতি ও স্তাবকতা সভ্য জগৎকে অন্ধকারে ঢেকে রাখতে সদা-উদ্ধত। এরা যেসব শাসকের আনুগত্য দেখায়, শুধু তাদেরই নয়, পুরো সুরুচি ও সভ্যতাকেই যে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এটাই সবচেয়ে বড় বিপদের বার্তা।
লেখক: ড. মাহফুজ পারভেজ, অধ্যাপক ও বিশ্লেষক।