“তথাগত বুদ্ধের নিবার্ণকালে নৈসর্গিক বিবর্তন কাহিনী যাদের স্মরণে ছিল, তারাও কেবল স্তম্ভিত হয়ে মিলার বিগতপ্রাণ দেহের পানে চেয়ে রইলেন। কারণ মৃত্যুর এমন মনোহর রূপ তারা আর কখনো প্রত্যক্ষ করেননি। এই যদি মৃত্যু হয় তাহলে এমন মৃত্যু কে না প্রার্থনা করে। ১১৩৫ খৃষ্টাব্দে ঠিক চুরাশি বছর বয়সে বুদ্ধের মতো মিলাও লীলা সম্বরণ করলেন। আশ্চর্যের বিষয় মিলার মরদেহ কিছুমাত্র বৈলক্ষণ্য দেখা গেল না। কিন্তু সকলেই লক্ষ্য করলেন যেন দেহটি দিনে দিনে শিশু বালকের দেহের মত ক্ষুদ্রকার ধারণ করছে এবং ক্রমশঃ অধিকতর জ্যোতির্ময় হয়ে উঠছে। সে জ্যোতি চন্দ্রালোকের মতো স্নিগ্ধ। উপস্থিত সকল জনতার মনে হলো যেন বিগতপ্রাণ দেহে পুনরায় প্রাণসঞ্চার হয়েছে। সকলেই উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগলো মিলার কণ্ঠের অশরীরিয় বাণী: ‘আনত্য দেহ সারাজীবন ধরে খুঁজে বেড়ায় ভোগসুখের উপকরণ। সেইজন্যই দেহ অনন্তকালেও তার পরম মুক্তির পথটি সন্ধান করতে পারে না। সকলের চেয়ে বড় অপরাধী এই দেহের ক্ষুধাকে, ভোগসুখের আমন্ত্রণকে তোমরা বর্জন করো।” উপরের লেখাটুকু বিভূপদ কীর্ত্তির ‘মিলারেপা তিব্বতের প্রাণপুরুষ’ বইয়ের। বইটি অনেক আগেই পড়ার সুযোগ হয়েছিল। তখন থেকেই মিলারেপার জীবনদর্শন আমাকে মুগ্ধ করে। আমরা জানি তিব্বত লামাদের দেশ, আধ্যাত্মিকতার দেশ, যাদুবিদ্যার দেশ, চিরতুষারাবৃত হিমালয় আর অরণ্য-বেষ্টিত একটি অজ্ঞাত দেশ। সেখানকার অধিবাসীদের রীতিনীতি আচার-ব্যবহার, ধরন-ধারণ আমরা কিছুই আগে জানতাম না। যে স্থানের উপত্যকাগুলির উচ্চতা সমুদ্রসমতল থেকে প্রায় ১৫ হাজার ফুটের উপরে, তার সম্বন্ধে আমাদের কৌতূহল কম নয়। যার বেশ কিছু কারণ ছিল। যেমন- তিব্বতে যাওয়া সহজ ছিল না। কোনোভাবে সেখানে যাওয়া গেলেও তাদের জীবন-রহস্য সম্পর্কে জানা যেত তেমন নয়। তাই তিব্বত সম্পর্কে মানুষের জানার আগ্রহ বরাবরই একটু বেশি ছিল। মিলারেপা যে সমস্ত স্থানে সাধনারত ছিলেন বা ধ্যান করেছিলেন, তিব্বতী বৌদ্ধধর্মে সেই সমস্ত স্থান তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। এই স্থানগুলি সাধারণত তিব্বত ও নেপাল সীমান্তের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। তেমনি একটি তীর্থস্থান নেপালের গোরখা জেলায় অবস্থিত। ৮ হাজার ১৬৩ মিটার উঁচু পৃথিবীর অষ্টম উচ্চতম পর্বত মানাসলুর পাদদেশে সামাগাঁও ও সামদো গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে অরণ্যে ঘেরা পাহাড়ে এক বড় পাথরের নিচে মিলারেপা গুহা। এখানেও তিনি অধ্যাত্মিক সাধনা করেছিলেন বলে জানা যায়।
লারকে পাস অতিক্রম করে রাতে সামদো গ্রামের এক বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়। এই গ্রামে বেশ কয়েকটি লজ ও হোটেল আছে। তবে মানাসলু সার্কিট ট্রেকিং-এ আসা ট্রেকারদের সংখ্যা বেশি থাকায় কোনো লজ বা হোটেল ফাঁকা ছিল না। সকাল আটটার দিকে সামদো থেকে সামাগাঁও-এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের পথ। এই পথে আমার আগেও হাঁটার অভিজ্ঞতা আছে। তাই পথ বেশ পরিচিত বলে একটু দ্রুতই সামাগাঁও পৌঁছে গেলাম। এই গ্রামটি আগের থেকে বেশ বড় হয়েছে ও অনেক হোটেল ও লজ হয়েছে।
হোটেল নুব্রি ভ্যালীতে থাকার ব্যবস্থা হলো। এখানে দুপুরের খাবারের সময় হোটেলের মালকিনের সাথে গল্প হচ্ছিল। তখনই তার কাছ থেকে মিলরেপা গুহা ও মিলারেপার সম্পর্কে জানতে পারি। আগে বইতে পড়েছি মিলারেপা সম্পর্কে। তাই গুহাটি দেখার লোভ সামলাতে পাড়লাম না। আমার সঙ্গে থাকা গাইড তাশি গ্যালজেনকে বললাম, খাবার শেষেই চলো সেখানে যাই। যেমন কথা তেমই কাজ। খাবার শেষ করে আর দেরি করলাম না। মিলারেপা গুহা দেখার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। যে পথে সামদো থেকে সামাগাঁও এসেছিলাম সেই পথেই হাঁটছি। এদিকে সূর্য পশ্চিম আকাশে দ্রুত হেলে পড়ছে। মানাসলু পর্বত শিখরটি মেঘের ভিতরে লুকিয়ে আছে। এখন আর দেখা যাচ্ছে না। বাতাসের গতিও বেড়ে যাচ্ছে। প্রায় চল্লিশ মিনিট লেগে গেল ১২ হাজার ১১০ ফুট উচ্চতার বরফ গলা স্বচ্ছ পানির লেক বিরেন্দ্রা তালে। মানাসলু হিমবাহের বরফ গলা পানিতে পূর্ণ থাকে অপরূ সৌন্দর্য্যের এই লেক। লেকের পাড় ধরে সোজা উঠে যেতে হয় মানাসলু বেসক্যাম্পে। আর হাতের ডানে চলে গেছে মিলারেপা গুহার পথ। খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে হচ্ছে। ঘন কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে। ধীরে ধীরে আমরা উপরে উঠে যাচ্ছি। উপর থেকে পান্নাসবুজ লেকে পানি দেখে আর মেঘের ভিতরে ঢুকে থাকা মানাসলুর গা ছুঁয়ে শীতল হাওয়া আমাদের ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছিল। চড়াই আর পথের দৈর্ঘ যেন শেষ হতেই চাচ্ছে না। সবুজ পাতার ঝোপ ঠেলে এগিয়ে চলছি। হঠাৎ হঠাৎ ঝোপের ভিতর থেকে পাখির ঝাঁক ফুরুৎ করে উড়ে যাচ্ছে। প্রায় ঘণ্টাদুয়েক সময় লেগে গেল আমাদের মিলারেপা গুহায় পৌঁছাতে। বিশাল বড় এক পাথর যেন লম্বা হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। পাঁচ রঙের প্রেয়ার ফ্ল্যাগ বাতাসে পৎপৎ করে উড়ছে। মানুষজন নেই এখানে। আগে এখানে গুহা ছিল। এখন সেই গুহাকে পাথর বসিয়ে বসিয়ে দেয়াল করে একটি ঘরের মতো করে মোনাস্ট্রি বানানো হয়েছে। বন্ধ কাঠের দরজা আমি খুললাম। ভিতরে দরজার সামনেই ষোলটি প্রদীপ জ্বলছে।
বুট খুলে আমি ভিতরে ঢুকলাম। তাশি আমার পিছনে পিছনে ভিতরে ঢুকলো। চারপাশের দেয়ালে বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বাসের চিত্রকর্ম। ডান পাশে লামা বসার আসন। সেই আসনে বসে লামা পার্থনা করেন। দড়িতে ঝুলছে একটি ড্রাম। যেটা পার্থনার সময় ঢং ঢং করে বাজানো হয়। ভিতরে এগারোটি মূর্তি। সবার মাঝখানে বৌদ্ধের মূর্তি। সাতটি মূর্তি সোনালি রঙের, দুটি কালো রঙের এবং দুটি সাদা। সর্ববামের সাদা রঙের মূর্তিটিই মিলারেপার। বৌদ্ধের মূর্তির সামনে বিভিন্ন ধরনের খাবার ছোট ছোট বাটিতে রাখা আছে। প্রার্থনার বিভিন্ন জিনিসপত্রে সাজানো আছে ভিতরে। তাশি তার ধর্মীয় নিয়ম মতো পার্থনাও করে নিলো।
আমি দরজার চৌকাঠে বসে নীরবে তাশির প্রার্থনা দেখছি আর মিলারেপার দর্শন নিয়ে ভাবছি। বই থেকেই তার সম্পর্কে জেনেছিলাম। আর এখন তার সেই স্মৃতিময় গুহায় বসে আছি। মনে হচ্ছে মিলারেপা চোখের সামনেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। মিলারেপা তিব্বতের বিখ্যাত আধ্যাত্মিক বৌদ্ধ ধর্মের গুরু। বাংলার সাথে সম্পর্কও ছিল সেটা ঐতিহাসিকভাবে অস্বীকার করার উপায় নেই। মিলারেপার গুরু মার্পার অন্যতম শিক্ষাদাতা ছিলেন বাঙালি অতীশ দীপঙ্কর। অতীশ দীপঙ্করে সাথে মিলারেপার কখনো সাক্ষাৎ ঘটেনি। তবে অতীশ দীপঙ্করের শিক্ষার প্রভাব তার মধ্যে সুস্পষ্ট। মিলারেপা শৈশবে যখন অলৌকিক জীবনের নিরুদ্দেশে দীর্ঘ পরিক্রমা শুরু করেন সেসময় বাংলাদেশের তন্ত্রশাস্ত্র শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ ছিল না। বহু শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে আসমুদ্র হিমাচল প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। আর সেই তন্ত্রশাস্ত্র মিলারেপা অর্জন করেন ঐকান্তিক সরলতায়। মিলারেপার মৃত্যু নিয়েও অনেক কিংবদন্তি রয়েছে। মিলার মৃত্যুর পর তার দেহ বিশাল কাঠের স্তূপের উপর শায়িত করে তাতে অগ্নিসংযোগ করা হলো। তখন উপস্থিত সকলেই অলৌকিক কিছু দেখতে লাগলো। সারা রাত চিতা জ্বললো। সকালে দেখা গেল চিতাস্থলে ছাই নেই। এমনকি কোনো চিহ্নমাত্র নেই। মিলা মৃত্যুর পূর্বে যে স্বর্ণভা-ারের কথা বলে গিয়েছিলেন, তা তার শিষ্যরা খুঁজে বের করলেন। ছোট একটি কাপড়ে মোড়ানো ছুরি আর একটি ছোট শর্করা। সঙ্গে একটি মিলার হাতে লেখা চিঠিও পাওয়া গেল। তাতে লেখা: ‘এইটা তোমাদের জন্য আমার শেষ দান। এগুলো দৈবপ্রদত্ত যা অক্ষয়। আমার সমগ্র জীবনের সাধনা আমি সমগ্র মানবতার জন্য দিয়ে গেলাম। যে যেখানে তৃষিত, যে যেখানে জিজ্ঞাসু, যে যেখানে সত্যার্থী, আর্ত, পীড়িত, উত্তরাধিকার সূত্রে আমি তারই।’- রাইজিংবিডি.কম