শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৮ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
খেলাধুলার মাধ্যমে মাদককে সমাজ থেকে বিতাড়িত করতে হবে-মাফরুজা সুলতানা মাইলস্টোন কলেজে নবম শ্রেণির বালিকাদের অংশগ্রহণে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত বিদেশি প্রভুদের নিয়ে বিতাড়িত স্বৈরাচার ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে: তারেক রহমান সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সুপারিশ  ‘বিবেচনায় রয়েছে’: বদিউল আলম ১৬ বছর বঞ্চিতদের এবার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বইমেলয় স্টল বরাদ্দের দাবি ইসির অগাধ ক্ষমতা থাকলেও প্রয়োগে সমস্যা ছিল: বদিউল আলম আমাদের শিক্ষা কর্মসংস্থান খোঁজার মানুষ তৈরি করছে, যা ত্রুটিপূর্ণ: প্রধান উপদেষ্টা সেন্টমার্টিন: ‘স্থানীয়দের জীবিকা বনাম পরিবেশ রক্ষা’ আ. লীগ-জাপা নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাবিতে কফিন মিছিল ১৫ বছরের জঞ্জাল সাফ করতে সময় লাগবে: মির্জা ফখরুল

শাহ সুলতান রুমী (র.) ও নেত্রকোনায় ইসলামের প্রভাব

আলী আহাম্মদ খান আইয়োব
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০২৩

প্রাচীন কোচ রাজার ঐতিহ্যম-িত নদীঘেরা ছায়াঢাকা, সুশীতল মদন কোচ শাসিত অঞ্চলে ১০৫৩ সালের কিছু আগে ইসলামের ঝা-া হাতে সুফি সাধক হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.)-এর আগমন ঘটে।
পশ্চিম এশিয়ার সেলজুক রাজবংশের তুরস্ক সুলতানের সহোদর হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.) জাতিতে ছিলেন তুর্কি। উল্লেখ্য যে রোম (ইতালি) সাম্রাজ্য বিজয়ী তুরস্ক রাজ্যকেই অন্য নামে রোম সাম্রাজ্য বলা হতো এবং শাসকদের বলা হতো রুমি। সুলতানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা হিসেবে তাকেও শাহ সুলতান উপাধিতে অভিহিত করা হয়। হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.) ১২০ জন সুফি সাধকের সংঘবদ্ধ দল নিয়ে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল চট্টগ্রামে প্রথম পদার্পণ করেন। সেখান থেকে ১২০ জনের ওই আউলিয়ার দলটি ধর্ম প্রচারের জন্য বেশ কয়টি ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি দল পা-ুয়ার রাজধানী মহাস্থানগড় (বগুড়া) অভিমুখে রওনা হন এবং সেখানকার প্রভাবশালী রাজা পরশুরামকে ইসলামের দাওয়াত দেন। সে দাওয়াত পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে পরশুরাম সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়। অতর্কিত এ যুদ্ধে ১২০ জনের দাওয়াতি দলের সেনাপতি হযরত শাহ সুলতান সৈয়দ মাহমুদ মাহিসোয়ারসহ শাহ কাবিল গাজী, হটিয়া গাজী, শাহ এরফান গাজী, শাহ মাসউদ গাজী, শাহ মিঞা গাজী, শাহ ফাররুখ এই সাতজন বীর আউলিয়া শহীদ হন। এই সেনাপতি হযরত শাহ সুলতান সৈয়দ মাহমুদ মাহিসোয়ারেরই সমাধি বগুড়ার মহাস্থানের হযরত শাহ সুলতানের মাজার নামে পরিচিত।
হযরত শাহ সুলতান সৈয়দ মাহমুদ মাহিসোয়ারের শহীদ হওয়ার সংবাদ পেয়ে হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী অন্যত্র ইসলামের প্রচারকাজ সাময়িক স্থগিত ঘোষণা করে তার বাহিনী অর্থাৎ কায়কাউস নামে আউলিয়া দল নিয়ে মহাস্থানে গমন করেন। তিনি সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে পরশুরামকে প্রস্তাব পাঠান যে মিথ্যা পৌত্তলিকতাবাদকে ছেড়ে কুসংস্কারের অন্ধকার ভেদ করে আল্লাহর একত্ববাদ ও তার প্রেরিত পুরুষ হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে মেনে নিতে। এতে বিজয় উল্লাসে থাকা রাজা পরশুরাম ক্ষেপে গিয়ে প্রেরিত দূত হযরত তাপস মল্লিককে বন্দি করে ফেলে। অনন্যোপায় হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (রা.) রণপ্রস্তুতি নিতে বাধ্য হয়ে রাজা পরশুরামকে আক্রমণ করে তাকে পরাজিত ও নিহত করে সব বরেন্দ্রভূমি দখল করেন। এরই মধ্যে জয় করা এলাকাগুলোর বেশির ভাগ লোক দলে দলে ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে।
পরশুরামকে হত্যার ফলে বরেন্দ্রভূমি হাতে এলে সেখান থেকে যুমনা নদী পাড়ি দিয়ে বরেন্দ্র এলাকার পুব দিকে সুশিক্ষিত কায়কাউস নামক বাহিনী নিয়ে রওনা হন এবং জামালপুরের (বর্তমান) দুর্মুট নামক জায়গায় আস্তানা স্থাপন করেন। সেখানে ধর্মীয় প্রচারাভিযান নির্বিঘেœ চালনা শেষে সেখান থেকেই ১৩ (তেরো) জন আউলিয়ার একটি বাহিনী আবার বরেন্দ্রভূমির মহাস্থানের দিকে পাঠান।
হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.) দুই আউলিয়ার ওপর দুর্মুটের দায়িত্ব দিয়ে তার শিক্ষাগুরু সৈয়দ মহীউদ্দিন সুর্খুল আম্বিয়া সুরতনী (র.)সহ ৪০ জনের কায়কাউস বাহিনী নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের পুবপাশে কামরূপ এলাকার ছোট ছোট পৌত্তলিক ধর্মাশ্রয়ী সামন্ত রাজাদের এলাকা জয় ও ইসলামের প্রচারকাজ সিদ্ধির জন্য এগিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরের বালুর চরে এসে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন। বোকাই নগর থেকে কায়কাউস বাহিনী মদন কোচের রাজ্যাভিমুখে যাত্রা করেন; মদন কোচ আগে থেকেই এ কায়কাউস বাহিনীর যুদ্ধ কাহিনী ও রাজা পরশুরামের পরাজয়ের কথা জানতে পায়। যখন শুনতে পায় ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমাংশ থেকে কায়কাউস বাহিনী বিভক্ত হয়ে মাত্র কয়েকজনের এক বাহিনী আসছে, তখন মদনকোচ অনেকটা আশ্বস্ত হয়। সে খতিয়ে দেখেনি যে কায়কাউস বাহিনীর রণদক্ষ ব্যক্তিরাই এ ফকির বেশে আসছে।
হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.) রাজা মদনকোচের রাজদরবারে না গিয়ে দামছাপুর (নন্দিপুর) গ্রামে প্রথম আস্তানা গড়েন। কিছুদিন অবস্থানের পর কাংসার ঘাট (সৈয়দ ফজল) নামক স্থানে আস্তানা স্থাপন করেন। শেষে এ কোচ রাজ্যের রাজধানীর পশ্চিমে ঝিটাই নদীর দক্ষিণ তীরে বিনাবাধায় প্রবেশ করে নামাজ আদায় করেন ও ধ্যানমগ্ন শেষে বলেন যে, ‘এখানেই আমার হয়তো শেষ পর্যায়। অর্থাৎ মদনকোচের রাজ্যের অভিযানই শেষ অভিযান।’ যে জায়গায় হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.) নামাজ আদায় করেছিলেন, সে জায়গা কোনো শর্ত ছাড়া তাদের দান করার প্রস্তাব দিয়ে অনুগত রূপস মল্লিককে মদনকোচের রাজদরবারে দূত হিসেবে পাঠান।
রাজদরবারে প্রস্তাবটি তুললে প্রথমবারে তার বোন নন্দিনী মানব বলিদানের ভয় দেখিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। দ্বিতীয়বার যখন একটি জায়নামাজের সমপরিমাণ স্থানের আবেদন করা হয়, তখন তুচ্ছজ্ঞানে মঞ্জুর করেন। তার পরই মদনকোচের মনে সন্দেহ দেখা দেয়। সে চিন্তা করল বিদেশীরা নিশ্চয় গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছে। সে মুহূর্তেই সৈন্যবাহিনী নিয়ে হাজির হলো দান করা জায়গায়।
তখন হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.) আসরের নামাজ আদায় করছিলেন। নামাজ শেষ হলে মদনকোচ তার সৈন্যদলের সদস্যদের জায়নামাজের নিচের স্থান খনন করার আদেশ দিলেন, কিন্তু কোনো ধনের খোঁজ পাওয়া গেল না। হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.) মদন কোচের মনের সন্দেহ বুঝতে পেরে তার তা অবসানের চেষ্টা করেন। তখনই জায়নামাজটি শূন্যে ছুড়ে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে জায়নামাজটি শূন্যে বিদ্যুৎ বেগে সম্প্রসারিত হতে থাকে এবং অগ্নির লেলিহান শিখার মতো বা হাজার হাজার ফণাধারী সাপের মতো অব্যক্ত শো শো শব্দে মদনকোচের রাজ্য আচ্ছাদিত হয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। ভীতসন্ত্রস্ত মদনকোচ উপায় জ্ঞানশূন্য হয়ে বাঁচার আকুতি জানায়। তখন হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.)-এর প্রস্তাব ছিল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ, বশ্যতা স্বীকার অথবা যুদ্ধ, এর যেকোনো একটি বেছে নেয়ার জন্য। মদনকোচ ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কথাই স্বীকার করে। আগামী দিন তার ধর্মান্তরিত অনুষ্ঠানে ও ভোজসভায় যোগদানের প্রস্তাব দিলেন এবং সেখানেই সপরিবারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের অঙ্গীকার করেন। হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.) প্রস্তাব মেনে নেন। আগামীকাল তার প্রাসাদে যাবেন ও ধর্মান্তরিত অনুষ্ঠান ও ভোজসভায় যোগ দেবেন। প্রস্তাবমাফিক জায়নামাজ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন। পরদিন দল নিয়ে তিনি রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হলেন, ধর্মান্তরিত অনুষ্ঠানের আগেই ভোজনপর্ব, তাই সন্দেহের উদ্রেক হলো। ধ্যানমগ্ন হয়ে আউলিয়া হযরত শাহ সুলতান (র.) চিৎকার দিয়ে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলে উঠলেন, এ রাজভোগে বিষ দেয়া আছে। সুতরাং কেউ খাবে না। মদনকোচ নিজেকে সামলিয়ে রাজভোগে দেয়া চৌদ্দতোলা পরিমাণ বিষ থাকা সত্ত্বেও অস্বীকার করে এবং হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.)-কে ওয়াদা ভঙ্গকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে। শাহ সুলতান রুমী (র.)-এর মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো, তিনি কখনো খেতে ওয়াদা করেননি। তখনো সত্য চাপা দিয়ে মিথ্যার আশ্রয়ে নিজেকে সঠিক বলে মদনকোচ দৃঢ় থাকল।
তখন শুধু শাহ সুলতান রুমী (র.) নিজেই খাবার খাবেন কিন্তু সহযোগী কেউ খাবে না ঠিক হলো। সৈয়দ মহীউদ্দিন সুর্খল আম্বিয়া সুরতনী (র.)-কে একটি আশা দিয়ে আধ্যাত্মিকতার পানি উত্তোলন করে জ্ঞানহীন তার দেহে ছিটিয়ে দেয়ার কথা বলেন। খাবার খাওয়ার পর জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লে কথামতো সৈয়দ মহীউদ্দিন সুর্খুল (র.) সব কাজ শেষ করলে, তিনি জ্ঞান ফিরে পান। তখনই হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.)-এর পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করে মদনকোচ সপরিবার ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে গেলেন। মদনকোচকে নীরবে এ পরাজয় বরণ করে নিতে হলো আর আউলিয়া দলের স্থান হলো রাজদরবারের রাজা ও সভাসদদের ওপরে। কিছুদিন পর মদনকোচ সপরিবারে নৌকায় করে গারো পাহাড়ের দিকে নিজ পরিচয় গোপন রেখে রওনা দিলে পথে মারা যান তার পরিবারসহ। আজ পর্যন্ত মদনকোচের নাম পৃথিবী থেকে বিলীন হয়নি। তারই নামানুসারে মদনপুর, তার তিন বোন নন্দিনী, মঙ্গলী, চন্দিনীর নামানুসারে নন্দিপুর, মনাঙ্গ ও চন্দনকান্দি, তার স্ত্রী কংশীদেবীর নামানুসারে কংশা ও আত্মীয় রামচন্দ্র কোচ ও নরেন্দ্র কোচের নামানুসারে রামচন্দ্রপুর ও নরেন্দ্রনগর নামের গ্রামগুলো তাদের স্মৃতি বহন করছে।
১০৮৫ হিজরি বা ১৬৭১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহানের পুত্র বাংলার সুবাদার শাহ সুজা হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.) মাজারের অনুকূলে যে সনদ প্রদান করেছিলেন তার ফার্সি ভাষা থেকে বঙ্গানুবাদ এমনÍ‘শাহ সুলতান রুমী এবং শাহ সৈয়দ সুর্খুল ও চল্লিশ আউলিয়া পরগনা ময়মনসিংহ, জায়গিরদার সৈয়দ জালালউদ্দিন মোহাম্মদ ও বিচার বিভাগের শাসনকর্তা দস্তগাহ কাজী লুৎফুল্লাহ এবং উক্ত পরগনার হুকুমত পানাহা মোহাম্মদ আলী বেগ প্রমুখ সবার মোহরযুক্ত মতে ও অন্য কর্মচারীদের দস্তখতসহ অদ্য তারিখ ১৬৬৫ সাল (মতান্তরে ১৬৭১) মোতাবেক ১০৮৫ হিজরি সালে জিলক্বদ মাসে অত্র হুকুমত নামা দ্বারা স্বীকার করা হল যে পরগনা ময়মনসিংহের বাজু হাই সরকার জায়গিরদার ছিয়াছত এবং নেজারত পানাহা সৈয়দ জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ কর্তৃক লাখেরাজ প্রদত্ত সোনারগাঁও সরকারের অধীন মদনপুর মৌজায় হযরত শাহ সুলতান সাহেব ৪৪৫ হিজরিতে ৪০ জন দানেশ মান্দ মারেফাত তত্ত্বজ্ঞানীসহ আগমন করেন। এ সময় মদনা নামে রাজা ওই স্থানে রাজত্ব করতেন। উক্ত রাজা মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং অন্য পৌত্তলিক কাফেররা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। উক্ত হযরত শাহ সুলতান মদনপুর মৌজায় সঙ্গীরাসহ অবস্থান করেন এবং জামেউল উলুম পরিচালনা করেন। এ মৌজায় সব আউলিয়ার মাজার অবস্থিত। এ মৌজার দরগা শরিফে খাদেমরা বাস করতেন। এ মৌজা সর্বপ্রকার জমা অর্থাৎ খাজনা হতে বহির্ভূত।’ হযরত শাহ সুলতানের মাজারের অবস্থান নিয়ে জনমনে আজও যে মতানৈক্য রয়েছে, ওই দলিল প্রমাণ করে যে হযরত শাহ সুলতান রুমী (র.)-এর মাজার নেত্রকোনার মদনপুরে, তা সুবাদার সুজার সময়েই স্বীকৃত ছিল। অন্যথায় এত বড় একটি দলিল কীভাবে এ এবারতে সম্পাদিত হয়। এছাড়া অনেক ঐতিহাসিক মতান্তর দেখি যে শাহ সুলতানের মাজার বগুড়া শহরের অদূরে মহাস্থানগড়ের ছোট পাহাড়ে। এ মতবাদেরও যথেষ্ট যুক্তি বা সুপ্রশস্ত ফাঁক রয়েছে। সম্রাট শাহজাহানের অন্য পুত্র সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৫৮ সালে যে দলিল বগুড়ার মহাস্থানের শাহ সুলতান নামক আউলিয়া পরিচিত ব্যক্তির মাজারের ওপর সম্পাদন করেছেন, তাতেও তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, মীর সৈয়দ সুলতান মাহমুদ মাহিসোয়ারের নাম এবং শাহ সুজা মদনপুরের দলিলে উল্লেখ করেন, শাহ সুলতান রুমী এবং সৈয়দ সুর্খুল ও ৪০ আউলিয়া; সুতরাং দুই ব্যক্তি যে ভিন্ন তার প্রমাণ ওই দলিলগুলোয়ই পাওয়া যায়। তাই শাহ সুলতান যে প্রকৃতই শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.) নেত্রকোনার মদনপুরে সমাহিত এবং মীর সৈয়দ সুলতান মাহমুদ মাহিসোয়ার প্রকৃতই বগুড়ার মহাস্থান গড়ের পাশে সমাহিত, এতেও কোনো ভিন্ন যুক্তি নেই। শুধু শাহ সুলতান বলে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়, তা বিষয়টির প্রতি অজ্ঞতার কারণেই।
তেমনি ঐতিহাসিক সাল নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিকরাও ভিন্নমত পোষণ করেছেন। ১৩০৩ সালে তরপ বিজয়ী সৈয়দ নাসির উদ্দিন সিপাহসালার সঙ্গে ১২ জন আউলিয়া তরপে এসেছিলেন, তার মধ্যে হযরত শাহ সুলতান একজন বলে সৈয়দ হাসান ইমাম হোসেনী চিশতি সাহেব তার তরপের ইতিহাস নামক পুস্তকে (পৃষ্ঠা-২৪) উল্লেখ করেন। গোলাম সাকলায়েনের লেখা বাংলাদেশের সুফি সাধক নামক পুস্তকে (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৮২ নভেম্বর) তিনি জনশ্রুতির উদ্ধৃতি দিয়ে বগুড়ার শাহ সুলতান সম্পর্কে লিখেছেন আজগর নামক বলখের জনৈক শাসকের সন্তান ছিলেন শাহ সুলতান। অন্যদিকে নূরুল হোসেন খন্দকার তার শাহ সুলতান রুমী (র.) নামক গ্রন্থে (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৭ জুন) তিনি উল্লেখ করেন যে হযরত সৈয়দ শাহ সুলতান মাহমুদ মাহিসোয়ার সৈয়দ শাহ সুর্খুল আম্বিয়ার পুত্র।
মহাস্থানগড়ের ইতিহাস ও সুলতানের জীবনী নামক বইয়ে ৪৩৯ হিজরি ১০৪৩ খ্রি. শাহ সুলতান সৈয়দ মাহমুদ মাহিসোয়ার কর্তৃক রাজা নরসিংহ পরশুরামের পরাজয়ের কথা উল্লেখ করা হয়।
হযরত শাহ কামাল ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে ইয়েমেন থেকে প্রথম পাকভারতে আগমন করেন ও মোগল সম্রাট আকবরের সময় শাহ জামাল বর্তমান জামালপুর নামক স্থানে আসেন বলে বাংলাদেশের সুফি সাধক গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায়। এভাবে নাগবংশের ইতিবৃত্ত নামক পুস্তকেও লেখক জামালপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট গজ. উঙঘঙটএঐ-এর লেখা একটি বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেন বাংলা ৯১০ সাল, ইংরেজি ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে শাহ কামাল মুলতান থেকে বাংলায় এসেছিলেন। কিন্তু শাহ সুলতান রুমী (র.) নামক পুস্তকে শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী, সৈয়দ শাহ সুলতান মাহমুদ মাহিসোয়ার, হযরত শাহ কামাল, হযরত শাহ জামালসহ মোট ১২০ জনের এক সুফি সাধকের দল বাংলায় একই সঙ্গে আগমনের নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন লেখক।
ঐতিহাসিক মতান্তরে সাধারণ পাঠকসমাজ বিভ্রান্তিতে পড়ে বিষয়টির প্রতি উদাসীন মনোভাব পোষণ করেন। তবে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় যে হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.) ৪৪৫ হিজরিতে মদনপুরে আগমন অথবা পরলোকগমন করেন। কেননা কোনো ব্যক্তির সমাধির পাশে কোনো সন তারিখ লেখা থাকলে সেটিকে তার জন্ম অথবা মৃত্যু তারিখ হিসেবে বোঝা যায়। কোনো অবস্থায়ই তার আগমনের সন তারিখ বোঝায় না। জন্ম সন বলে বলতে হয় যেহেতু তার জন্ম এ অঞ্চলে নয় সুতরাং তার মৃত্যুর পর জন্ম তারিখ সংগ্রহ কঠিন ব্যাপার। তাই সহজেই বোঝা যায়, এটি তার মৃত্যুর সন। আগমন ও পরলোক গমনের সনটি নিয়ে ঐতিহাসিক মতান্তর থাকলেও শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.)-এর আগমনে নেত্রকোনা তথা পূর্ব ময়মনসিংহে প্রথম যে ইসলামের প্রভাব ও প্রসার সৃষ্টি হয়, তাতে কোনো ঐতিহাসিক মতভেদ নেই।
হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.)-এর আগমনে এতদঞ্চলে প্রথম ইসলাম ধর্মের প্রচারকাজ শুরু হয়। এরপর চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুতে শামছুদ্দিন ফিরুজ শাহর সময়ে এ অঞ্চল মুসলিম শাসনাধীনে আসে। তার মৃতুর পর তারই পুত্র গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহর শাসন ছিল। তাকে যুদ্ধে পরাজিত করে বাহরাম শাহ দিল্লির প্রতিনিধি হিসেবে ময়মনসিংহসহ এ অঞ্চল শাসন করেন। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ফকর উদ্দিন মোবারক শাহ এবং ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহ এ অঞ্চলের শাসনকাজ পরিচালনা করেন। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন ইলিয়াস শাহি বংশের সুলতানরা এ অঞ্চলের অধিকর্তা ছিলেন। ১৪৯৩ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হোসেন শাহি বংশের সুলতানেরা তাদের শাসন অক্ষুণ্ন রাখেন।
ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পূর্ব ময়মনসিংহে সুলায়মান খাঁ স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বারোভুঁইয়ার অন্যতম নায়ক ঈশা খাঁ ও তার পারিষদরা এ অঞ্চলে ইসলামী কায়দায় শাসনকাজ পরিচালনা করেন। ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে পুরো ময়মনসিংহ জেলা কার্যকরভাবে মোগলদের শাসনে আসে। সুলতানদের আমলে শুধু সুসং দুর্গাপুরের অদূরের মসজিদটিই নয়, মোহনগঞ্জের শেখের বাড়ির মসজিদটিও সুলতানদের ধর্মীয় অনুপ্রেরণার স্বাক্ষর। হোসেন শাহর প্রতিনিধি খোয়াজ খাঁ পূর্ব ময়মনসিংহ অর্থাৎ তৎকালীন মোয়াজ্জমাবাদে যে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটি তা উদ্ধার করে ইতিহাসের একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছে। উদ্ধার করা শিলালিপির বঙ্গানুবাদ এরূপ, ‘মসজিদটি ত্রিপুরার গভর্নর মোয়াজ্জামাবাদ জেলার ওয়াজির এবং আলাউদ্দুনিয়া ওয়াদ্দীন আব্দুল মুজাফফর হোসেন শাহ, বিধাতা তার রাজ্য ও রাজত্বকে চিরস্থায়ী করুক, অবস্থা ও মর্যাদা বর্ধিত হউক, তার প্রতিটি মুহূর্ত বিজয়ী হউক এবং রাজ্যের উত্তরাধিকারী এ যুগের মহান ও মহৎ সুলতান খোয়াজ খাঁ কর্তৃক নির্মিত হয়। বিধাতা তাকে দুজাহানে বাঁচিয়ে রাখুন। তারিখ ২রা রবি ১১, ৯১৯ ( ৭ই জুন, ১৫১৩)।’
উদ্ধারিত শিলালিপিযুক্ত মসজিদটির কোনো সন্ধান না পাওয়া গেলেও ঐতিহাসিকদের ধারণা কেন্দুয়ার রোয়াইল বাড়ির মাটি খুঁড়ে যে মসজিদটি আবিষ্কার হয়েছে, সেটি অথবা একই থানার মোজাফফরপুর গ্রামের মাটিচাপা মসজিদখানাই খোয়াজ খাঁ কর্তৃক নির্মিত মসজিদ হতে পারে। কিন্তু ওই দুটি মসজিদের ব্যবহূত কিছু ইট ও কারুকাজ দেখে মনে হয় যে মোগল স্থাপত্যশিল্পীদের হস্ত সঞ্চারণে এ দুটি মসজিদ সংস্কার হয়েছিল। এ মসজিদগুলো প্রমাণ জোগায় যে তৎকালে মুসলিম শাসকদের শুধু শাসনই নয়, এরা এ অঞ্চলবাসীদের ইসলামের মর্মবাণীসহ মুসলিম ধর্মীয় আচারে আকৃষ্ট করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল।
১৯০১ সালে আবু এ গজনবী কর্তৃক প্রণীত রিপোর্টে ময়মনসিংহের মুসলমানদের বংশ, রক্ত, কুলগত নির্ঘণ্ট কষে উল্লেখ করেন মোটামুটি ২০ শতাংশ বিদেশী বংশোদ্ভূত, ৫০ শতাংশ মিশ্র রক্তজাত এবং বাকি ৩০ শতাংশ ধর্মান্তরিত মুসলমান। সুতরাং পির, আউলিয়া ও শাসকদের বংশোদ্ভূত ২০ শতাংশ, তাদের বংশধর কর্তৃক মিশ্রিত ৫০ শতাংশ মোট ৭০ শতাংশ বিদেশী ও দেশীয়দের সমন্বয়ে, বাকি ইন্দোমঙ্গোলিয়ান ও অন্যান্য জাত কুল থেকে ৩০ শতাংশ মুসলমানদের বংশধর এ অঞ্চলে একসময়কার সংখ্যালঘিষ্ঠতা থেকে বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠতায় উঠেছে। লেখক: আলী আহাম্মদ খান আইয়োব: নেত্রকোনা জেলার ইতিহাস গ্রন্থের প্রণেতা




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com