একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। এই সত্য স্বীকার করার পরও বন্ধ হচ্ছে না অসতর্কতা ও অবহেলাজনিত সড়ক দুর্ঘটনা। গত সোমবার ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডে নাদিয়া নামে নর্দান ইউনিভার্সিটির এক ছাত্রী বাসচাপায় নিহত হয়েছে। সে ফার্মাসিতে পড়তো। মর্মান্তিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার ফার্মাসিস্ট হওয়ার স্বপ্নও হারিয়ে গেছে। এক সপ্তাহ আগে রাজধানীর বনশ্রীর ফারাজি হাসপাতালের সামনে আশিকুর রহমান নামের আরেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয় অটোর ধাক্কায়। নাদিয়া ও আশিক দু’জনই মোটরসাইকেলের আরোহী ছিল। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৭৭১৩ জন, যাদের ৮০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে। তারা প্রায় সবাই ছিল রোজগারে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের দেয়া তথ্যে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী ১২৩৭ জন, যাদের অধিকাংশ নিহত হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। শিক্ষার্থী, শিশু-কিশোর ও তরুণদের সবার জীবনেই থাকে পৃথক পৃথক স্বপ্ন। তাদের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে তাদের সপ্নেরও মৃত্যু ঘটে। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় কত মানুষ ও তাদের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটছে, তার সঠিক হিসাব মেলে না। যা থানায় লিপিবদ্ধ হয় কিংবা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তাই কেবল মানুষ জানতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতি অপরিসীম। যারা নিহত কিংবা আহত হয়, তাদের যে ক্ষতি হয় তা অপূরণীয়। হতাহতের বেশিরভাগের পরিবার অসহায় ও বিপন্ন হয়ে পড়ে। তাদের খোঁজ অবশ্য কেউ রাখে না। উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থাও নেই। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের মতে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২৩৪৬০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি। অত্যন্ত উদ্বেগজনক হলেও বলতে হচ্ছে, রাজধানীসহ দেশের সব জায়গার সড়ক-মহাসড়ক কার্যত মৃতুফাঁদে পরিণত হয়েছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ২০১৮ সালে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের দেশ কাঁপানো আন্দোলন হয়েছিল। আন্দোলনের চাপে সরকার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়েছিল নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে। সে প্রতিশ্রুতি আজো পূরণ হয়নি। গত বছর রাজধানীর সড়কে ২৫৯টি দুর্ঘটনায় ২৪৬ জন নিহত হয়েছে।
এমন কোনো দিন নেই, যেদিন সড়কে তরতাজা প্রাণ না ঝরছে। যেদিন রাজধানীতে নাদিয়া নিহত হয়েছে, সেদিন গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ট্রাক চাপায় একজন পোশাক কারখানার কর্মী নিহত হয়েছে। ফরিদপুরের ভাঙ্গায় বাসের ধাক্কায় নিহত হয়েছে শিশুকন্যা ও বাবাসহ মোটরসাইকেলের তিন আরোহী। এছাড়া জামালপুর, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিহত হয়েছে আরো চারজন। চালকের বেপরোয়া যান চালনা দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হলেও মানুষের আচরণও দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। যা দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার একটা বড় কারণ, তরুণ চালকরা কোনো কিছুকে পাত্তা দিচ্ছে না। ফলে যখন-তখন যেখানে-সেখানে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে এলেও তার ইতিবাচক ফল মিলছে না। উল্টো সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছেই। সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেসব বাস্তবায়নে তেমন গরজ দেখা যাচ্ছে না। ফলে এ সরকারের আমলে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। সড়কে নিরাপত্তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ বাড়ছে, যার প্রকাশও মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছে। নাদিয়া নিহত হওয়ার ঘটনায় শিক্ষার্থীরা কাওলা ব্রিজ এলাকায় সড়ক অবরোধ করেছে। তার মৃত্যুকে হত্যাকা- বলে দাবি করেছে এবং চালকের গ্রেফতারের দাবি করেছে। গাজীপুর গার্মেন্ট কারখানার কর্মীর মৃত্যুতে তার বিক্ষুব্ধ সহকর্মীরা মহাসড়ক অবরোধ করে অর্ধশতাধিক যানবাহন ভাঙচুর করেছে। ভাঙ্গার দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির প্রতিবাদে এলাকাবাসী বিক্ষোভ করছে এবং ঘাতক বাসটি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এই তিনটি ঘটনাই তাৎক্ষণিক স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া, যা আইনের সাথে যায় না। আইন হাতে তুলে নেয়ার শামিল বলেই গণ্য হবে এসব ঘটনা। প্রশ্ন হলো, মানুষই বা কী করবে? সড়ক দুর্ঘটনার বিচার নেই, শাস্তি নেই, ক্ষতিপূরণের বালাই নেই। এসব না থাকায় দুর্ঘটনা ও মৃত্যু অপ্রতিরোধ্যে। দুর্ঘটনার নামে এই হত্যাকা- কতদিন চলবে? আর মানুষইবা কতদিন নিরব থাকবে?
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। কীভাবে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত কারো অজানা নেই। অথচ, দুর্ঘটনা না কমে বাড়ছে লাগাতার। সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান হোতা চালকের কোনো শিক্ষা নেই, প্রশিক্ষণ নেই। অধিকাংশের ড্রাভিং বৈধ লাইসেন্স, বৈধ নিয়োগপত্র নেই। ঠিকায় তারা বাস চালায়। টিপ বেশি দিলে বেশি পয়সা লাভ হয়। এজন্যই বেপরোয়া তারা। দ্রুততা ও প্রতিযোগিতা দুর্ঘটনার জন্য বিশেষভাবে দায়ী। চালকদের সতর্কতার যেমন অভাব, তেমনি অভাব পথচারী ও যাত্রীদের। যতদিন উভয় তরফের মধ্যে সচেতনতা না বাড়বে ততদিন দুর্ঘটনা কমার আশা করা যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিআরটিএ ও ট্রাফিক কর্তৃপক্ষ সৎ ও দায়িত্বশীল হলে এ অবস্থা হতে পারতো না। বিআরটিএতে অনিয়ম-দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর ট্রাফিক পুলিশের একশ্রেণির সদস্য সড়কে যানচলাচল নিয়ন্ত্রণ ও মসৃণ করার বদলে তোলাবাজিতে ব্যস্ত থাকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই দুটি কর্তৃপক্ষ ঠিক হলে সড়ক দুর্ঘটনা আপনা-আপনিই কমে আসবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের একথা অজানা থাকার কথা নয়। সেখানেও প্রায় একই অবস্থা। সর্বত্রই দায়িত্বশীলতার অভাব, সুশাসনের অভাব। আমরা আশা করি, সরকার, গাড়ি চালক, মালিক ও সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন। সবাই সচেতন ও সতর্ক হলে তবেই সম্ভব সড়ক দুর্ঘটনার মতো মর্মান্তিক ঘটনার নিয়ন্ত্রণ ও বন্ধ করা।