নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন এমন এক মানসিক বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ করেছেন, যার অভাব রয়েছে অনেকের মধ্যে। তিনি আমাদের নেতৃত্ব দেওয়ার একটি ভিন্ন উপায় দেখিয়ে দিলেন। জীবনের সবচেয়ে কঠিন জিনিসগুলোর মধ্যে একটি হলো কখন থামতে হবে তা জানা। জেসিন্ডা আরডার্ন এক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিলেন। তিনি এই থামতে জানাটাকে প্রায় সহজ করে তুললেন। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এ সপ্তাহে একটি আবেগপ্রবণ অথচ চরিত্রগতভাবে সুমধুর এক বক্তৃতায় তার পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি সরাসরি ঘোষণা করেছেন, সাড়ে পাঁচ বছর ধরে শীর্ষে থাকার পর তার নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যথেষ্ট জীবনীশক্তি আর নেই। তিনি পদত্যাগ করছেন এজন্য নয় যে, কাজটি খুব কঠিন ছিল। বরং তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, নেতৃত্ব প্রদানের বিষয়টি হলোÍআপনার যা কিছু আছে, তা দিয়েই যতদিন সম্ভব নেতৃত্ব প্রদান করা, কিন্তু আপনার সময় শেষ হয়ে এলে তা স্বীকার করে নেওয়া। এজন্যই আরডার্ন একজন বিরলসতম ব্যক্তি। এক শিংওয়ালা অশ্বসদৃশ ও সিংহের লেজযুক্ত এক অভিজাত প্রাণীর মতো। তিনি এমন এক মানসিক বুদ্ধিমত্তার অধিকারী রাজনীতিবিদ, যিনি কারো ধাক্কা দেওয়ার অপেক্ষা না করে নিজেই লাফ দেন।
বিষয়টি গত গ্রীষ্মে ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের ময়লা আঁচড়ানোর সঙ্গে তুলনা করুন। এতে আপনি বৈপরীত্যই লক্ষ করবেন। তিনি তার দাগযুক্ত প্রধানমন্ত্রিত্বকে একগুঁয়েভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন। এমনকি যখন তিনি শেষ পর্যন্ত বিরক্তিকরভাবে পদত্যাগ করলেন, তখনো কেউ কেউ অবাক হয়েছিলেন। তিনি সত্যিই পদত্যাগ করতে চাইছেন তো? আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার ইগো বা অহমিকা সম্পর্কে একবার চিন্তা করুন। জনগণের গণতান্ত্রিক রায় মেনে নিতে তিনি এতটাই অক্ষম ছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত তিনি ক্যাপিটলে হামলা চালাতে তার নেতাকর্মীদের উসকে দিলেন। অবশ্য খুব কম রাজনীতিক বা ব্যাবসায়িক নেতাই এরকম পরিস্থিতিকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যান। কিন্তু জীবনের সব ক্ষেত্রে নম্বর ওয়ান প্রকৃতির মানুষের জন্য এটি সাধারণ ঘটনা বৈকি। তারা ক্ষমতাকে আরো শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেন। যদিও তা পিছলে যাচ্ছে, তার পরও তারা নিজেদের দৃঢ়প্রত্যয়ী করে তোলেন এই ভেবে যে তারা এখনো কোনো না কোনোভাবে পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দিতে পারেন। এতে তারা দ্বিগুণ নিচে নেমে যান, সেখানে আরো খনন করে চলেন এবং অন্য সবাই যা দেখতে পান, তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। তারা বেঁচে থাকার ক্রমবর্ধমান অমার্জিত প্রচেষ্টায় একটি জঘন্য চুক্তি থেকে অন্যটিতে চলে যান। কখনো কখনো তারা এটি নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট দীর্ঘ সময় নিয়ে থাকেন। কিন্তু শেষ মুহূর্ত যখন আসে, তখন তা হয় আরো নৃশংসপূর্ণ। এটি আগামী কয়েক বছরের জন্য তিক্ত দোষারোপের উৎস হয়ে যায়।
একই কথা সেই দম্পতিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যারা একটি মৃত সম্পর্ককে দীর্ঘকাল ধরে আঁকড়ে ধরে থাকেন। যৌক্তিকভাবে এই সম্পর্ক ছেড়ে দেওয়ারই কথা। তারা একে অপরকে এত আবেগের সঙ্গে ঘৃণা করেন যে তারা শেষ পর্যন্ত এমন পরিস্থিতিতে চলে যান, যেখানে একটি সভ্য বিবাহবিচ্ছেদ অসম্ভব হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে, যে কোনো একটি পছন্দের কাজ থেকে একসময় দূরে চলে যাওয়াটাকেও আমি ভালোবাসি। কেননা, সেই সময় এটি আসলে আমার জীবনের সঙ্গে বেমানান বলে মনে হতে পারে। আমার ধারণা, আরডার্ন এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনুশোচনা করবেন না। কখন ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়েছে তা জানার মধ্যে দুর্বলতার পরিবর্তে শক্তি থাকতে পারে। আপনি আরডার্নের রাজনীতির বিশেষ প্রগতিশীল ব্র্যান্ডের বিষয়ে যা-ই ভাবুন না কেন, বিশ্ব যখন এখনো আরো বেশি প্রগতিশীলতা চায়, তখন তার প্রস্থান অনিবার্যভাবে ক্ষমতার পালাবদলের মতো অনুভূত হচ্ছে। তিনি যে পরিস্থিতিতে চলে যাচ্ছেন, তা-ও আমাদের স্বীকার করতে হবে। কারণ এক জরিপে দেখা যায়, গত মাসে তার শাসনামলের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। ২০১৭ সালে নেতা হওয়ার পর এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি তিনি আর কখনো হননি। বিশেষ করে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এটা একটা রেকর্ড। অন্য সবার মতো, নিউজিল্যান্ডবাসী বর্তমানে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে দিন যাপন করছে। জরিপের ফলাফল বলছে, তার দলটিকে এবারের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করতে হলে বেশ বেগ পেতে হবে। করোনা মহামারির মধ্যেও তিনি ভেঙে পড়েননি। এই সময় আরডার্নকে একটি কঠোর শূন্য কোভিড নীতি অনুসরণ করতে হয়। এই সাহসিকতা ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দেশে-বিদেশে তার প্রতি সম্মান জানানো হয়। তার বলিষ্ঠ নীতির কারণেই তার দেশে মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস পায় ঈর্ষণীয়ভাবে। ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় তিনি নতুন পৃথিবীর এই একবিংশ শতকের যথার্থ ভূমিকা পালন করেছিলেন দ্ব্যর্থহীনভাবে। এবং কোভিড ঝড়ের মুখোমুখি হওয়ার সময় নিউজিল্যান্ডবাসীকে ‘শক্তিশালী ও সদয় হতে’ আবেদন জানিয়েছিলেন। তিনি একজন নরম ও সহানুভূতিশীল আদর্শের বাহক হয়ে মডেল নেতৃত্বের অধিকারী হয়ে ওঠেন। বিশ্ব জুড়ে প্রগতিশীলরাও তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কেননা, যে কোনো মূল্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেয়ে তিনি মানুষের উন্নতমানের জীবনযাপন ও সুখের সাধনাকে প্রাধান্য দিয়ে অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করেন।
কিন্তু অন্যান্য দেশ কোভিড-পরবর্তী সময়ে অচলায়তনের দ্বার খুলতে শুরু করলেও নিউজিল্যান্ড আরো সতর্কতাস্বরূপ তা করেনি। এতে দেশটির জনগণ ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ক্রমবর্ধমান অপরাধ, ক্রমাগত আবাসনসংকট এবং একের পর এক ক্ষুব্ধ অ্যান্টি-ভ্যাক্সার প্রতিবাদ দেশের সংসদের বাইরে হিংসাত্মক সংঘর্ষে রূপ নেয়। এখন মাথা নত করে তিনি সম্ভবত স্বীকার করছেন যে, তিনি কেবল তার নিজের অন্তর্নিহিত শক্তি নিঃশেষ করে ফেলেছেন। কিন্তু এই শরৎকালে তার দলের ক্ষমতা ধরে রাখার সর্বোত্তম সুযোগ হতে পারে এমন একজন নেতার অধীনে দেশ পরিচালনা করা, যিনি গত কয়েক বছর ধরে তার নিজের শক্তি জমা করেছেন। ক্ষমতা থকে সরে যেতে একজন মানুষের কি আত্মসচেতনতা থাকতে পারে? মার্গারেট থ্যাচার শেষ অবধি নির্মমভাবে লড়াই করেছিলেন বলে উত্তর দেওয়ার জন্য এটি একটি জটিল প্রশ্ন। কিন্তু এই স্তরে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হলে অহংবোধের সতেজ অভাবের প্রয়োজন হয়। সম্ভবত ব্রিটিশ শ্রমমন্ত্রী এস্টেল মরিসের ২০ বছর আগে শিক্ষাসচিবের পদ থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্তের সঙ্গে এই ঘটনার দারুণ মিল আছে। কারণ তিনি সে সময় নিজেকে যথেষ্ট উপযুক্ত বলে মনে করেননি। তিনি অনুমান করেন, নিকোলা স্টার্জন পরবর্তী নির্বাচনে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টিকে নেতৃত্ব না-ও দিতে পারেন। যা হোক, সুন্দরভাবে আরডার্নের বিদায় কার্যকর করা যেতে পারে, তবু একজন নারীর প্রস্থান উদ্যাপনের বিষয়ে কিছুটা অস্বস্তিকর বিষয় রয়েছে বৈকি। কেননা, আরডার্ন এত দিন ধরে যে ধরনের অপমানজনক ব্যবহার ও জীবননাশের হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন, তা অনেকের অজানা নয়। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালীন সন্তান জন্মদানকারী দ্বিতীয় নারী নেত্রী তিনি। তিনি কারো কারো কাছে একজন আদর্শ নেত্রী বলে অন্যদের কাছে টার্গেট ছিলেন। তিনি কীভাবে অফিসে সকালের অসুস্থতা বা মাতৃত্বকালীন ছুটি মোকাবিলা করেন এবং অন্যের আক্রমণে প্রতিরোধ গড়ে তুলে অফিস করেছেন, তা-ও আমাদের অজানা নয়। তিনি তার জীবনসঙ্গী ক্লার্ক গেফোর্ডের সঙ্গে এই মর্মে চুক্তি করেছিলেন যে, তিনি প্রাথমিকভাবে তাদের মেয়ের দেখাশোনা করার জন্য বাড়িতেই থাকবেন। এটি এমন একটি কাজ, যা শক্তিশালী পুরুষেরা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে অনাদিকাল থেকে শেয়ার করে আসছেন। আবার এটি এমন একটি কাজ, যার জন্য নারীদের আরো সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করা হয়। তবে এখানে শেষ মুহূর্তে একটি দ্ব্যর্থহীন মর্মস্পর্শিতা ছিল, যখন তিনি তার মেয়ে নেভের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। তিনি এ সময় তার আদরের সোনামণিকে বলেন, ‘তুমি এ বছর যখন স্কুলে পড়াশোনা শুরু করবে, তখন তোমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে আছি।’ এটি সহজ হতে পারে না, তবে আরডার্ন সেই বিরল ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন হয়ে গর্ব করতে পারেন, যিনি যথাসময়ে সত্যিকারের খোঁচাটি দিতে পারেন। তিনি এর মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছেন, দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার ভিন্ন উপায়ও আছে এবং তিনি এটি করে দেখিয়েছেন। তার বয়স মাত্র ৪২ বছর। তর্কের খাতিরে এখনো তিনি অল্প বয়সি। তিনি এরপর আবার সামনের সারির রাজনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু তিনি কি সত্যিই সেটা চান? তার পদত্যাগের বক্তৃতায় আরো একটি স্বীকৃতি রয়েছে। আরডার্ন মনে করেন, নেতৃত্ব আসলে একটি সীমাবদ্ধ প্রক্রিয়া; ক্ষমতা হলো অসম্ভব কঠিন বিষয়গুলোর একটি, যার প্রতিটিতে অনিবার্যভাবে রয়েছে কিছু জ্বালাপোড়ার পুঁজি। অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে, অধিকাংশ নেতার সমস্ত রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় শেষ হয়। আরডার্নের জয় এখানে যে, তিনি সবকিছুকে নিজের হাতে নিয়ে তার প্রস্থানকে কেবল সাফল্যের একটি ভিন্ন প্রতীক ও উপায় হিসেবে পুনর্র্নিমাণ করলেন। ( উৎস: দৈনিক ইত্তেফাক অন লাইন) লেখক : কলামিস্ট,ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ : ফাইজুল ইসলাম