বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশগুলোর বাজার নতুন সম্ভাবনাময় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এমন কয়েকটি বাজারে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের ব্যবসা বেড়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বৈশ্বিক অর্থনীতি টালমাটাল। জ্বালানি তেলের দাম হু হু করে বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। তাতে বহু দেশ বিপদে পড়লেও ব্ল্যাক গোল্ড বা ‘কালো সোনা’খ্যাত জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। তেল ও গ্যাসনির্ভর দেশগুলোর অর্থনীতি রীতিমতো ফুলে–ফেঁপেও উঠছে। যেমন সৌদি আরবের রাজস্বের ৬০ শতাংশ জ্বালানি তেল বিক্রি করে আসে। দেশটির রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকো গত বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে মুনাফা করে ৪ হাজার ৪৮০ কোটি ডলার, যা তাদের ইতিহাসে এক প্রান্তিকে সর্বোচ্চ।
বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কায় বর্তমানে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ৮০ ডলারের ঘরে নেমেছে। তবে আবার তা ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলছে, তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক। জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে কি না, তা সময়ই বলবে। তারপরও বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশগুলোর বাজার নতুন সম্ভাবনাময় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এমন কয়েকটি বাজারে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের ব্যবসা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিস্ট্রেশনের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বে শীর্ষ ১০ জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, রাশিয়া, কানাডা, চীন, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ব্রাজিল, ইরান ও কুয়েত। অন্যান্য সূত্রানুযায়ী, শীর্ষ দশের এ তালিকায় গত বছর তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। যদিও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়া উৎপাদন কমিয়েছে। বর্তমানে বৈশ্বিক তেল উৎপাদনের ২০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র এবং ১১ শতাংশ করে সৌদি আরব ও রাশিয়ার। আর কানাডার হিস্যা ৫ শতাংশের ঘরে।
বিশ্বের শীর্ষ ১০ জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রচলিত বাজার। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছর এখন পর্যন্ত শীর্ষ ১০ জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে সাতটি, অর্থাৎ সৌদি আরব, কানাডা, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ব্রাজিল, ইরাক ও কুয়েতে তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। যদিও তেল উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় দেশ যুক্তরাষ্ট্রে কমেছে। যুদ্ধের কারণে রাশিয়ায় বাজার এক বছর ধরেই খারাপ। ইরানে বাংলাদেশ থেকে বলার মতো পোশাক রপ্তানি হয় না।
চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ৩ হাজার ১৩৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে ৫৬১ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৫৭৭ কোটি ডলারের পোশাক। সেই হিসেবে চলতি বছর এই বাজারে রপ্তানি কমেছে ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। যদিও ডিসেম্বর শেষে যুক্তরাষ্ট্র পোশাক রপ্তানিতে ১ দশমিক ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে কানাডায় ৯৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এ রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি।
মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চলতি অর্থবছর বেশ চমক দেখাচ্ছে বাংলাদেশ। সৌদি আরবে ৪৭ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৮, কুয়েতে ৯০ এবং ইরাকে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৭১ শতাংশ। যদিও ইরাক ও কুয়েতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি খুবই নগণ্য।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ২ হাজার ১৮৪ কোটি টাকার সমান। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে সৌদি আরবে ১৪ কোটি ৬০ লাখ বা ১ হাজার ৫১৮ কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি হয়েছে। গত বছর একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৯ কোটি ৯২ লাখ ডলারের পোশাক। সেই হিসাবে চলতি বছর দেশটিতে রপ্তানি বেড়েছে ৪৭ শতাংশ।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাস, অর্থাৎ জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ৯ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭১ শতাংশ বেশি। গত বছরের প্রথম সাত মাসে রপ্তানি হয়েছিল ৩ লাখ ৩৩ হাজার ডলারের তৈরি পোশাক। এ ছাড়া কুয়েতে চলতি বছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি সময়ে রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ ডলারের পোশাক। গত বছর একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৮৫ লাখ ৯১ হাজার ডলারের পোশাক। তার মানে চলতি বছর রপ্তানি বেড়েছে ৯০ শতাংশ।
মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে অন্যান্য শীর্ষ তেল উৎপাদনকারী দেশ চীনে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ১৬ কোটি ৭০ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ দেশে রপ্তানি বেড়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এ ছাড়া ব্রাজিলে রপ্তানি হয়েছে ১১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পোশাক। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৯ শতাংশ বেশি।
এদিকে যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ায় অনেক পশ্চিমা ব্র্যান্ড তাদের বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়। অর্থনৈতিকভাবে দেশটি বেশ চাপে মধ্যে রয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পোশাক রপ্তানি কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রাশিয়ায় ২৬ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। এ রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৪ দশমিক ৮১ শতাংশ কম।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে সম্প্রতি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি ভালো অবস্থায় রয়েছে। সেখানে আমাদের তৈরি পোশাকের রপ্তানিও বাড়ছে। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এ অঞ্চলে যতটা সুযোগ আছে, ততটা কাজে লাগাতে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে।