ঢাকার দক্ষিণখানের নয়াপাড়ায় স্থাপিত পোশাক কারখানা অ্যাচিভ ফ্যাশন লিমিটেড। কভিড অভিঘাতে ২০২১ সালে কাজ কমে যাওয়ায় সংকটে পড়ে কারখানাটি। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সংকট আরো তীব্র হয়। আশপাশের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতিও খারাপ থাকায় সাব-কন্ট্রাক্ট বা ঠিকাপদ্ধতিতেও কাজ জোগাতে ব্যর্থ হয় অ্যাচিভ ফ্যাশন। এ অবস্থায় টিকতে না পেরে গত ১২ ফেব্রুয়ারি কারখানা বন্ধের নোটিস ঝুলিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে অ্যাচিভ ফ্যাশন লিমিটেড কর্তৃপক্ষ জানায়, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে কারখানা কর্তৃপক্ষ শত চেষ্টা করেও পর্যাপ্ত কাজের অর্ডার সংগ্রহ করতে পারেনি। বিগত দিনগুলোতে সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে কোনো রকমে পোশাক কারখানাটি চালু রাখা হয়েছিল। বর্তমানে সাব-কন্ট্রাক্টেও কাজ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে শ্রমিকদের কাজ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে কর্তৃপক্ষ ক্রমাগতভাবে প্রচুর আর্থিক লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে। এমনকি দিন দিন ব্যাংকে ঋণের বোঝা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ১২ ধারার বিধান অনুযায়ী কারখানার কাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
শুধু পোশাক খাতের অ্যাচিভ ফ্যাশনই নয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, শিল্প অধ্যুষিত ছয় এলাকা আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনায় ২০২২ সালে বন্ধ হয়ে গেছে ৫১০টি শিল্প-কারখানা। এর মধ্যে আশুলিয়া এলাকায় বন্ধ হয়েছে ৯৬টি, গাজীপুরে ১৫৭টি, চট্টগ্রামে ৮০টি, নারায়ণগঞ্জে ২০টি, ময়মনসিংহে ছয়টি ও খুলনায় ১৫১টি কারখানা।
শিল্প খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় বাজারভিত্তিক দেশগুলোর বর্তমান অগ্রাধিকারের বিষয় খাদ্য, জ্বালানি ও আবাসন বাবদ ব্যয়। দেশগুলোর চাকরির বাজারও ভঙ্গুর। ফলে একটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বড় বাজারগুলোয় বিক্রি কমে যাওয়ার প্রভাব এসে পড়েছে বাংলাদেশেও। ফলে যে কারখানা তিন লাখ পিস ক্রয়াদেশ পেত সেটি এখন পাচ্ছে ১ লাখ পিস। এ পরিস্থিতিতে বড় কারখানাগুলো ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যের বাজার ধরে টিকে থাকতে পারলেও তুলনামূলক ছোটগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন মালিকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগে বাংলাদেশে ক্রয়াদেশ আসত সব বড় বাজারভিত্তিক দেশগুলো থেকে। এ বাজারগুলোয় কভিডের প্রভাব ছিল খুব বেশি। তবে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সময় সবগুলো বাজার থেকেই আবার ক্রয়াদেশ আসা শুরু হয়। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বড় বাজারগুলোতে বিক্রি কমে গেছে। টেসকো, ওয়ালমার্ট, ক্যারিফোরÍসবার ক্ষেত্রেই এ বিষয়টি দেখা যায়। মূল্যস্ফীতি সব জায়গাতেই ছড়িয়ে গেছে।’ এর পরও মোট রফতানি বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘এ খাতে মোট রফতানি বেড়েছে কারণ মিডিয়াম সাইজের রিটেইল শপ আগে বাংলাদেশে না এলেও কভিডকালে এসেছে। সেই কাজগুলো গেছে বড় কারখানাগুলোতে। বড় কারখানাগুলো তাদের ফাঁকা জায়গাগুলোতে এ মিডিয়াম রিটেইলারদের কাজগুলো দিয়ে ভরাট করেছে। কাজগুলো পরিমাণে কম হলেও পণ্যের মূল্য বেশি। এ কারণে বাংলাদেশের রফতানি পণ্য পরিমাণে না বাড়লেও অর্থের পরিমাণে বেড়েছে। গোটা পরিস্থিতির প্রভাবে ছোটখাটো কারখানা, সাব-কন্ট্রাক্ট বা ঠিকাপদ্ধতির কারখানাগুলোকে ভুগতে হচ্ছে ক্রয়াদেশের ঘাটতিতে। হাইপার মার্কেটে বিক্রি স্বাভাবিক অবস্থায় না এলে আরো কিছু কারখানা পর্যায়ক্রমে কমবে।’
বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএ সদস্য ৭৫টি, বিকেএমইএ সদস্য কারখানা ২৪টি, বস্ত্র খাতের সংগঠন বিটিএমএ সদস্য তিনটি। এ হিসাবে গত বছর বন্ধ শিল্প-কারখানার মধ্যে বস্ত্র ও পোশাক খাতের কারখানা ছিল মোট ১০২টি। এছাড়া বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) অধীন বন্ধ কারখানার সংখ্যা আটটি। বাকি ৪০০টি বন্ধ কারখানা অন্যান্য খাতের।
জানতে চাইলে বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কারখানায় কাজ বন্ধের এ চিত্র বাস্তবতার প্রতিফলন। আমার কারখানাতেই আগামী মাসে সক্ষমতার মাত্র ২০ শতাংশ কাজ রয়েছে। জানুয়ারি পর্যন্ত আমাদের সংগঠনের ৬০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। কাজের সংকটে ব্যাংকিং দায় বেড়ে যাওয়ায় মালিকরা আর কারখানা সচল রাখতে পারেননি। ২০২৩ সালটাও এ সংকট অব্যাহত থাকবে। তবে আশা করছি ২০২৪ সালে সংকট কাটিয়ে ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হবে। ওই পর্যন্ত কারখানাগুলোকে টিকিয়ে রাখতে ব্যাংকিংসহ সামগ্রিক নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন হবে, যা নিশ্চিত হলে অ্যাচিভ ফ্যাশনের মতো অন্য কারখানাগুলোও আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।’
অর্ডার সংকটের কারণে একের পর এক কারখানা বন্ধের তথ্য দিয়েছে পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএও। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকের সহযোগিতা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংগঠনের নেতারা। একই সঙ্গে তারা শিল্প উদ্যোক্তাদেরও সহনশীল হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। বিজিএমইএ সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অ্যাচিভ ফ্যাশনের মতো ঘটনাগুলো বর্তমানে পোশাক শিল্পের প্রকৃত চিত্র। অনেকেই দাঁত কামড়ে শিল্প টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সহ্যসীমা ছাড়িয়ে গেলে বাধ্য হয়ে বন্ধের নোটিস দিচ্ছেন। কভিড-উত্তর পরিস্থিতি থেকে শুরু করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ গত দেড় বছরে কাজের সংকটে আমাদের সংগঠনের বন্ধ হওয়া কারখানা সংখ্যা ২০৭। তবে শিল্পের উদ্যোক্তারা সহনশীলতা ধরে রাখতে পারবেন এমন প্রত্যাশা করছি।’