একটা সময় ছিল যখন জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক রংপুরের মানুষের মনে আবেগ সৃষ্টি করতো। অবশ্য জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদ যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন, তখনো জাতীয় পার্টি রংপুরে ততটা জনপ্রিয় ছিল না। এরশাদের মূল জনপ্রিয়তা দেখা যায়- ১৯৯০ সালে তার পতনের পর যখন দুর্নীতির মামলায় তাকে কারাগারে যেতে হয়।
কারাগারে থাকা অবস্থায় এরশাদ ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেন। অথচ সে দুটি নির্বাচনে তিনি প্রচারণার কোনো সুযোগ পাননি। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি রংপুর জেলার সবগুলো আসন থেকে জয়লাভ করে। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ১৯৯১ সালে এরশাদ কারাগারে যাবার পর এই অ লে লোকমুখে একটা কথা ছড়িয়েছিল যে এরশাদকে ফাঁসি দেয়া হবে। অথচ সে কথার কোনো ভিত্তি ছিল না। ‘মানুষ তখন বলতে শুরু করে – হামাক রংপুরের ছাওয়ালরে ফাঁসি দেবে? এরপর থেকেই এরশাদের প্রতি মানুষের আবেগ ও সমর্থন পরিষ্কার হয়ে উঠে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বলছিলেন অধ্যাপক ওয়াদুদ।
জাতীয় পার্টি নিয়ে নানা প্রশ্ন: রংপুর মূল শহর থেকে কিছুটা দূরত্বে মহাসড়কের পাশে এরশাদের বাড়ি ‘পল্লী নিবাস’। এরশাদ যখন রংপুরে আসতেন তখন নির্বাচনের সময় এই বাড়িটি ছিল কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু এখন একেবারেই শুনশান নীরবতা। দোতলা এই বাড়িটি এখন একটি ট্রাস্টের আওতায় পরিচালিত হয়। রংপুর শহর এবং তার আশপাশের এলাকা নিয়ে রংপুর-৩ আসন গঠিত। এবার এ আসন থেকে প্রার্থী হয়েছেন এরশাদের ছোট ভাই ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে রংপুর জেলার ছয়টি আসনের সবগুলোতে জাতীয় পার্টি জয়লাভ করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে রংপুর জেলার ছয়টি আসনের মধ্যে তিনটি চলে যায় আওয়ামী লীগের হাতে।
এরশাদ এবং জাতীয় পার্টি ২০০৮ সাল পর্যন্ত রংপুর অ লে প্রভাবশালী ছিলেন। কিন্তু এরপর থেকে সেই প্রভাব ক্ষয় হতে শুরু করে। যদিও এরশাদ যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন রংপুর অ লে তার ব্যক্তিগত প্রভাব ছিল। কিন্তু তার মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির সেই প্রভাব অনেকটাই কমেছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, গত ১৫ বছর যাবত জাতীয় পার্টির ওপর আওয়ামী লীগের প্রভাব। অনেকে মনে করেন, এ সময়ের মধ্যে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের মধ্যে ‘বিলীন হয়ে গেছে’ এবং তাদের নিজের ‘সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা’ নেই। এছাড়া গত দেড় দশকে জাতীয় পার্টি একাধিকবার তাদের গৃহবিবাদ মীমাংসার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বারস্থ হয়েছেন।
জাতীয় পার্টির নানা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় হয়তো মধ্যস্থতা করেছেন নয়তো সমঝোতা করেছেন। ‘দীর্ঘদিন ধরে এই দল কি নিজেদের দ্বারা পরিচালিত হয়, নাকি অন্যের দ্বারা পরিচালিত হয়? যখন দুই নৌকায় পা দিয়ে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা নেবার প্রশ্ন থাকবে তখন অন্যের আনুকূল্য নিয়ে দলটার বিকাশ সাধিত হয়। অন্যের সুযোগ-সুবিধায় একটা দল মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে পারে না,’ বলছিলেন ওয়াদুদ।
জনসংযোগ নেই: রংপুর জেলার ছয়টি আসনের মধ্যে সবগুলোতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী রয়েছে। এর মধ্যে দুটো আসন– গঙ্গাচরা ও সদর আসনে আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বাকি চারটি আসনে আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থী রয়েছে। রংপুর-৩, অর্থাৎ সদর আসনটিতে ছয়জন প্রার্থী থাকলেও কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা দৃশ্যমান নয়। স্থানীয়রা বলছেন- এই আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রত্যাহার করায় জিএম কাদের ‘ওয়াকওভার’ পেয়েছেন। সেজন্য প্রচার প্রচারণায় কোনো গরজও দেখা যাচ্ছে না। এই নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে পড়লো কেন? প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া কোনো নির্বাচনকে কি ভালো নির্বাচন বলা যায়?
বিবিসি বাংলার এমন প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, ‘প্রতিযোগিতা না থাকলে ভালো নির্বাচন বলা যায় না। তবে এটা ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আমাদের হাতে ছিল না।’ রংপুর-৩ আসনে বাকি প্রার্থীরা হলেন – বাংলাদেশ কংগ্রেসের একরামুল হক, এনপিপি’র আব্দুর রহমান, জাসদ-এর শহিদুল ইসলাম, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির শফিউল আলম ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আনোয়ারা ইসলাম রানী, যিনি একজন তৃতীয় লিঙ্গ।
প্রচারণা শুরুর পাঁচদিন পরে জিএম কাদের রংপুর শহরে জাতীয় পার্টি কার্যালয়ের সামনে সীমিত আকারে একটি কর্মীসভা করেছেন। তার তরফ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো জনসংযোগ চোখে পড়েনি। শহরে অল্পকিছু পোস্টার লাগানো ছাড়া অন্যকোনো প্রচারণায় আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া বাকি পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে আনোয়ারা ইসলাম রানী ছাড়া অন্য প্রার্থীদের জনসংযোগে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। শহরে যেসব পোস্টার রয়েছে সেগুলোর মধ্যে জিএম কাদের এবং আনোয়ারা ইসলাম রানীর পোস্টার বেশি। অন্য প্রার্থীদের পোস্টার কিংবা লিফলেট খুব একটা চোখে পড়েনি। কয়েকজন প্রার্থীর পক্ষে শহরে অল্প সময়ের জন্য মাইকিং করতে দেখা গেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে ভোট চাওয়ার কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। অন্য প্রার্থীরা জনসংযোগে সক্রিয় হচ্ছেন না কেন? বিষয়টি নিয়ে আনোয়ারা ইসলাম রানীর মনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।
‘শুধু আমি একাই মাঠে আছি, আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখছি না। এটা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? আসলেই কি সিলেকশন হয়ে আছে? যদি এরকমই হয় তাহলে আমাদের হয়রানি করার কী দরকার? নির্বাচন নিয়ে এই নাটক কেন?’ প্রশ্ন তোলেন আনোয়ারা ইসলাম রানী।
ভোটারদেরও আগ্রহ নেই: রংপুর অ লে জাতীয় পার্টি যত দুর্বল হয়েছে তাতে লাভ হয়েছে আওয়ামী লীগের। রংপুর জেলার এমনিতেই বিএনপির অবস্থান দুর্বল। অনেকে বলেছেন, রংপুরে দুটি আসনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ছাড় দিয়েছে সে দুটি আসনে লাঙ্গল প্রতীক জিতবে। বাকি চারটি আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর জয়লাভের সম্ভাবনা খুবই কম।
রংপুর শহর এবং এর আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক ভোটারদের মনে কোনো ছাপ ফেলতে পারছে না। ‘ভোট দেলেও ওরা হইবে, না দেলেও হইবে। আমাদের ভোট তো লাগেই না। এ দুঃখ থোয়ার জায়গা নাই,’ বলছিলেন রংপুর শহরের রিকশাচালক নূর আলম। তিনি মনে করেন, নির্বাচনে যেহেতু প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই সেজন্য ভোটারদের কোনো দামও নেই। ‘রিকশাচালকের দম হয় কখন? যখন ভোট আইসে। কিন্তু এই ভোটটাই তো আমরা দেতে পারি না,’ বলছিলেন নূর আলম। রংপুর সদর আসেন স্থানীয় নারী ভোটারদের মধ্যেও ভোটকেন্দ্র যাবার বিষয়ে অনাগ্রহ দেখা গেছে। যারা আওয়ামী লীগ সমর্থক তারাও মনে করছেন, ভোট কেন্দ্রে গিয়ে কোনো লাভ নেই। নির্বাচনের ‘ফলাফল নির্ধারিত’ হয়ে গেছে।
‘ভোট তো মনে করেন দিতে যাওয়া লাগে না। গিয়েই তো ফেরত আসা। যায়া দেখি তো সিল মারা হয়া গেছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন রংপুর শহরের বাসিন্দা ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রোকসানা বেগম। তবে সবাই যে একেবারে নির্বাচন বিমুখ হয়ে পড়েছেন এমন নয়। কম হলেও কেউ কেউ ভোট দেয়ার কথাও ভাবছেন। যেমন শিক্ষার্থী রুবাইয়া নাহার মোহনার নির্বাচন নিয়ে প্রত্যাশা রয়েছে।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘আমার মনে হয় এবার আওয়ামী লীগই আবার জিতবে, এটাই প্রত্যাশা করি। কারণ ওনাদের সময় আমরা অনেক উন্নয়ন পেয়েছি। কিছু খারাপ দিক আছে, তবে প্রত্যেকটা ভালোরই তো একটা খারাপ দিক থাকে। আমরা অনেক সন্তুষ্ট।’
তবে রংপুর-৩ আসনের সাধারণ মানুষজন বলছেন- এতটা ‘নিরুত্তাপ ও আমেজহীন’ সংসদ নির্বাচন তারা আগে দেখেননি। বরং স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এরচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখা যায় বলে উল্লেখ করেন পর্যবেক্ষকরা। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ যেভাবে আসন ভাগাভাগি করেছে সেটি না করলে হয়তো রংপুরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হত। আসন সমঝোতার প্রভাব পড়েছে এখানে।
‘এখানে যে একটা জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে তার কোনো আবহ নেই। নির্বাচন আসলে এখানকার কোনো ইস্যু নয়,’ বলছিলেন তুহিন ওয়াদুদ। এই পরিস্থিতির জন্য জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও রংপুর-৩ আসনের প্রার্থী জিএম কাদের দায়ী করলেন সরকারকে। ‘এটা তো আমরা সৃষ্টি করিনি। আমাদের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য যেটা প্রয়োজন ছিল সেটা আমরা করছি,’ বিবিসি বাংলার প্রশ্নের জবাবে বলেন জিএম কাদের। কাদের শনিবার রংপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অনেক চিন্তাভাবনা করেই তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এর সাথে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার বিষয়টিও জড়িত ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। সূত্র : বিবিসি