বাংলাদেশের মানসিক চিকিৎসকরা বলছেন, যদিও আগের তুলনায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু এখনো দেশের মানুষজনের মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা রয়েছে। যদিও শারীরিক অন্য সমস্যার মতো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হলে সঠিক কাউন্সেলিং ও চিকিৎসায় পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করা যায়।
কিন্তু শারীরিক বেদনার মতো জটিলতা তৈরি না হওয়ায় অনেকেই বুঝতে পারেন না, কখন আসলে তাদের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। মানসিক, পারিবারিক বা সামাজিক নানা ট্যাবুও এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও মনোরোগবিদদের সাথে কথা বলে বিবিসি জানার চেষ্টা করেছে, কী ধরণের আচরণ বা উপসর্গ দেখা গেলে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।
কখন বুঝবেন আপনি মানসিক রোগে আক্রান্ত: মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তির আচরণ, ব্যবহারে বড় ধরণের পরিবর্তন দেখা যায়, বিশেষ করে তার আবেগীয় প্রকাশের পরিবর্তন আসে এবং সেটা তার দৈনন্দিন কর্মকা-ে, সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে শুরু করে, তখনি তার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।’
তিনি বলেন, মানসিক রোগের লক্ষণ হতে পারে: ১. হঠাৎ হঠাৎ করে বেশি উত্তেজিত হয়ে ওঠা। ২. অনেক দিন ধরে নিজেকে সবার কাছ থেকে সরিয়ে গুটিয়ে রাখা। ৩. টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে মন খারাপ থাকা। ৪. অন্যদের সাথে একেবারে কথা বলতে না চাওয়া। ৫. সবার সাথে ঝগড়া করা। ৬. গায়েবি আওয়াজ বা কথা শুনতে পাওয়া । ৭. অন্যদের অকারণে সন্দেহ করতে শুরু করা। ৮. গোসল বা দাঁত মাজার মতো নিয়মিত প্রাত্যহিক কাজ করা বন্ধ করে নিজের প্রতি যতœ না নেয়া। ৯. যেসব কাজে আনন্দ পাওয়া সেসব কাজে নিরানন্দ ও আগ্রহ কমে যাওয়া। ১০. সামাজিক সম্পর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া। ১১. নিজেকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করা বা নিজেকে দায়ী মনে হওয়া। ১২. সবকিছুতে সিদ্ধান্তহীনতা বা মনোযোগ কমে যাওয়া এবং খুব তীব্র হলে আত্মহত্যার চিন্তা পরিকল্পনা ও চেষ্টা করে অতিরিক্ত শুচিবায়ুগ্রস্ত হয়ে ওঠা। ১৩. ঘুম অস্বাভাবিক কম বা বাড়তে পারে। ১৪. খাবারে অরুচি তৈরি হওয়া বা রুচি বেড়ে যাওয়া। ১৫. বাসার, অফিসের বা পেশাগত কাজের প্রতি অনীহা তৈরি হওয়া বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
ডা. মেখলা সরকার বলেন, এই সমস্যাগুলোর মানেই যে তার মানসিক রোগ হবে, তা নয়। তবে এসব উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা গেলে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলা উচিত। তারা সেটা বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারবেন যে, এখানে আসলে কোনো ব্যবস্থা নেয়া উচিত কি না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, আমাদের সবার মধ্যে কিছু কিছু আচরণের অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে। সেটা হলেই সবাইকে মানসিক রোগী বলা যাবে না। কিন্তু তার এই মনের অবস্থার কারণে যদি তার স্বাভাবিক বা প্রাত্যহিক কর্মকা- ব্যাহত হতে থাকে, তখনি বুঝতে হবে যে, সে হয়তো মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
সাধারণ মনখারাপ, বিষণ্ণতা আর মানসিক রোগ কী একই? মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মন যেমন আনন্দিত হয়, তেমনি কখনো কখনো খারাপও হতে পারে। কিন্তু মন খারাপ বা বিষণ্ণতাভাব যদি দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকে তখন মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে নজর দিতে হবে। ডা. সরকার বলেন, আমাদের সবার জীবনেই কখনো কখনো মন খারাপ হতে পারে। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ বা বেশি দিন থাকার কথা নয়। অথবা ভালো কোনো ঘটনায়, খবরে সেটা ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে যদি টানা মনখারাপ ভাব বা বিষণ্ণতা থাকে, তখন সেটা মানসিক রোগের উপসর্গ বলে ধরে নিতে হবে।’ বিষণ্ণতাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ শুরুতেই এর প্রতি যথাযথ দৃষ্টি না দিলে এ থেকে গুরুতর সমস্যা তৈরি হতে পারে। বিষণ্ণতা বলতে অনেকে মন খারাপকে বুঝে থাকেন। ‘বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্ত হলে ঘরে-বাইরে, অফিসে বা প্রিয় জায়গাগুলোয় গেলেও মন ভালো হয় না। যতই ভালো ঘটনা ঘটুক, প্রিয় জায়গায় যাওয়া হোক, তখন মনের খারাপ ভাবের পরিবর্তন হয় না। তখন পারস্পরিক সম্পর্কের ওপরেও প্রভাব পড়তে শুরু করে।’ বলেন ডা. সরকার।
সামাজিক ট্যাবুর পরিবর্তন আসছে: মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলছেন, একটা সময়ে মানসিক রোগ নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে একপ্রকার ভীতি বা ট্যাবু ছিল। কিন্তু এখন সেটা অনেকাংশে কাটতে শুরু করেছে।
‘গত ৭০ বছরে মানসিক রোগ চিকিৎসায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এখন চিকিৎসার মাধ্যমে জটিল রোগীরাও সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। মানুষ সেটা এখন বুঝতে শুরু করেছে। বিশেষ করে গত ১০ বছরে তাদের ট্যাবু অনেকটাই ভেঙ্গে গেছে। এখন অনেকেই মানসিক চিকিৎসার জন্য আসছেন’ তিনি বলেন। ‘এখন অনেকে খুব সাধারণ মানসিক সমস্যা নিয়েও আমাদের কাছে আসছেন।’ শিশুদের মানসিক রোগ কীভাবে বোঝা যাবে? বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ঢাকা পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে শিশু কিশোরদের আঠার শতাংশের বেশি বিষণ্ণতায় আক্রান্ত।
অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার বলছেন, মানসিক রোগ হলে তার অনেকগুলো শারীরিক প্রভাবও দেখা যায়। যেমন মাথাব্যথা, বুকে ব্যথা, শ্বাসে সমস্যা, অনীহা বা দুর্বলতা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। ‘এই রকম রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে যদি দেখা যায় যে, তার আসলে শারীরিক কোনো সমস্যা নেই, তারপরেও তিনি এরকম সমস্যায় ভুগছেন। তখন এটা মানসিক কারণে হতে পারে বলে আমরা সন্দেহ করি।’
‘শিশুদের ক্ষেত্রেও তাই। অনেক সময় দেখা যায়, তার আচরণে সমস্যা তৈরি হয়েছে। সে খুব রেগে যাচ্ছে, ভাঙচুর করছে, বাবা-মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে। বন্ধুদের সাথে মিশতে পারছে না। পড়ালেখায় আগ্রহ নেই, ঘুম হচ্ছে না, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করছে না। এসব লক্ষণ দেখা গেলে তার মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে’ তিনি বলেন। মানসিক রোগের চিকিৎসায় কাউন্সিলিং অনেক সহায়তা করে।
মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে কী করতে হবে? পৃথিবীজুড়ে মানসিক রোগের দুই ধরণের চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। তার একটি হচ্ছে কাউন্সেলিং বা পরামর্শ সেবা। আরেকটি ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, ‘কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে মনোরোগবিদদের পরামর্শ নিতে পারেন। অনেক সময় কাউন্সেলিং থেরাপির মাধ্যমে সহজেই এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।’ তিনি আরো বলেন ‘কিন্তু সেটা না হলে অবশ্যই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সহায়তা নিতে হবে। তখন তারা ওষুধের মাধ্যমে রোগের চিকিৎসা করে থাকেন। প্রয়োজন ভেদে হাসপাতালে ভর্তি করেও চিকিৎসার দরকার হতে পারে।’ তবে বাংলাদেশের সর্বত্র এখনো মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সেবা পাওয়া যায় না। মূলত এই সেবাটি এখনো প্রধান শহরকেন্দ্রিক। তবে মাহফুজা খানম পরামর্শ দিচ্ছেন, এখন অনেক বিশেষজ্ঞ অনলাইনে রোগী দেখছেন। এসব ক্ষেত্রে অনলাইনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। সূত্র : বিবিসি