সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় খুলনার কয়রা অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। নিয়ম করে বছরের বিভিন্ন সময় নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে নদ নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রায়ই প্লাবিত হয়ে থাকে বিস্তীর্ণ এলাকা। এসব কারণে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির সংকটের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে গাছপালা, নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি, হ্রাস পাচ্ছে কৃষি উৎপাদন। হুমকিতে রয়েছে জীববৈচিত্র্য। এতে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ একদিকে যেমন কর্মহীন হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে বিভিন্ন এলাকা। জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রতি বছর পেশা বদল করছে বহু মানুষ। অনেকে আবার নতুন কাজের সন্ধানে পাড়ি জমাচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এক কথায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সামনে জীবিকার তাগিদে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের। বৈষ্যিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে গত কয়েক বছরের ব্যবধানে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতি বছর কোনো না কোনো দুর্যোগ আঘাত হানছে এ অঞ্চলে। সিডর, আইলা, ফনি,ইয়াস,আম্ফান এর ক্ষত কাটিয়ে ওঠার আগেই গত বছরে রিমেলের মত বড় ধরনের দুর্যোগ আঘাত হেনেছে এলাকায়। এ সকল ঘুর্নিঝড়ে ওয়াপদার বেড়িবাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে নাব্যতা হারিয়েছে এলাকার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নদী। যার মধ্যে কপোতাক্ষ, শিবসা ও হাড়িয়া নদী অন্যতম। পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতার মুখে বৃষ্টির মৌসুমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এই উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। আর এ সুযোগে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ঢুকে পড়ে লবণপানি। এসব নদ-নদীর মাধ্যমে সমুদ্রের উগলে দেওয়া পানি ও অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষাবাদের ফলে বিভিন্ন পোল্ডারের অভ্যন্তরে অবাধে অনুপ্রবেশ ঘটছে লবণপানির। এতে ফসলি জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাসের পাশাপাশি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীব ও প্রাণীবৈচিত্র্যের। উপজেলার মঠবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম জানান, এলাকায় সুপেয় পানির তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিদিন হেঁটে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে খাবার পানির ব্যবস্থা করতে হয়। এতে শ্রমের পাশাপাশি সময়ও অপচয় হয়। এ ছাড়া লবণপানির বিরূপ প্রভাব, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি এবং জোয়ারের উপচে পড়া পানিতে বনাঞ্চল উজাড়ের পাশাপাশি ঘরবাড়িসহ কৃষিজমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ও হচ্ছে। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে সংকট দেখা দিয়েছে গোখাদ্যের। লবণপানির আধিক্যে এরই মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে অসংখ্য দেশীয় প্রজাতির মাছ। বিভিন্ন সময় দুর্যোগের মুখে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় দূষণে বাড়ছে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো মেরামতে পাউবোর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিলেও ঠিক কবে নাগাদ এর বাস্তবায়ন হবে তা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য গাজী সিরাজুল ইসলাম বলেন,, তাদের ইউনিয়নটি একটি দ্বীপবেষ্টিত অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে প্রতিনিয়ত সেখানে বাড়ছে নানা সংকট। বিশেষ করে পরিবেশ ধ্বংসের পাশাপাশি সেখানকার বৃহৎসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ছে। জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেকেই প্রতি বছর অন্যত্র চলে যাচ্ছে এক প্রকার বাধ্য হয়েই। এজন্য জিও-এনজিও পর্যায়ে দরকার দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন পরিকল্পনার। কপোতাক্ষ কলেজের সাবেক অধ্যাপক আ, ব,ম আঃ মালেক বলেন, এখানকার মানুষের টিকে থাকতে হলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, পর্যাপ্ত নিরাপদ পানির উৎস তৈরি, টয়লেটের প্ল্যাটফরম উঁচু এবং উন্নত করা, স্থানীয় সরকার ও সরকারের জলবায়ু মোকাবিলায় অর্থায়ন বাড়ানো, পর্যাপ্ত ড্রেন, কালভার্ট ও সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণসহ কৃষি ক্ষেত্রে লবণসহিষ্ণু বিভিন্ন ফসলের নানা জাত উদ্ভাবন করতে হবে। বর্ষার মৌসুমে এলাকায় বিভিন্ন খালে ইজারাদাররা আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে মৌসুমে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক এবং এলাকার অর্থনীতি। তিনি উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে পর্যাপ্ত বরাদ্দের দাবি জানান। কয়রা উপজেলা জলবায়ু পরিষদের সমন্য়ক নিরাপদ মুন্ডা বলেন, নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনমান সমুন্নত রাখতে জিও-এনজিও পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা দরকার। তাহলে এ জনপদের মানুষেরা টিকে থাকতে পারবে।