রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫, ১১:০৭ পূর্বাহ্ন

সেনা কর্মকর্তা হয়ে দেশের সেবা করার স্বপ্ন দেখতেন শহীদ শিহাব

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫
শহীদ শিহাব আহমেদ। ছবি : বাসস

পরিবারের সবার আশা ছিল শিহাব বড় হয়ে সেনাবাহিনীতে চাকরি করবে। দেশকে ভালোবাসবে, দেশের জন্য কাজ করবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণের আগেই, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হন শিহাব আহমেদ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদত্যাগের চলমান একদফা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিল শিহাব। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার সামনে পুলিশের গুলিতে থেমে যায় তার পথচলা। একই সাথে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় পরিবারের স্বপ্ন।
শহীদ মো. শিহাব আহমেদ ২০০৫ সালের ১৪ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শফিউদ্দিন (৪৫), মালয়েশিয়া প্রবাসী। মা মোছাম্মৎ শাহনাজ খাতুন (৪৫), গৃহিণী।
শিহাব সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং স্থানীয় একটি ব্লাড ব্যাংকের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
শিহাব ছিলেন আদর্শবান, মানবিক গুণে গুণান্বিত ও দায়িত্বশীল। ক্রীড়ামোদী, স্নেহপরায়ণ, পরোপকারী ও দেশপ্রেমের মহান আদর্শে উজ্জীবিত এক সাহসী তরুণ। শুধু নিজের বা পরিবারের নয়, সমাজ ও দেশের জন্যও ভাবতেন, কাজ করতেন তিনি।
শহীদের মা বলেন, ‘আমার তিন ছেলে। শিহাব ছিল সবার বড়। ওর স্বপ্ন ছিল সেনাবাহিনীতে চাকরি করে দেশের জন্য কাজ করার। কিন্তু সব আশা শেষ হয়ে গেল। ওর বাবা মালয়েশিয়ায় থাকে। আমি ছেলেদের নিয়ে বাড়িতে থাকি। লেখাপড়ার জন্য ওর বাবা কত কষ্ট করছে! তার ইচ্ছা ছিল ছেলেদের মানুষ বানাবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।
শিহাব শহীদ হলো, আর ওর বাবা শেষবারের মতো ছেলের মুখটাও দেখতে পেল না। সে দেশে ফিরে এলে আমি কী জবাব দেব?’
শহীদ শিহাব আহমেদের মা শাহনাজ পারভীন সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর উপজেলার মাধবপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে বাসস প্রতিবেদককে এসব কথা বলেন।
শিহাবের ছোট দুই ভাই যমজ: মো. হাসান ও মো. হোসাইন। একজন ইমপেরিয়াল প্রি-ক্যাডেট স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে, অপরজন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিহাবের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে এনায়েতপুরের মাধবপুর গ্রামে। ক্রিকেট ছিল তার প্রিয় খেলা। বিকেল হলেই ব্যাট-বল হাতে মাঠে ছুটে যেত। সহজ-সরল, মিষ্টভাষী এই কিশোরটি সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারত। মানুষের প্রতি ছিল গভীর দায়িত্ববোধ। যে কারো জন্য রক্ত দিতে এগিয়ে আসত, যেকোনো প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়াত। ৪ আগস্টের ঘটনার বর্ণনায় শিহাবের মা বলেন, ‘ঘটনার কিছু আগে আমি ওকে ফোন করে জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি কোথায়?’ সে জবাব দেয়, ‘আমি হাসপাতালে আছি, একজনকে রক্ত দিতে এসেছি। পরে কথা বলব।’
দুপুর দেড়টার দিকে এনায়েতপুর থানার সামনে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। একটি গুলি শিহাবের ডান পাঁজরে লাগে। তখনই তাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য ভ্যানে তোলা হয়, কিন্তু ভ্যানে উঠাতেই সে মারা যায় বলে প্রতীয়মান হয়। তবুও বন্ধুরা দমে না গিয়ে শেষ চেষ্টা হিসেবে তাকে খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু না, কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
।তিনি বলেন, ‘পরীক্ষা স্থগিত থাকায় ছুটিতে বাড়ি এসেছিল শিহাব। এসেই আন্দোলনে যোগ দেয়। আমাদের বলে যায়নি। তাই আমরা কিছুি ক্পজানতাম না। ঘটনার পরে ওর বন্ধুরা ফোনে জানালে আমরা হাসপাতালে ছুটে যাই। ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ রাত আটটায় আজুগড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়।’
শহীদ শিহাবের বন্ধু আহমেদ সাদ বলেন, ‘শত চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারিনি। ও আমার জুনিয়র হলেও সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মতো। মরার দশ মিনিট আগেও বিস্কুট নিয়ে মজা করছিলাম। থানার সামনে দাঁড়িয়ে ফোনে ও আম্মুকে আন্দোলনে যোগ দেয়ার কথা লুকিয়ে খাজা হাসপাতালে রক্ত দিতে এসেছে বলে জানায়, যেন মােে টনশন না করেন। এটাই ছিল আম্মুর সঙ্গে ওর শেষ কথা।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ হঠাৎ গুলি শুরু করলে সবাই দৌড়ে পালালেও পেছনে তাকিয়ে দেখি শিহাব মাটিতে পড়ে আছে। চোখ উল্টে গেছে। তাকে তিন-চারজন ধরে সরিয়ে নেয়। চোখের সামনে তার ছটফটানি ভুলতে পারছি না।’
শহীদের ভাই মো. হাসান বলেন, ‘ভাই আমাকে খুব ভালোবাসত। খাওয়ার সময় ডাকত, বাইরে থেকে এলে খোঁজ নিত, পড়াশোনার খোঁজ রাখত। এখন তাকে খুব মনে পড়ে, ঘুমাতে পারি না।’
শিহাবের দাদি সাহিদা বেগম (৬০) বলেন, ‘আমার সোনার টুকরো নাতি ভাইকে যতœ করে বড় করছিলাম। এভাবে জীবন দিতে হবে ভাবিনি। এখন কবরে সে শান্তিতে থাকুক, এটাই চাই।’
ভবিষ্যতে আর কোনো স্বৈরাচার যেন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে না পারে, সে ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে শহীদ শিহাবের মা বলেন, ‘২০২৪ সালের আন্দোলনে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছে, আহত হয়েছে। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি স্বৈরাচারমুক্ত দেশ পেয়েছি।’
তিনি বলেন, :আমি চাই ভবিষ্যতে আর কোনো স্বৈরাচার যেন ক্ষমতায় না আসে। আবার যেন হাজার মায়ের বুক খালি না হয়। যারা এই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত, তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের সবাইকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে।’
আহতদের পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই আন্দোলনে দেশের হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আহত হয়েছে। তাদের পূর্ণবাসন করতে হবে।’
সহযোগিতা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে শাহনাজ পারভীন বলেন, ‘জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা পেয়েছি। ঈদের আগে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার আমাদের উপহার দিয়েছিলেন।’
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় কলেজছাত্র শিহাব হোসেন (১৯) নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় সিরাজগঞ্জ-৫ (বেলকুচি-চৌহালী) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মমিন ম-লসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ৫০০-৭০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com