শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫, ১০:৪২ অপরাহ্ন

জুলাই স্মৃতি: ফ্যাসিবাদের ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে যেসব নাটক ও শর্টফিল্মে

বিনোদন:
  • আপডেট সময় শনিবার, ৫ জুলাই, ২০২৫

২০২৪ সালের জুনের শুরুতে নিঃশব্দ ক্ষোভ বীজ বপন করেছিল ছাত্রদের মনে। বৈষম্যের শেকল ছেঁড়ার আকুলতা, সমতার দাবিতে বুকের ভেতর সঞ্চিত অগ্নি। আর সেই আগুনই জুন-জুলাইয়ে দাবানলে রূপ নেয়। শহরের রাজপথের ঝাঁকে ঝাঁকে মিছিল নামে। গলিতে গলিতে স্লোগান ছুটে চলে ‘সমতা চাই, ন্যায্যতা চাই’।
শাহবাগের মোড়, টিএসসি প্রাঙ্গণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত চত্বর হয়ে ওঠে দ্রোহের মঞ্চ। ছাত্রদের চোখে শুধু ক্ষুধার্ত চাকরির আশ্বাস নয়, একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন জ্বলে ওঠে।
অন্যদিকে রাষ্ট্রও নির্বিকার ছিল না। আন্দোলন দমাতে পুলিশ বাহনী শুরু করে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গ্রেফতার। রক্ত-ঘাম-অশ্রুর এ পলিমাটি সাক্ষ্য দেয় অসম সাহসের, যে সাহস বৈষম্যের বৃত্ত ভাঙতে শিখিয়েছে তরুণদের। ছাত্রদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে রাজপথে নেমে আসে লাখো কোটি জনতা।
ডাক দেয় এক দফার। তৎকালীন ফ্যাসিবাদ সরকার হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে ফুঁসে উঠে সারা বাংলা। সেই আন্দোলনের মুখেই হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। শতাধিক ছাত্রের তাজা রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ শুরু করে নতুন পথচলা। আন্দোলন পরবর্তী সেই জুলাই স্মৃতি রোমন্থন করে গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন নাট্যদল মঞ্চে নিয়ে আসে নাটক। নির্মিত হয়েছে অনেক শর্টফিল্ম।
গণ-অভ্যুত্থানে পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর প্রথম শর্টফিল্ম নির্মাণ করেন মাবরুর রশীদ বান্নাহ। হাসিনার নিষ্ঠুর শাসনামল তুলে ধরার দায়িত্ব ছিল সংস্কৃতি অঙ্গনের সচেতন মানুষের। অথচ আন্দোলন পরবর্তী কেউ সাহস দেখাতে পারেনি, যা প্রথম করে দেখিয়েছিলেন এ নির্মাতা।
নির্মাণ করেছেন ‘নাস্তা’ এবং ‘লাঞ্চ’ নামে দুটি শর্টফিল্ম। তার নির্মিত ফিল্মে উঠে এসেছে হাসিনার শাসনামলের ভয়াবহতা। একইসঙ্গে দেখা গেছে গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর চালানো নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও আওয়ামী লীগের কালো অধ্যায়। দুটি ফিল্মের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরশ খান। আরও রয়েছেন টুইংক ক্যারল, শওকত হোসেন মামুন, তোরসা প্রমুখ।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘জুলাই ৩০৩’ নামে আরও একটি শর্টফিল্ম। আজিজ হাকিম পরিচালিত এ ফিল্মটি চলতি বছরের ১ জুলাই মুক্তি পায়। এ ছাড়াও একই প্রেক্ষাপট নিয়ে আন্দোলন পরবর্তী বেশ কিছু সিনেমা নির্মাণের ঘোষণা এলেও, এখনো নির্মাণের পূর্ব প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘আয়নাঘর’, ‘ভয়ংকর আয়নাঘর’, ‘পরিবর্তন’, ‘৩৬শে জুলাই’ ইত্যাদি। এ ছাড়াও ‘দ্য রিমান্ড’ নামে একটি সিনেমা নির্মিত হয়েছে। আশরাফুর রহমান পরিচালিত এ সিনেমাটি এখন পর্যন্ত সেন্সর ছাড়পত্র পায়নি। এতে অভিনয় করেন জাকিয়া বারী মম, সালহা খানম নাদিয়া, লুৎফর রহমান জর্জ, কাজী হায়াৎ, মারুফ আকিব প্রমুখ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে তৈরি হয়েছে অনেক মঞ্চ নাটক। এসব নাটক রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন মঞ্চে পরিবেশন করেছে নাট্যদলগুলো। রবি ঘোষ লিখেছেন ‘হাহাকার’ নামে একটি মঞ্চ নাটক। সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির হাসন রাজা মিলনায়তনে লেখকেরই নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় এটি।
নাটকে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণ ও তাদের আত্মত্যাগ এবং আন্দোলনের দিনগুলোয় ফ্যাসিস্টদের নির্যাতন তুলে ধরা হয়েছে। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের তথাকথিত উন্নয়নের নামে কুকীর্তিমূলক কর্মকা- উপজীব্য করে ভিন্নমাত্রিকভাবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ‘মুনির চৌধুরী জাতীয় নাট্যোৎসব-২০২৫’ উপলক্ষ্যে বাগেরহাট এবং খুলনা জেলা শিল্পকলায় প্রদর্শিত হয়েছে নাটক ‘চব্বিশের চিরকুট’।
নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী তরিকুল সরদার। নির্দেশক জানান, এটি ঐক্যবদ্ধ আহ্বানের গল্প। যে আহ্বানে রাজপথে নেমে এসেছিল বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লাখ লাখ ছাত্র-জনতা, বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত হয়েছে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম ফ্যাসিবাদী সরকারের।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয়েছে নাটক ‘দেয়াল জানে সব’। স্পন্দন থিয়েটার সার্কেলের পরিবেশনায় এটি মঞ্চস্থ হয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে। রচনা ও নির্দেশনায় ছিলেন শাকিল আহমেদ সনেট। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে মঞ্চে আসে আরও দুটি নাটক ‘আর কত দিন’ ও ‘অগ্নি শ্রাবণ’।
অন্তর্যাত্রা নাট্যদলের প্রযোজনা ‘আর কত দিন’। নির্দেশনা দিয়েছেন খন্দকার রাকিবুল হক। অন্যদিকে ভৈরবী গীতরঙ্গ দলের নাটক ‘অগ্নি শ্রাবণ’। এটি রচনা ও নির্দেশনায় রয়েছেন ইলিয়াস নবী ফয়সাল। নাটকটিতে উঠে এসেছে ইতিহাসের একের পর এক নতুন অধ্যায়।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মিলনায়তনে জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান অবলম্বনে নাটক ‘লাল জুলাই’ মঞ্চস্থ হয়। তারেক তাশাতের রচনা ও পরিচালনায় নাটকটি পরিবেশন করেন ব্যতিক্রম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জোটের শিল্পীরা। বর্ষীয়ান লেখক যতীন সরকার রচিত নাটক ‘সব পাওয়ার মন্ত্র’। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনাকে সিম্বোলিকভাবে সংশ্লেষ ঘটিয়ে নির্মিত হয়েছে নাটকটি।
থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের আয়োজনে ১৮তম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় নাট্যোৎসবের সমাপনী দিনে ঢাবির টিএসসি অডিটোরিয়ামে মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। নির্দেশনা দিয়েছেন মহিউদ্দিন রনি। নির্দেশক বলেন, ‘বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মূল্যবোধকে ধারণ করে ও সাহসী বীরদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে এ নাটক।’
শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ৬৪ জেলায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থান শীর্ষক প্রযোজনাকেন্দ্রিক নাট্যকর্মশালা ও মুনির চৌধুরী নাট্যোৎসবের অংশ হিসাবে ফরিদপুরের কবি জসিম উদ্দীন মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘দ্য ডার্ক ক্রিস্টাল’। এটি লিখেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ইরা আহমেদ। নির্দেশনা দিয়েছেন ইরা আহমেদ ও বিশ্বনাথ ভৌমিক।
কুষ্টিয়ার মঞ্চে পরিবেশিত হয় নাটক ‘রক্তগন্ধা জুলাই’। নাটকটিতে ফুটিয়ে তোলা হয় গত বছরের জুলাই-আগস্টে উত্তাল বাংলাদেশকে। রচনা ও নির্দেশনায় রয়েছেন লিটন আব্বাস। এতে অভিনয় করেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া ১৮ শিক্ষার্থী।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘দ্রোহের রক্ত কদম’। এটি মঞ্চায়ন করে নাট্যদল এথেরা : অব্যক্ত প্রতিধ্বনি। নাটকটির ভাবনা ও নির্দেশনায় রয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইরা আহমেদ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘গারদের বন্দি’। প্রযোজনা করেছে স্বাপ্নিক থিয়েটার।
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত ‘জাতীয় পথ নাট্যোৎসব-২০২৫’-এ এটি মঞ্চস্থ হয়। নাটকটি রচনা করেছেন হুসনে মোবারক, নির্দেশনায় ছিলেন এইচ এম তানভীর হাসান। মুনীর চৌধুরী জাতীয় নাট্যোৎসব উপলক্ষ্যে মানিকগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চস্থ হয় ‘স্বরূপ দেখা’। এ নাটকের কাহিনিতে উঠে এসেছে গণ-অভ্যুত্থানের চিত্র। জেলা শিল্পকলার প্রযোজনায় নাটকটি রচনা ও নির্দেশনায় ছিলেন নাসরিন সুলতানা (অনু)।
এদিকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের রক্তাক্ত স্মৃতিসহ গণমানুষের নির্যাতন, সংগ্রাম ও গণ-অভ্যুত্থানের স্মৃতি পুনঃসৃজন করতে গণ-অর্থায়নে নির্মিত হয় রাজপথ-গণপরিবেশনা ‘লাল মজলুম’। এ গণপরিবেশনার ভাবনা, পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক ড. শাহমান মৈশান। ( প্রতিবেদক:রিয়েল তন্ময়,উৎস: দৈনিক যুগান্তর)




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com