বেশ কিছুদিন পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে এমন দুটি উক্তি করেছেন যে দুটি উক্তিতে বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর মানুষের মনের কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তারেক রহমান বলেছেন, ‘জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক শক্তি যদি ঐক্যবদ্ধ না হয়, তাহলে আগামী দিনে গুপ্ত স্বৈরাচারের আগমন ঘটতে পারে। তাই দেশ ও জনগণকে রক্ষার দায়িত্ব এখন আমাদের সবার।’
গত শনিবার ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে পাঁচটায় কুমিল্লা টাউন হল মাঠে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অনলাইনে তিনি এসব কথা বলেন। তারেক রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের সবার ঘর। এই ঘরে ১৫-১৬ বছর ধরে ডাকাত পড়েছিল, জনগণ তাকে বিতাড়িত করেছে। এখন দেশ পুনর্গঠনের সময়।’
তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতার পর একদলীয় শাসন ও স্বৈরতন্ত্র বারবার এদেশে মাথাচাড়া দিয়েছে, আবার জনগণের আন্দোলনে তা পরাজিত হয়েছে। হুঁশিয়ারি দিয়ে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমাদের জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণই বিএনপির শক্তির উৎস। সবার আগে বাংলাদেশ, এই অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করতে হবে।’
তারেক রহমান সেই বক্তৃতায় গুপ্ত স্বৈরাচার কারা সেটি সুনির্দিষ্ট করে বলেননি, অর্থাৎ কারো নাম নেননি। কিন্তু তার একদিন আগে নিউইয়র্কের এক সমাবেশে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস কোনোরূপ রাখঢাক না করে সরাসরি ভারত এবং আওয়ামী লীগের কথা বলেছেন।
ড. ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের উদ্দেশ্যে আমেরিকার মাটিতে পা দেওয়ার পর থেকেই তার প্রতিটি আচরণ ও পদক্ষেপ দেশের এবং বিদেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। এবার নিউইর্য়কে একটি অনুষ্ঠানে প্রদত্ত তার বক্তব্যকে দেশে-বিদেশে ল্যান্ডমার্ক ভাষণ হিসাবে অনেকে বিবেচনা করছেন। নিউইয়র্ক স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার এশিয়া সোসাইটি ও এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইন্সটিটিউট আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি এই ল্যান্ডমার্ক ভাষণ দেন। একটি দেশের সরকার প্রধান হওয়া সত্ত্বেও ডিপ্লোম্যাটিক এটিকেট সম্পূর্ণ বজায় রেখে বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিরতা এবং গত বছর অসংখ্যা তরুণ ও মানুষকে হত্যার জন্য দায়ী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়ার তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেছেন যে, ভারত থেকে একটি নয়, দুটি নয়, অসংখ্য ডাহা মিথ্যা সংবাদ ছড়ানো হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। তিনি বলেন, ভারতের এসব গাঁজাখুরি ও ডাহা মিথ্যায় এমন সব বিষয় যোগ করা হয়েছে, যা শুনলে একজন উন্মাদও হতভম্ব হয়ে যাবেন। তিনি বলেন, ভারতীয়রা বলছে, তার সরকার নাকি তালেবান সরকার। বাংলাদেশে নাকি এখন প্রবল ইসলামী আন্দোলন চলছে। আপনারা শুনলে অবাক হবেন যে, ভারতীয়রা আমাকে পর্যন্ত তালেবান বলছে।
ড. ইউনূস শুধুমাত্র ভারত এবং আওয়ামী লীগের মুখোশই উন্মোচন করেননি, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে যে ত্রয়োদশ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এ ব্যাপারেও সকলকে নিশ্চিত করেছেন। উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত দেশি ও বিদেশি অসংখ্য প্লাটফর্মে এবং গণমাধ্যমে ড. ইউনূস ফেব্রুয়ারিতে ইলেকশনের অঙ্গীকার বারবার পুনর্ব্যাক্ত করছেন। এখন মানুষ আরো বেশি করে নিশ্চিত হবে একারণে যে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রায় ২০০টি রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানদের সামনে প্রদত্ত ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওয়াদা পুনর্ব্যাক্ত করেছেন। এখান থেকে সরে আসা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তেমনি নির্বাচনের আগে সরকারের তক্তা উল্টানোর সাহসও করো না। কারণ, গত ২৬ সেপ্টেম্বর প্রায় ১০০টি দেশের প্রতিনিধিরা প্রধান উপদেষ্টার সাথে তার হোটেলে দেখা করেন এবং তার সরকারের প্রতি এবং তার সরকারের গৃহীত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সহযোগিতা প্রদানের আশ^াস দেন। এখন যদি কারো মনে উল্টা-পাল্টা কোনো আশা থেকে থাকে তাহলে সেই আশা দুরাশা হবে এই কারণে যে, ওই ধরনের কোনো হঠকারিতা একমাত্র ভারত ছাড়া বিশে^র আর কেউই সমর্থন করবে না। শুধু যে সমর্থন করবে না তাই নয়, বরং সেই হঠকারি গোষ্ঠিকে একেবারে একঘরে করে দেবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশে যে কয়টি দেশ রয়েছে তারা যদি নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক ব্যাপকভাবে উন্নত করতে পারে তাহলে উপমহাদেশভুক্ত সবগুলো দেশ রাজনৈতিকভাবে তো বটেই, অর্থনৈতিকভাবেও বিপুলভাবে উন্নত হতে পারে। এ ধারণা নিয়েই গঠন করা হয়েছিলো সার্ক। আর সেই সার্ক গঠনের আইডিয়াটাও দিয়েছিলো বাংলদেশই। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সার্কের ব্রেন চাইল্ড হলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনিই প্রথম এই উপমহাদেশের ৭টি দেশ নিয়ে সার্ক গঠনের প্রস্তাব করেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপকে নিয়ে বিপুল আশা ও সম্ভাবনা নিয়ে সার্কের উদ্বোধন হয়। কিন্তু সেই সার্ককেও আর এগিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি। সার্ক হোঁচট খেয়েছে। তার কারণও হলো ভারত। এখানেও ভারত দাদাগিরি করতে চেয়েছিলো। কিন্তু বাধা পায় তার চির বৈরী পাকিস্তানের কাছ থেকে। পাকিস্তান কিন্তু সার্ককে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলো। সার্কের সবচেয়ে বড় দেশ ভারত। আর সবচেয়ে ছোট দেশ মালদ্বীপ। সার্কের সনদে পরিষ্কার লেখা আছে যে, এই ফোরামে বড়-ছোটোর কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। সকলেরই থাকবে একটি করে ভোট। সার্ক ফোরাম থেকে উত্থাপিত কোনো প্রস্তাবের বিরুদ্ধে একটি দেশও যদি অবস্থান নেয় তাহলে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করা যাবে না। এমন উদারচিত্ততা আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে কদাচিৎ দেখা যায়। আরো বলা হয়েছে যে, সার্কে কোনো দ্বিপাক্ষিক বিষয় উত্থাপন করা যাবে না।
এমন মহতি উদ্দেশ্যকেও ভারত মানতে পারেনি। সমালোচনার ভয়ে ভারত সার্ককে কবরস্থ করার ইচ্ছা মুখ ফুটে প্রকাশ করেনি। কিন্তু তার কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে সেটি দিনের আলোর মতো ফুটে উঠেছে। সার্কের নিয়মিত অধিবেশন বা সম্মেলন বাদ দিয়ে ভারত বেশি করে মনযোগ দেয় বিমস্টেকে। এর কারণ হলো, বিমস্টেকে পাকিস্তান অর্ন্তর্ভুক্ত নেই।
॥দুই॥
ভারতের মুখোশ উন্মোচন করার জন্য ড. ইউনূসকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না। বিশেষ করে তিনি যখন বলেন যে, শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার ফলে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে, তখন সেটি প্রমাণ করার অবকাশ রাখে না। ড. ইউনূস আরেকটি চরম সত্য প্রকাশ করেছেন। সেটি হলো, তিনি বলেছেন যে, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবকে ভারত মেনে নিতে পারেনি। তিনি আমেরিকার মাটিতে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবে ছাত্রদের নেতৃত্ব ভারত মোটেই মেনে নিতে পারেনি।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, শেখ হাসিনাকে যখন ভারতে আশ্রয় দেওয়া হয় তখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এবং জনগণ, কেউ সেটা মেনে নিতে পারেনি। তারপরেও ড. ইউনূস বলেছিলেন যে, শেখ হাসিনাকে যখন ভারত আশ্রয় দিয়েই ফেলেছে তখন শেখ হাসিনা যেনো সেখানে চুপ থাকে। সে যেনো সেখানে কোনো কথা না বলে। কিন্তু দেখা গেলো, শেখ হাসিনা চুপ তো থাকছেনই না, বরং ভারতের মাটি ব্যবহার করে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ভারতে বসে যে কী ভয়ংকর খেলা খেলছেন তার জ্বাজ্জল্যামন প্রমাণ হলো, জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে এনসিপির দুই নেতা এবং বিএনপি মহাসচিবের ওপর আওয়ামী পান্ডাদের হামলা। গত কয়েক দিন ধরে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ এ সম্পর্কে সবই জেনেছেন। কিন্তু যেটি জানেননি, সেটি হলো, এই হামলার নির্দেশদাতা ছিলেন স্বয়ং শেখ হাসিনা। এ সম্পর্কে নিউইয়র্কে বসবাসরত একজন প্রবীণ বাংলাদেশি সাংবাদিক ছিলেন ওই হামলার আই উইটনেস অর্থাৎ প্রত্যক্ষদর্শী।
পত্রিকান্তরে তিনি লিখছেন, সদস্য সচিব আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপ ও তাকে লাঞ্ছনা করা থেকে রক্ষা করতে যারা তাকে নিরাপত্তা দিতে চেষ্টা করেছিল, তাদের একজন পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন যে, ডিম নিক্ষেপকারী তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। এ অভিযোগের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে বিবেচনা করে পুলিশ কয়েক ঘণ্টা পর ডিম নিক্ষেপকারী মিজানুর রহমানকে গ্রেফতার করে স্থানীয় থানায় নিয়ে যায়। মিজান ওই থানায় রাত কাটায় এবং তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের যথার্থতা না পেয়ে পরদিন পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। মিজানকে মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেয় যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এবং দিল্লি থেকে স্বয়ং শেখ হাসিনা ভিডিও কলে মিজানকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।
এটাই আওয়ামী চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। এখনো তাদের মাঝে শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি। কী কী কার্যকারণে তাদের পতন ঘটেছে এবং প্রধানমন্ত্রীসহ দলের সব শীর্ষ নেতাকে দেশ থেকে পলায়ন করতে হয়েছে সে সম্পর্কে তারা তাদের সোল (আত্মা) সার্চ করেনি। তাদের মাঝে কখনোই তাদের কোনো অপকর্ম, ভুলের কারণে অনুশোচনা করতে দেখা যায়নি। তারা তাদের দ্বারা বিরোধী পক্ষের লোকজনের ওপর নিগৃহ চালানো, গুম করা, এমনকি হত্যাকা- চালানোকে পর্যন্ত বিজয়োৎসব হিসাবে উদযাপন করতে অভ্যস্ত।
তারেক রহমান তার বক্তব্যে যে চরম সত্যটি প্রকাশ করেছেন সেটি হলো, এই মুহূর্তে সকলের প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ হওয়া। ঐক্যবদ্ধ হয়ে গুপ্ত স্বৈরাচারকে প্রতিহত করা। আমার বিশেষ পরিচিত একজন সিনিয়র কলামিস্ট লন্ডন এবং ভারত হয়ে গত ২৬ তারিখ দেশে ফিরেছেন। ২৭ সেপ্টেম্বর ফোনে তিনি আমাকে জানালেন যে, অতি সন্তর্পণে কয়েক হাজার আওয়ামী সন্ত্রাসী বাংলাদেশের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। নির্ধারিত সময় নির্বাচনটি যেনো বাঞ্চাল করা যায় সে জন্য তারা মরণ কামড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিলের ফ্রিকুয়েন্সি এবং কলেবর বাড়ছে। যতোই দিন যাবে ততোই তাদের নাশকতামূলক তৎপরতা বাড়তেই থাকবে। বাড়তে বাড়তে এক সময় তারা একটি বড় অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে চায়।
এই কারণে তারেক রহমানের ঐক্যের আহবান সময়োচিত। জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল এবং ছাত্রসংগঠনসমূহকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের মুখোশ পরা ভারতীয় সন্ত্রাসীদেরকে লৌহ কঠিন হস্তে মোকাবেলা করতে হবে। স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এর কোনো বিকল্প নাই।
Email:journalist15@gmail.com