ভগবান এস কিদওয়াই-র ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’ গ্রন্থটি প্রকাশিত না হলে এবং প্রকাশিত গ্রন্থের কাহিনী নিয়ে টেলিভিশনে সিরিয়াল নির্মিত না হলে ইতিহাসে তার অবস্থান অনেকটাই ঝাপসা হয়ে যেত বলে মনে হয়।
অথচ ১৮৭০ সালে প্রকাশিত জুল ভার্নের ‘টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’, ‘দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’ (১৮৭৫) এবং জার্নি থ্রু দি ইম্পসিবল কল্প কাহিনীর রহস্যময় চরিত্র ক্যান্টেন নিমো নিজেকে টিপু সুলতানের ভাইপো হিসেবে পরিচিত করিয়েছে। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও যুদ্ধ সংবাদদাতা জর্জ আলফ্রেড হেনটির ‘দ্য টাইগার অব মাইসোর’-এর অন্যতম চরিত্র টিপু সুলতান: নামিজ হিজাজির ‘আওর তলওয়ার টুট গায়ে’ উপন্যাসের কাহিনী দাঁড়িয়েছে টিপু সুলতানের যুদ্ধ নিয়ে। এমনকি উইকি কলিন্সের ‘দ্য মুনস্টোন’ টিপু সুলতান এবং শ্রীরঙ্গপট্টমের পতন নিয়ে রচিত। আরো অনেক ইউরোপীয় প্রকাশনা টিপুকে ঘিরে।
দক্ষিণ ভারতের মহীশুর রাজ্যের শাসক টিপু সুলতান (১৭৫০-৯৯) পাশ্চত্যের লেখকদের যতটা তার সম্পর্কে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন, আর কোনো শাসক তা পারেননি। টিপু নিজে সৃজনশীল যোদ্ধা, শাসক ও লেখকও ছিলেন। বিস্ময়কর এবং সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থগার ছিল টিপুর। পাঠাগারটি ছিল মহীশুরের কাছে শ্রীরঙ্গপট্টমের লাল মহল প্রসাদে। পুরো পাঠাগার লুণ্ঠিত হয়ে গেছে, তাই সৌভাগ্য তার লাইব্রেরিতে যেসব বইপত্র ছিল তার তালিকা পাওয়া গেছে এবং লুণ্ঠনের পর বহুসংখ্যক বইয়ের হদিসও মিলেছে। টিপু চতুর্থ এবং শেষ ইংরেজ-মহীশুর যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হওয়ার পর ব্রিটিশ বাহিনী টিপু সুলতানের লাইব্রেরি আগুনে ভস্মীভূত করেনি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যরা ৪ ও ৫ মে ১৭৯৯ লাইব্রেরি অবরুদ্ধ রাখে এবং লাইব্রেরির সব বই, জার্নাল, দলিল, মানচিত্র, ড্রইং এবং অন্যান্য সামগ্রী অক্ষত অবস্থায় তুলে নিয়ে ইংল্যান্ডে পাঠায় অথবা মাদ্রাজ, কলকাতা ও বোম্বাইতে কোম্পানির অফিস লাইব্রেরিতে রেখে দেয়। টিপুর সংগ্রহের একাংশ কলকাতায় গভর্নর জেনারেলের লাইব্রেরি শোভাবর্ধন করে; রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হলে এসব বই সেখানে পাঠানো হয়। গভর্নর জেনারেলের স্থলে ভারতের শীর্ষ ব্রিটিশ শাসক হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন ভাইসরয়। টিপুর বইপত্র ভাইসরয়ের লাইব্রেরির বই হিসেবে চিহ্নিত হয়।
লাইব্রেরি থেকে ব্রিটিশ সেনারা বই বের করার সময় পেয়েছিল কোরআন শরীফ, বিভিন্ন লেখকের কোরআনের ৪১টি তফসির গ্রন্থ, প্রার্থনা গ্রন্থ ৩৫টি, ৪৬টি ঐতিহ্যবিষয়ক গ্রন্থ, সুফিজমের ১১৫টি গ্রন্থ, নৈতিক শিক্ষার ওপর ২৪টি বই; আইন ও বিচারবিষয়ক ৯৫টি, শিল্প ও বিজ্ঞানের ১৯টি, ইতিহাসের ১১৮টি, ৫৩টি পত্র, ১৯০টি কবিতা, গণিতবিষয়ক সাতটি, জ্যোতির্বিদ্যার ২০টি, অভিধান ২৯টি, দর্শন ৪৫টি, হিন্দি ও দক্ষিণাত্যের ভাষায় ২৩টি; পদার্থ বিজ্ঞানের ৬২টি, গদ্য চারটি, তুর্কি গদ্য দুটি, ১৮টি গল্পগ্রন্থ।
পা-ুলিপিগুলো একসময় বিজাপুরের রাজা আদিল শাহ, গোলকুন্ডার কুতুব শাহ রাজপরিবার এবং চিতোর লাইব্রেরির ছিল। এগুলো টিপুর সংগ্রহে আছে। টিপুর বিরুদ্দবাদীরা মনে করেন, তিনিও ব্রিটিশদের মতো তাদের কাছ থেকে এগুলো লুট করে এনেছেন। টিপু সুলতান বইয়ের একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন, তিনি নিয়মিত বই পড়তেন, কোনো কোনো বই বারবার পড়েছেন। যেসব বই তিনি পড়েছেন, সেগুলোয় সিলমোহর দিয়ে তিনি স্বাক্ষর করতেন। তালিকা করার সময় দেখা যায় অধিকাংশ বইয়ে তার সিলমোহর ও সই রয়েছে। কোনো কোনো বইয়ে তিনি ভিন্ন একটি নামে সই করেছেন। টিপু সুলতানের লাইব্রেরি দখলের পর কোম্পানি কার্কপ্যাট্রিক নামের একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করল। তিনি টিপুর সই করা প্রায় সব বই দেখেছেন, তিনি দেখলেন কোনো বইয়ে টিপু তার পাঠ প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য লিখে রেখেছেন। তার মন্তব্যগুলো অনেক প্রাণবন্ত এবং এত গ্রন্থের সারবত্তা নিহিত। কার্কপ্যাট্রিক দুই হাজার বইয়ের তালিকা করেন। লুণ্ঠিত বইয়ের কিছু অংশ অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়কেও দেয়া হয়। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ এবং রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটিকেও দেয়া হয়। কিছু বই চলে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাস প্রণেতা রবার্ট ওরমের কাছে। তিনি ভারতের অনেক বই ও পান্ডুলিপি ও চিঠিপত্র সংগ্রহ করেছিলেন, এগুলোই সৃষ্টি করে কোম্পানির রেপোজিটরি অব ইস্টার্ন রাইটিংস। সুফিদের প্রতি টিপু শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং এ বিষয়ে পড়াশোনা করতেন। ব্যাঙ্গালোরে ব্রিটিশবিরোধী যুদ্ধে দুজন সুফি তার পাশে থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় তিনি তাদের আরো ভক্ত হয়ে ওঠেন। ‘বাংলার ইতিহাস’ গ্রন্থখ্যাত চার্লস স্টুয়ার্ট লিখেছেন ‘আ ডেসক্রিপটিভ ক্যাটালগ অব দ্য ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরি অব দ্য লেট টিপু সুলতান’। তিনি এ লাইব্রেরিতে সুফিবাদের ওপর ১৫টি বই রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। তার তালিকায় এ লাইবেরির কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৯০টি, ইতিহাসগ্রন্থ ১১৮টি। তিনি আরো বলেছেন, শ্রীরঙ্গপট্টমের পতন ও টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত সব মহীশুর পান্ডুলিপি মাদ্রাজের ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে পাঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এ লাইব্রেরির অত্যন্ত মূল্যবান একটি গ্রন্থ ছিল মণিমানিক্য খচিত কোরআন শরীফ। এটি কোম্পানি ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ১৮০৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরস এ কোরআন শরীফটি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে উপহার দেন। এ কোরআনের প্রকাশনার কোনো তারিখ না থাকলেও গবেষকরা মনে করেন এটি ১৬৫৫ সালের। টিপুর ব্যক্তিগত পাঠাগারের আরো একটি রত্নখচিত কোরআন ছিল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আরো কিছু সংখ্যক বই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি ও রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটিকে প্রদান করে। টিপু সুলতানের বইয়ের তালিকায় আরো ছিল যুবরাজ দারা শুকো এবং কাঠিয়ালের বাবা লাল দাসের মধ্যে হিন্দু ফকির তত্ত্ব নিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে রচিত একটি গ্রন্থ ‘সওয়াল ও জবাব দারা শুকো ওয়া বাবা লাল’। টিপুর লাইব্রেরির ইতিহাস অংশে ছিল: শামস-ই-সিরাজ আফিফের লেখা তওয়ারিখ-ই-ফিরোজ শাহি, আবুল ফজলের আকবরনামা, বাহাদুর সিংহের শাহজাহাননামা ও মাজমুয়াই খুররামি, আওরঙ্গজেবের প্রথম ১০ বছরের ইতিহাস আলমগীরনামা এবং বাহাদুর শাহের ওপর একটি বই। তার লাইব্রেরির ছিল তাবাকাত-ই-আকবরি, ভারতবর্ষের ইতিহাসের পান্ডুলিপি। ইরান সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বই ছিল লাইব্রেরিতে। ইউরোপীয় দেশগুলো নিয়ে লেখা বইও ছিল। টিপু সুলতানের বাবা সুলতান হায়দার আলী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান না করলেও ছেলেকে সুশিক্ষিত করছেন। টিপু সুলতান বহু ভাষায় দক্ষ ছিলেন এ ভাষাগুলোর মধ্যে ছিল: কন্নড়, হিন্দুস্তানি, ফার্সি, আরবি, ফরাসি ও ইংরেজি। ১৭৮৫ সালে তিনি ইউরোপ থেকে ফরাসি ভাষায় লেখা একটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের গ্রন্থ পেয়েছিলেন ও গুরুত্বপূর্ণ এ বইটি অনুবাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সম্রাট আকবরের হুকুমে ফার্সি ভাষা অনূদিত মহাভারত তার লাইব্রেরিতে ছিল। এটি একটি দুর্লভ সংগ্রহ। জামিয়া-ই-ওমর নামে শ্রীরঙ্গপট্টমনামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও তিনি স্থাপন করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যুগপৎ আধুনিক ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের নির্দেশ দেন। মসজিদভিত্তিক মক্তব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও তারই। তবে এখানেও তিনি আধুনিক শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। নির্দিষ্ট অঞ্চলে তালুকদারের দায়িত্ব ছিল মক্তবে সব শিশুর উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
পৃথিবীতে লুটের মালের সবচেয়ে বড় আস্তানা লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে টিপু সুলতানের সংগ্রহের ৯৪টি অমূল্য পান্ডুলিপি রয়েছে। বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহের ব্যক্তিগত লাইব্রেরির ৪৩৮টি পান্ডুলিপিও এখানে রয়েছে এর মধ্যে মিউজিয়াম ৭২টি পান্ডুলিপি কিনেছিল ভারতের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছ থেকে।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ লাইব্রেরিতে প্রচুর বই আনা হয়েছিল। আটটি শাখায় ও ১৭টি উপশাখায় প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য ইতিহাস, চিকিৎসা শাস্ত্র, পশুপালন ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ের বই রয়েছে। কেবল ফার্সি এবং আরবি ভাষার বই তখন ক্যাটালগভুক্ত করা হয়। এ ক্যাটালগের বাইরেও বাংলা, হিন্দি, সংস্কৃত ও উর্দু ভাষার পান্ডুলিপি গ্রন্থ ছিল।
টিপু সুলতানের দুর্ভাগ্য তার পরাজয় ও মৃত্যু। কিন্তু তার লুণ্ঠিত লাইব্রেরির সৌভাগ্য যে বইপত্র ও পান্ডুলিপি ভস্মীভূত করা হয়নি। কোথাও না কোথাও তার সংগ্রহের অধিকাংশ বইপত্র ও পান্ডুলিপি সুরক্ষিত। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বিশাল সংগ্রহশালায় ভারতীয় গ্যালারিতে টিপুর পাঠাগারের পান্ডুলিপি দেখার সুযোগ নিবন্ধকারের হয়েছিল। টিপুর দুর্ভাগ্য এখনকার ভারত সরকার পাঠ্যবই থেকে টিপু সুলতানের ওপর লিখিত অধ্যায়গুলো অবলুপ্ত করছে। বিরোধী দলসহ ভারতীয় ঐতিহাসিকরা বলেছেন এতে ইতিহাস ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। হাস্যকর জবাব সরকার দিয়েছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে পাঠ সংকোচনের জন্য টিপু সুলতানের অধ্যায় বাদ পড়েছে।
লাইব্রেরি আগুনে ধ্বংস করা হয় এটাই পৃথিবী দেখে এসেছে খ্রিস্টজন্মের ৪৮ বছর আগে জুলিয়াস সিজারের হাতে মিসর অবরুদ্ধ হলে আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। তারপর ২৭০ খ্রিস্টাব্দ, ৩৯১ এবং ৬৪২-এ আগুন লাগিয়ে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করা হয় পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এ গ্রন্থসম্ভার। হিটলারের ব্রাউন শার্ট স্ট্রর্ম ট্রপার্স ব্রিগেড বইয়ের স্তূপে আগুন দিয়ে স্যালুট জানায় এবং জার্মান দেশাত্মবোধক গান গায়। সর্বশেষ ভয়ংকর অগ্নিশিখায় পুড়ে ছাই হয় বাগদাদের গ্রন্থাগার। মার্কিন সৈন্যরাও জানে সভ্যতা ধ্বংস করতে গ্রন্থাগার নিশ্চিহ্ন করাই উত্তম গবেষণা। সুনীল বাবু নামের একজন সংগ্রাহক নিলামে তুললেন ১৭৯২ সালের চার পাতার আমেরিকান সংবাদপত্র দ্য মেইল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে মহীশুরের তৃতীয় যুদ্ধে টিপুর পরাজয়ে সংবাদ এতে প্রকাশিত হয়েছে। জার্মানিতে তৈরি দুটি মানচিত্র একটি ১৭৯২ সালে টিপু সুলতানের রাজত্ব এবং অন্যটিতে টিপুর পরাজয় ও মৃত্যুর রাজত্বের মালিকানা। জ্য ডুপ্লে বার্তুর আঁকা একটি লিথোগ্রাফ নাম ‘টেকিং অব দ্য ফোর্ট অব সেরিঙ্গাপাটনাম’ ব্রিটিশ বাহিনী টিপুর দুর্গ দখল করে নিচ্ছে। এখানেই টিপুকে সর্বশেষ জীবিত অবস্থায় দেখা যায়। টিপুর পাঠাগার নেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অনেক বর্বরতার মধ্যেও বইগুলো রক্ষা করার সদিচ্ছার প্রশংসা করতেই হয়। সুলতান ফতেহ আলী সাহেব টিপুর জন্ম ২০ নভেম্বর ১৭৫০। তিনি ৪ মে ১৭৯৯ নিহত হন।
লেখক: এমএ মোমেন: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা