২০২০ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতের ঋণের স্থিতির বিপরীতে রাখা গ্রাহকদের জামানতের ৬৭ দশমিক ১২ শতাংশই ছিল স্থাবর সম্পত্তি। যদিও এক দশক আগে ২০১০ সালের শুরুতে এ হার ছিল ৪৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। এক দশক ধরেই ঋণের বিপরীতে জমি বন্ধক রাখার প্রবণতা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। দেশের ব্যাংক খাতের জামানতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ হলো ব্যাংক গ্যারান্টি। এছাড়া ব্যাংক জামানতের ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ রফতানি ডকুমেন্টস ও পণ্যদ্রব্য, ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ ফাইন্যান্সিয়াল অবলিগেশনস, ২ দশমিক ৯২ শতাংশ মেশিনারি যন্ত্রপাতি ও ফিক্সড অ্যাসেট, শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ শেয়ার অ্যান্ড সিকিউরিটিজসহ অন্যান্য সম্পত্তি ঋণের বিপরীতে জামানত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশে জমি বন্ধক রেখে ঋণ বিতরণের বিদ্যমান প্রবণতাটি ইউরোপে অর্ধশতক আগে ছিল বলে জানান ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী। তিনি বলেন, আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে জার্মানিতে ব্যাংকঋণ দেয়ার জন্য জমিসহ স্থাবর সম্পত্তি জামানত দেয়া হতো। ফলে দেশটিতে জমির মূল্য বাড়তে থাকে। ব্যাংকের কাছে জামানত হিসেবে যেসব জমি ছিল সেগুলোর দামও বাড়তি দেখানো হতো। কিন্তু পরে দেখা গেল জামানতের সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা আদায় করার পরিস্থিতি আর নেই। বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের পরিস্থিতিও অনেকটা অর্ধশতক আগের জার্মানির মতোই। জামানত হিসেবে জমির প্রাধান্য থাকায় দেশে জমির মূল্যও বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অনেকেই জমি কিনছেন। সে জমি অন্য ব্যাংকে বন্ধক রেখে আবারো জমি কিনছেন। জমি বন্ধক রেখে আধুনিক বিশ্বে এখন আর ব্যাংকঋণ দেয়া হয় না। বরং প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সক্ষমতা দেখে ঋণ দেয়া হয়।
শিপইয়ার্ডের ২৯৫ দশমিক ৭৬ শতক জমি বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন। পূর্বাপর বিবেচনা না করে ব্যাংক তাকে এ ঋণ দেয়। পরে জানা যায়, ঋণের জন্য ব্যাংকে যে জমি তিনি বন্ধক রেখেছিলেন, তা ছিল মূলত সংরক্ষিত বনা ল। এরই মধ্যে বন বিভাগ ওই জমি দখলে নিয়েছে। ফলে বন্ধকি জমি বিক্রি করে ঋণ আদায়ের উপায়ও নেই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের।
রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও বড় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নিয়মিতই অভিযোগ উঠছে সরকারি খাসজমি দখলের। দখলের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না নদী, পাহাড়, বন, রেলসহ সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের ভূমিই। ব্যক্তি খাতের বিরোধপূর্ণ জমিও প্রভাবশালীদের দখলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। দখল বা নামমাত্র মূল্যে কিনে নেয়া এসব জমি দেয়া হচ্ছে ব্যাংক জামানত হিসেবে। বিপরীতে দেশের ব্যাংক খাত থেকে বের করে নেয়া হচ্ছে লক্ষ কোটি টাকা।
সম্প্রতি সংসদীয় কমিটিকে দেয়া বন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৮৮ হাজারের বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দখলে রয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৩ একর সংরক্ষিত বনভূমি। অবৈধভাবে দখল করা এসব বনের জমি বন্ধক দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণও নিয়েছেন অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি। এ ধরনের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে সতর্ক করার জন্য তাগিদ দিয়েছে সংসদীয় কমিটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত এক দশকে জমি-বাড়ি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার প্রবণতা বহুগুণ বেড়েছে। ২০১০ সালের ডিসেম্বর শেষে জমি বন্ধকের বিপরীতে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা, যা ছিল ওই সময় বিতরণকৃত মোট ঋণের ৪৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এক দশক পর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এসে জমি বন্ধকের বিপরীতে ব্যাংকঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ১৩ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ৬৭ দশমিক ১২ শতাংশই গিয়েছে জমিসহ বাড়িঘর বন্ধকের বিপরীতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণের নামে ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে নেয়ার ক্ষেত্রে গ্রাহকরা জমিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। এক্ষেত্রে সহযোগীর ভূমিকা পালন করছেন ব্যাংকাররা। অনেক ক্ষেত্রেই পারস্পরিক যোগসাজশে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের জন্য জমিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। জমির দাম কয়েক গুণ বেশি দেখিয়ে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে খেলাপি হলে জামানতের সম্পদ নিলামে তুলেও বিক্রি করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এ তালিকায় দেশের বড় করপোরেটগুলো যেমন আছে, তেমনি আছে ছোটরাও।
একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, ব্যাংকারদের যাচাই-বাছাই করে বড় ঋণ দেয়ার পরিস্থিতি এখন আর নেই। বড় ঋণের প্রস্তাব চেয়ারম্যানসহ ব্যাংকের পরিচালকদের মাধ্যমেই আসছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন মহলের তদবিরের কথা বলে পর্ষদকে অন্ধকারে রাখা হচ্ছে। ব্যাংকাররা চাকরি বাঁচানোর স্বার্থে পর্ষদের দাবি পূরণ করছেন। ফলে ঋণের জামানতের সম্পত্তির যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাংকের কাছে জামানত হিসেবে যে জমি আছে, তার প্রকৃত মূল্য কত তা যাচাই করার সময় এসেছে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালানো দরকার।
বর্তমানে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার প্রায় ৩২ লাখ কোটি টাকা। অথচ শুধু জমি বন্ধক রেখেই ব্যাংকগুলো ৭ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে, যা দেশের জিডিপির ২০ শতাংশেরও বেশি। জামানতের জমি বিক্রি করলে ব্যাংকঋণ উসুল হবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, জামানতের জমি, বাড়িঘর বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা আদায় হবে না। গ্রাহক ও ব্যাংকারদের দেখানো জমির মূল্য আর বাস্তবতার মধ্যে তফাত আছে। আবার জমির বাজারমূল্য, তৎক্ষণাৎ বিক্রির মূল্য এবং নিলাম মূল্য এক হয় না। দেশের প্রেক্ষাপটে প্রভাবশালীদের জমি নিলামে তুলে বিক্রি করা যায় না। সাধারণ মানুষ ব্যাংকের জামানতের জমি কিনতে আগ্রহী নয়। অনেক সময় আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও নিলামে বিক্রীত জমির দখল পাওয়া যায় না।
দেশের ব্যাংক খাতের আলোচিত সব ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় জামানতের স্থাবর সম্পত্তিকে অতিমূল্যায়িত করে দেখানোর বিষয়টি ধরা পড়েছে। হলমার্ক, ক্রিসেন্ট, বিসমিল্লাহ গ্রুপের জালিয়াতি ধরা পড়লেও এসব গ্রুপের জামানতের সম্পদ বিক্রি করে অর্থ আদায় সম্ভব হয়নি। দফায় দফায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেও ক্রেতা মেলেনি কেলেঙ্কারিতে যুক্ত গ্রুপগুলোর জামানতের সম্পদের। ব্যাংক খাত থেকে শত শত কোটি টাকার ঋণ নেয়া অন্য গ্রুপগুলোর জামানতের সম্পদের পরিস্থিতিও একই।
রাজধানী ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকার সরকারি খাসজমি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ বের করে নেয়ার অসংখ্য ঘটনা প্রকাশ হয়েছে বিভিন্ন মিডিয়ায়। পাশাপাশি চট্টগ্রামসহ সারা দেশেই বিতর্কিত ও সরকারি জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ বিতরণের ঘটনাও প্রকাশ হয়েছে। সেসব প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, জামানত হিসেবে ব্যাংকগুলোর কাছে যে জমি বন্ধক আছে, তার বৃহৎ অংশই বিতর্কিত। নদী, নদীর চর, শিকস্তি (নদীতে ভেঙে যাওয়া জমি) ভূমি, সংরক্ষিত বনা লের জমি ও বন, পাহাড়, রেলওয়েসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জমি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখেছেন প্রভাবশালী গ্রাহকরা।
বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের জায়গা দখল করে অর্থনৈতিক অ ল এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছেন ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য। দখলকৃত জায়গাই দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকে জামানত দিয়ে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি দখলকৃত জায়গা উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছে বি আইডব্লিউটিএ। যদিও উদ্ধারকৃত জায়গার বড় অংশই আবার ব্যাংকের কাছে জামানত রয়েছে।
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সহরটোক মৌজার পাঁচটি দাগের এক একরের বেশি জমি জামানত নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংক। এর বিপরীতে একটি নামসর্বস্ব আবাসন কোম্পানিকে ২৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। যদিও বণিক বার্তার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বন্ধকি সম্পত্তির পুরোটাই ব্রহ্মপত্র নদের চালা ও শিকস্তি ভূমি।
ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জ, দোহার, ডেমরা, সাভারসহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ সরকারি খাসজমি। পাশাপাশি ওয়াক্ফ স্টেটেরও বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে এসব এলাকায়। অথচ সরকারি ও ওয়াক্ফকৃত এসব সম্পত্তির বড় অংশই বিভিন্ন ব্যাংকে জামানত দিয়েছেন প্রভাবশালী গ্রাহকরা। বিপরীতে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। এ পরিস্থিতিতে বিতর্কিত জমি বন্ধক রেখে বিতরণকৃত ব্যাংকঋণের কতটুকু ফিরে আসবে, তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে।
জামানতের জমি বিক্রি করে টাকা আদায় হয় না বলে মনে করেন পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল হালিম চৌধুরীও। তিনি বলেন, আমরা গ্রাহকদের ঋণ দিই ব্যবসা দেখে। জমি বা স্থাবর সম্পত্তি দেখে ঋণ দিই না। জামানত রাখা হয় ঋণের নিরাপত্তার জন্য। যথাযথ মূল্যায়ন করে কোনো ঋণ বিতরণ করা হলে সে ঋণ খেলাপি হয় না। তার পরও দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কেউ খেলাপি হলে জামানতের সম্পদ বিক্রি করে কিছু টাকা আদায় হয়, তবে জালজালিয়াতি বা চাপে পড়ে ঋণ বিতরণ করা হলে সেটি আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম।