শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৩২ পূর্বাহ্ন

প্রাইভেসি ও ইসলাম

উম্মু নুসায়ের:
  • আপডেট সময় রবিবার, ৭ মার্চ, ২০২১

প্রত্যেক মানুষের প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত বিষয় তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার; যা তার আত্মমর্যাদার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যতম সাংবিধানিক মানবাধিকার। আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে, গোপনীয়তার অধিকার হলো আমাদের চার পাশে একটি নির্দিষ্ট সীমা রাখার অধিকার, যার মধ্যে এমন সব জিনিস রয়েছে যা আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেমন : শরীর, বাড়ি, সম্পত্তি, চিন্তা-চেতনাসহ অন্যান্য একান্ত নিজস্ব বিষয়াদি । প্রাইভেসির অধিকার আমাদের এই ক্ষমতা দেয় যে, আমাদের ব্যক্তিগত কোনো কোনো বিষয়ে অন্যরা হস্তক্ষেপ করাকে নিয়ন্ত্রণ করার।’ তাই কারো প্রাইভেসির সীমালঙ্ঘন করাকে অনধিকার অনুপ্রবেশ বিবেচনা করে কুরআন ও সুন্নাহতেও এটি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেখানে অন্যের বাড়িতে উঁকি দেয়া থেকে শুরু করে, অনুমতি ছাড়া কারো ঘরে প্রবেশ করা, অন্যের চিঠি পড়া এবং আর্থিক, ব্যক্তিগত একান্ত পারিবারিক ব্যাপারগুলোতে অনধিকার হস্তক্ষেপকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

একজন ব্যক্তির প্রাইভেসিকে সম্মান প্রদর্শন করা ইসলামী শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত । প্রাইভেসি রক্ষার স্বার্থে ইসলাম কাউকে কারো গৃহে প্রবেশ করার আগে অনুমতি নিতে নির্দেশ দিয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে : ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্য গৃহে প্রবেশ করো না যে পর্যন্ত আলাপচারিতা না করো এবং গৃহবাসীদের সালাম না করো। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম। যা তোমরা স্মরণ রাখো। (২৪:২৭)’
হাদিসে সুস্পষ্টভাবে আছে, ‘গৃহে প্রবেশের অনুমতির জন্য তিনবার জিজ্ঞাসা করে নেতিবাচক জবাব পেলে ফিরে যেতে হবে।’ (মুসলিম : ১৪২১)।
এ ছাড়াও মা-বাবা, সন্তান ও ভাইবোন সবাইকেই কারো রুমে ঢোকার পূর্ব অনুমতি নিতে বলা হয়েছে : ‘একজন ব্যক্তির অবশ্যই ঘরে প্রবেশের পূর্বে তার সন্তান, মা (যদিও তিনি বৃদ্ধ হন), তার ভাইবোন ও বাবার কাছে অনুমতি নেয়া উচিত ।’ (বুখারি, আল-আদাবুল মুফরাদ: ১০৬২)।
এমনকি স্বামীকেও তার স্ত্রীর রুমে প্রবেশ করার পূর্বে অনুমতি চাইতে বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: কোনো সফর থেকে ফিরে সরাসরি তার স্ত্রীদের রুমে প্রবেশ করতেন না। তিনি প্রথমে মসজিদে যেতেন এবং তাঁর উপস্থিতি স্ত্রীদের জানাতেন ; যাতে তাঁরা নিজেদের পরিপাটি করে নিতে পারেন। সুবহানাল্লাহ! এত সুন্দর শিষ্টাচার ইসলাম ছাড়া আর কোনো মানব রচিত আইনে আছে কি?
কারো বাড়ির সামনে গিয়ে প্রবেশের অনুমতির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হলে, দরজার ঠিক সোজাসুজি দাঁড়ানো উচিত না। এমনকি দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে নজর দেয়াও অনুচিত। আবদুল্লাহ বিন বুসর রা: থেকে বর্ণিত, ‘নবী সা: যখন কারো বাড়ি বা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াতেন, তখন অবশ্যই দরজার দিকে মুখ করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে না, বরং দরজার ডান কিংবা বাম পাশে দাঁড়াতেন এবং সালাম করতেন।’ (মুসনাদ আহমাদ : ১৭৬৬২)।
ইসলামে ব্যক্তিগত প্রাইভেসিকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছে যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনো কিছুই বাদ যায়নি যার শিষ্টাচার আমাদের শেখানো হয়নি। তেমনি অন্যের বাড়িতে উঁকি দিয়ে দেখাকে নিষিদ্ধ করে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘কেউ যদি তোমার অনুমতি ছাড়াই তোমার ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে তাকায়। আর তুমি যদি পাথর মেরে তার চোখ ফুটিয়ে দাও। তাহলে তাতে তোমার কোনো দোষ হবে না। (আবু দাউদ : ৫১৭২)।
আজকাল আমাদের বাসাগুলো, বিশেষ করে শহরে এতটাই কাছাকাছি যে উঁকি দেয়া সহজ। কিন্তু এটা করা যাবে না। কারণ এতে অন্যের প্রাইভেসি লঙ্ঘন হয়। তার চেয়ে বড় কথা ইসলামের দৃষ্টিতে তা অপরাধ। তাই খুব সচেতনভাবেই পরিহার করতে হবে আমাদের এই প্রবণতাকে।
অন্যের গোপন বিষয়ে কৌতূহল দেখানো বা অনুসন্ধান করা ব্যক্তির প্রাইভেসির অধিকার লঙ্ঘনের শামিল। হাদিসে এসেছে, ‘একে অন্যের বিরুদ্ধে অহেতুক উৎসুক হয়ো না এবং একে অপরের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করো না।’ (বুখারি: ৫৭২৪)।
একইভাবে কারো চিঠি অনুমতি ছাড়া পড়াও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ : ‘একজন যখন তার ভাইয়ের চিঠিতে অনুমতি ছাড়া নজর দেয়, সে যেন জাহান্নামের আগুন দেখছে।’ (আল-আদাব আল-শারিয়াহ : ১১,১৬৬)। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে চিঠির প্রচলন কমে গেলেও ইমেইল অ্যাকাউন্ট বা অন্য কোনো অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং করা হয়ে থাকে অহরহই। এ ধরনের চর্চাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। কারণ এতে ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদা হুমকির মুখে পড়ে এবং তার অধিকার নষ্ট হয়। এমনিভাবে কারো ব্যক্তিগত ফোন অনুমতি ছাড়া দেখাও তার প্রাইভেসির অধিকার ক্ষুণ্ন করার শামিল।
এ ছাড়াও অন্যের গোপন বিষয় প্রকাশ করা যেমন অন্যায় তেমনিভাবে অন্যের গোপন কিছু হতে পারে ত্রুটি-বিচ্যুতি যা গোপন রাখাও নেকির কাজ : ‘এক মুসলিম অন্য মুসলিমের ভাইস্বরূপ।… আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষত্রুটি গোপন করে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তার ত্রুটি-বিচ্যুতিকে গোপন রাখবেন।’ (আবু দাউদ : ৪৮১৩)।
ইসলাম প্রাইভেসি রক্ষা করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। এমনকি যেখানে রাষ্ট্রকেও তার জনগণের ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করা হয়েছে। বরং জনগণের সম্মান ও প্রাইভেসি রক্ষা করাকে রাষ্ট্রের কর্তব্য হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। আমাদের উচিত ইসলাম প্রদত্ত প্রাইভেসির শিষ্টাচারগুলো নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করা। কেননা এই চর্চার মাধ্যমে আমরা একটি সুন্দর সমাজ গঠন করতে পারব, যার ভিত্তি স্বচ্ছতা ও পারস্পরিক বিশ্বাস। তাই একজন মুসলিম অপর মুসলমানের প্রাইভেসিকে সম্মান করবে। কারণ এটা তার ধর্মীয় বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং শরিয়াহ নির্দেশিত অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com